সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
—‘মা খুব খিদে পেয়েছে। আগে কিছু খাব। তারপর চা। ফুলিমাসি কি চলে গেছে!’ কিছু খাওয়ার আবদার করলে মা সব থেকে বেশি খুশি হয়। তবে আজ তার সত্যি একটু খিদে পেয়েছে।
—‘নাহ, ফুলি এখনও যায়নি। চিঁড়ের পোলাও করতে বলি!’
—‘সেই ভালো।’ ড্রেস চেঞ্জ করতে অবনী ঘরে ঢুকে গেল।
ঘণ্টাখানেক পর অবনীর কাজ শেষ হল। এতক্ষণ কোনও দিকেই হুঁশ ছিল না। বসার ঘরে মা টিভি দেখছে। কোনও একটা নিউজ চ্যানেল চলছে। মায়ের পাশে চেয়ারে অবনী এসে বসল। আজ বইমেলার শেষ দিন। জন-জোয়ার। অবনী বইমেলায় যাওয়ার সময় পায়নি। তিন-চার বছর হয়ে গেছে মা আর বইমেলায় যায় না। বেশি হাঁটাহাঁটি করতে অসুবিধা হয়। লিটিