স্মৃতির সরণী বেয়ে
সায়ন্তনী বসু চৌধুরী
সদ্য পাটভাঙা ধবধবে সাদা শাড়ির মতো কুয়াশার আস্তরণটা একটু একটু করে সরছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শুভ্র দেখল ব্লু কোরাল ব্লকের একটা বাচ্চা নাইটস্যুট পরে দরজায় দাঁড়িয়ে মুখভর্তি কুয়াশা টেনে নিয়ে হাঁ করে করে ধোঁয়া ছাড়ছে। আর কচি হাত দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে ব্যস্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো একটা ভঙ্গি করছে। বাচ্চাটার মাথা ভর্তি ফিনফিনে রেশমের মতো চুল। কপালের ওপর থেকে ঝামরে পড়ে চোখ দুটোকে ঢেকে দিয়েছে প্রায়। যেন প্যাস্টেল রঙে আঁকা কোনও ছটফটে অ্যানিম চরিত্র! ছেলেবেলায় বুঝি সবাই এই কাজটা করে। বড়দের অনুকরণ করে বড় হওয়ার চেষ্টা! মা নিষেধ করলে মুখখানা গম্ভীর করে শুভ্র বলত,
‘ডু নট ডিসটার্ব! দেখছ না, আমি কোল্ড সিগারেট খাচ্ছি!’
চায়ের কাপ হাতে ইজি চেয়ারে বসে হেসে লুটোপুটি খেতেন ওর বাবা। মা চোখ পাকাতেন।
‘খালি বুড়োদের মতো কথা! বড্ড পেকেছিস না?’
‘কোল্ড সিগারেট’ কথাটা সম্ভবত ছোটমামার মুখে শোনা। সেখান থেকেই কপি করেছিল শুভ্র। আজকাল কিছু একটা দেখলেই দ্রুত নিজের ছোটবেলার সঙ্গে রিলেইট করে ফেলছে শুভ্রনীল। বড্ড বেশিই নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ছে। লক্ষণটা সুবিধের নয়। গত রাতে কখন ঘুমিয়েছিল ওর মনে নেই। সারা শরীরে এখনও ক্লান্তির রেশ। আর ঘুমের সাহস দেখো! চোখ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে জেদি বাচ্চার মতো সে এখন দুই পায়ের গোছে শিকল পরিয়েছে। কিছুতেই পিছু ছাড়বে না। টলতে টলতে কিচেনের দিকে চলল শুভ্র। কড়া করে একটা কালো কফি খেতে হবে এখুনি। নাহলে মাথাটা ছাড়বে না। কাঠের ক্যাবিনেটের এধার থেকে ওধার বেশ খানিক্ষণ অস্থিরভাবে হাতড়ে পোস্ত, গুঁড়ো সরষে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, হিং এবং আরও নানা ধরনের রান্নার মালমশলা যেগুলোকে ও খুব একটা জরুরি বলে মনে করে না, তাদের অবস্থান উল্টেপাল্টে দিয়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মিঠাই, আমার ডেথ উইশের পডগুলো কোথায়?’
শুভ্রনীলের পছন্দ মেশিনের কফি। তাও অতিরিক্ত স্ট্রং। নরম আঙুলের ছোঁয়ায় দুধ চিনি গোলা আদুরে পানীয় কোনওকালেই ওর ভালো লাগে না। হাঁকডাক শুনে পড়ি কি মরি করে ছুটে এল মৌরি মাসি। রান্নাঘরের দরজায় এসেই ফুয়েলের অভাবে অস্থানে ল্যান্ড করতে বাধ্য জেটের মতো গোঁত্তা খেয়ে দাঁড়াল। মৌরি মাসির গায়ে বিস্কুট রঙের নরম ছাপা কাপড়ের ওপর উলের চাদর জড়ানো। শিরা ওঠা সরু সরু হাত দুটো পেটের কাছে জড়ো করা। মাঝারি মাপের নাকের উপর থেকে অবাধ্য চশমাটা বারবার পিছলে যাচ্ছে। ছোট থেকেই শুভ্রকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন এই মৌরি মাসি। তাকে দেখে শুভ্র আরও উত্তেজিত।
‘মিঠাই কোথায়, অ্যাঁ? নির্ঘাত সকাল সকাল গেম নিয়ে বসে গিয়েছে? ডাকো তাকে।’
মৌরি মাসি আমতা আমতা করতে লাগল। রান্নাঘরের মেঝেতে জিরে, নুন, হলুদ আর রক্তবর্ণ টোম্যাটো সসের বর্ণিল আলপনা। শুভ্রর গজগজ অব্যাহত। অভিযোগের এলোপাথাড়ি তির একবার মাসির দিকে তো পরক্ষণেই মিঠাইয়ের দিকে ছুটছে। ঝাড়ু আর ভিজে ন্যাতা হাতে মেঝে পরিষ্কার করতে বসবে মৌরি মাসি, সেই মুহূর্তেই বেশ জোরে কলিংবেল বাজল। দু’বার।
‘নিশ্চয়ই রাজু! কেমন বেআক্কেলের মতো বেল বাজাচ্ছে দেখেছ? জুঁইটার ঘুম ভেঙে যাবে না? হাঁ করে দেখছ কী? সবই তো তোমার প্রশ্রয়ে হয়েছে! চাকরবাকর মালিকের ঘাড়ের ওপর উঠে নাচছে!’
বলেই ঝড়ের গতিতে দরজার দিকে দৌড়ল শুভ্র। রাজু পেপার দিতে আসেনি মাস ছ’য়েক হল! বোবা কান্নায় মৌরি মাসির গলা বুজে এসেছে। আয়নার মতো ঝকঝকে মেঝের ওপর নিঃস্বার্থ স্নেহজাত ক’ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।
দুই
ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা মুখের কাছে তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে শুভ্রনীলের দিকে তাকাল পায়েল। ফ্ল্যাটে পা রাখতেই চোখের ইশারাতে কিছু কথা জানিয়ে দিয়েছে মৌরি মাসি। পায়েল মেয়েটা খুব মিষ্টি। যেমন শান্ত, তেমন বুদ্ধিমতী। মুখে চোখে, হাতে পায়ে, চলনে বলনে সবেতেই লক্ষ্মীশ্রী। শুভ্রনীলের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে হাতে গোনা যে ক’জন এখনও যোগাযোগ রেখেছে, পায়েল তাদেরই একজন। কালো জিন্স আর একটা লং জ্যাকেট পরে এসেছে মেয়েটা। মাথায় উলের টুপি। তার উপরে তুলোর বলের মতো ফুলকো ফুলকো ইয়ার মাফ। পুতুলের মতো লাগছে তাকে। মৌরি মাসি জানে এই মেয়েটা শুভ্রকে বড় ভালোবাসে। পায়েলকে একবার জিজ্ঞেস করতে সে যদিও লজ্জা পেয়ে বলেছিল,
‘তুমি কী যে বলো না মাসি! এক ক্লাসের এক বেঞ্চে বসা বন্ধুদের মধ্যে কি ওসব হয়!’
কিন্তু বুড়ো চোখ তো চট করে ধোঁকা খায় না। যা কিছু দৃশ্যমান তার চেয়েও খানিক বেশিই দেখে বোধহয়।
পায়েলের সামনের সোফায় গরম কফির কাপ হাতে বসেছে শুভ্র। মুখেচোখে প্রবল অস্থির ভাব। বারবার বলছে, ‘এই ঠান্ডায় সকাল সকাল মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল মিঠাই! আমার সঙ্গে একবার আলোচনা করবে না? বাচ্চাকে এইভাবে পড়াশোনার চাপ দেবে ও!’
গল্পটা মৌরি মাসি বলেছে। একটা অজুহাত তো দিতেই হতো! দিল্লিতে এখন মারাত্মক ঠান্ডা। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি রাতেই লাফিয়ে লাফিয়ে তাপমাত্রা নামছে। এ বছর আবার উপরি পাওনা শীতকালীন বৃষ্টি। শিলও পড়েছে দু’-তিনদিন। অনেকক্ষণ থেকে একমনে শুভ্রকে দেখে চলেছে পায়েল। উন্নতি কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। শুভ্র যেন দিনকে দিন অতীতের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে। আসলে একজন মানুষ যদি পারিপার্শ্বিক সত্যিকে স্বীকার করতেই না চায়, জোর করে কেউ কি তাকে সাহায্য করতে পারে?
শুভ্রনীলের ব্যাপারটা নিয়ে গত দু’ বছরে ডক্টর সুরঞ্জন ত্রিপাঠীর সঙ্গে প্রায় পাঁচবার দেখা করেছে পায়েল। ডক্টর ত্রিপাঠী অভিজ্ঞ মানুষ। বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। মানুষটার অসীম ধৈর্য। পেশেন্টদের বন্ধু কিংবা সন্তানের মতো দেখেন। মনোযোগ দিয়ে তাঁদের প্রতিটা কথা শোনেন। কাউন্সেলিংয়ের সময় শুভ্রও খুব হালকা বোধ করে। শুভ্রর মুখ দেখেই পায়েল সেটা বোঝে। তবে ডাক্তারবাবু শুভ্রকে অসুস্থ মানতে একেবারেই নারাজ। তাঁর মতে, আর পাঁচজন মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার মতো এটাও একটা মানসিক অবস্থা মাত্র। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যদিও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও লুকিয়ে চুরিয়ে আলোচনা করে মানুষ। মনের কোনও রোগ হয়েছে শুনলেই চট করে জিভের আগায় চলে আসে পাগল শব্দটা। মিঠাই আর জুঁই চলে যাওয়ার পরেও বিভিন্ন পরিচিত মানুষকে পায়েল বলতে শুনেছিল, শুভ্রনীল? ওর তো মাথাটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে। ব্রাইট ছেলেটা একেবারে শেষ বুঝলি!
ওইসব শুভাকাঙ্ক্ষীর গলা থেকে বেরনো দুঃখের সঙ্গে প্রায় নিঃশব্দেই মিশে গিয়েছিল খানিকটা স্বস্তির সুর। উন্নতির শিখর থেকে সফল মানুষের পতন দেখতে দেখতে হয়তো ওই সুরই বাজে গলায়।
তিন
মিঠাইকে বিয়ে করার খবরটা সবার প্রথম পায়েলকেই জানিয়েছিল শুভ্র। একেবারে ছোটবেলার বন্ধু বলে কথা! শুভ্র আর পায়েলের মা ছিলেন কলেজ জীবনের বন্ধু। বিয়ে, সন্তান সব পেরিয়েও বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন ওঁরা। সেই সূত্রে দুটো বাড়িতে আসা-যাওয়া, ভাব-ভালোবাসা, টুকিটাকি জিনিস আদান-প্রদানের খুব স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে পায়েল যখন আরও পড়বে বলে দিনরাত এক করে বাড়ির লোকজনকে বোঝাচ্ছে, একটা বৃষ্টির রাতে আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে বাবাকে হারিয়ে শুভ্রনীল তখন পারিবারিক ব্যবসাটাকে নিজের সব শক্তি দিয়ে টেনে তোলার পরিকল্পনা করছিল। শুভ্র মাঝে মাঝেই বলত, ‘প্রয়োজনে আমি দেশ ছাড়তেও রাজি বুঝলি পায়েল!’
তার মধ্যেই ওর জীবনে চলে এল মিঠাই। কবে কখন কথা দেওয়া-নেওয়া হল, মনমেজাজ পড়ে নিজেদের সবটুকু বুঝে নিল ওরা, পায়েল জানতেই পারেনি। একদিন দুপুরে স্টিলের টিফিন কৌটো করে প্রিয় মাসিমণির জন্য সাবুদানার পায়েস আর মালপোয়া নিয়ে এসে পায়েল দেখল শুভ্রর মা তাঁর হবু পুত্রবধূর সঙ্গে আলাপ করছেন। শুভ্রদের গোটা ড্রয়িংরুম জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা রঙের প্রজাপতি! শুভ্রর মায়ের কোল ঘেঁষে বসে একরাশ স্নিগ্ধ বসন্ত বাতাসের মতো একটা ফুটফুটে মেয়ে। বয়সে বেশ ছোট। কুড়ি-একুশ হবে। আদুরে, আহ্লাদি। অকারণে হাসতে হাসতে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়া ববকাট চুলের মেয়েটাকে দেখেই পায়েল বুঝেছিল, বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। সেই থেকেই পায়েল আর কোনও কথা মনে পুষে রাখে না।
চার
‘যারা নেই, যারা আর কোনওদিন ফিরবে না, তাদের স্মৃতি আগলে আমার ছেলেটা কোন পথে এগচ্ছে বলতে পারিস?’
‘শুভ্রকে একটু সময় দাও মাসিমণি। ও ঠিক বুঝবে।’
‘দু-দুটো বছর পেরিয়ে গেল পায়েল, এখনও আশা করিস তুই?’
প্রায় দিনই এমন কথোপকথনের শেষে টেলিফোনের দুই প্রান্তে দুই অসম বয়সি নারীর কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস বাষ্পের মতো ঘন হয়ে ওঠে। কথার খেই হারিয়েই তারা একে অপরকে বিদায় জানায়। পায়েলের এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই রাতের কথা। তখনও ভালো করে ঘুমটা ভাঙেনি। শুভ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল, ‘খবরে বলল ড্রিম পয়েন্টের বাসটা... বাসটা নাকি খাদে পড়ে গিয়েছে। মিঠাইকে ফোনে ধরতে পারছি না আমি। তুই একবার দেখ রে!’
কী অসম্ভব যন্ত্রণা, কী ভীষণ উদ্বেগ ছিল শুভ্রর গলায়! খবরটা শুনে পায়েলের পা দুটো থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। চোখের সামনে সবকিছু ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসছিল। এই তো তিনদিন আগেই মিঠাই বলে গেল গ্রীষ্মকালীন শিবির থেকে ফিরেই দেখা করবে। আসছে রবিবার ডিজনির নতুন মুভিটা জুঁইকে দেখাতে নিয়ে যেতেই হবে। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে কাঁপা হাতে টেলিভিশন অন করে দিয়েছিল পায়েল। গোটা দেওয়াল জুড়ে তখন খাদে পড়ে যাওয়া বাসটার খবর। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাচ্ছিল ওরা। রোহিণীর পথেই অঘটন ঘটেছে। পায়েলের চারদিক যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মিঠাইয়ের মা-বাবা, শুভ্রর মা, ঘনিষ্ঠ পরিজনেরা সকলেই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিলেন ক্রমে ক্রমে। কিন্তু পায়েলের চোখের সামনেই একটু একটু করে একটা বুদবুদের ভিতরে টুক করে ঢুকে পড়ল শুভ্র। মনে হওয়া দিয়ে তৈরি জগৎ। এক স্বচ্ছ বলয়। মন যা চায় বলয়বাসী মানুষটি ঠিক তাই দেখে। মন যা গল্প শোনায় তাই শোনে।
পাঁচ
দিল্লির সিটি ড্রিমজ আবাসনের ব্লকগুলোর নাম ভারী সুন্দর। ব্লু কোরাল, বার্ড নেস্ট, রেড ওয়েভ, হানিকোম্ব। শুভ্রর ফ্ল্যাটটা বার্ড নেস্টে। কখনও কখনও জীবন মায়াজালের মতো বিষাদের সুর ছড়িয়ে রাখে সর্বত্র। যতই তুমি সাবধানী হও, হাঁটতে চলতে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বিষাদের স্পর্শ লাগবেই লাগবে। শুভ্রর বাড়িতে এলেই পায়েলের মনে হয়, সে একটা খালি বাসায় ঢুকে পড়েছে। ডানা ভাঙা একটা পুরুষ পাখি খড়কুটোর বাসা আঁকড়ে একলা পড়ে রয়েছে প্রিয় পরিবারের অপেক্ষায়! শুভ্রকে দেখলেই পায়েলের কেমন যেন দিশাহারা লাগে। যে পুরুষের প্রতি ওর অমোঘ টান, যার জন্য ওর সমস্ত ভালোবাসা সযত্নে তুলে রাখা আছে এই চল্লিশেও, সেই পুরুষই যখন ওর সামনে যন্ত্রণায় কাতর হয়, বিলাপ করে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না পায়েল। ওই দুর্ঘটনার পর শুভ্র দিল্লির ফ্ল্যাটে থাকবে শুনে পায়েলও জোর করে চাকরিতে বদলি নিয়ে নিয়েছিল। শুভ্রর মা, পায়েলের নিজের বাবা-মা কি বোঝেন না তার এই টান শুধু বন্ধুত্ব নয়! তার থেকেও অনেকটা বেশি।
মৌরি মাসি আড়ালে নিয়ে গিয়ে জোর করেছে, ‘আজ একবার আলাদা করে কথা বল গো পায়েল দিদি। সারারাত ঘুমোয়নি। দিদিভাইয়ের ছবি হাতে করে ঠায় বসেছিল! আমার মন বলছে ওষুধগুলো কাজ করছে না!’
শুভ্র জেদ ধরে বসেছিল। মিঠাই ফিরলে একটা হেস্তনেস্ত করে তারপর বেরবে। পায়েল শুনল না। খানিকটা জোর করেই শুভ্রনীলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে যখন শুভ্র খুব বেশি অশান্ত হয়ে পড়ে, ঘন ঘন রেগে যায়, গুম মেরে বসে থাকে, মৌরি মাসি চিন্তায় থমথমে হয়ে থাকে, শুভ্রকে বুঝিয়েসুজিয়ে নিয়ে পায়েল হাঁটতে বেরয়। দীর্ঘ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিছু প্রাসঙ্গিক, কিছু অসংলগ্ন ছেঁড়া ছেঁড়া কথা বলে ফেলে শুভ্রনীল। বর্তমানকে ভুলে ফিরে যায় স্কুলের মাঠে, কলেজের গেটে দাঁড়ানো আলুকাবলি, ফুচকার স্টলের সামনে। আরও আরও পিছনের দিনগুলিতে। ছোটবেলায় বড়দিনের ছুটিতে পায়েল আর শুভ্রকে নিয়ে ওদের বাবা মায়েরা চিড়িয়াখানায় যেতেন। আর একটু বড় হতে পায়েল নিজেই চলে আসত শুভ্রর মায়ের হাতের জলপাইয়ের আচার খেতে। সেসব দিনের কথা অনর্গল বলে চলে শুভ্র।
পায়েল জানে না শুভ্রনীল কতখানি বুঝে আর কতখানি না বুঝে অতীত হাতড়ে বেড়ায়। এই মুহূর্তে বলা কথা পরমুহূর্তেই ভুলে যায় কি না তাও আন্দাজ করতে পারে না পায়েল। সে শুধু এটুকু জানে স্মৃতির সরণী বেয়ে শুভ্রনীল যতদূর হেঁটে যাবে, প্রতিবিম্বের মতো সেও পথটা অনুসরণ করবে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবের বাইরে ভালোবাসা মানে আজও তো একটা সিঁড়িভাঙা অঙ্ক, তাই না?
01st November, 2020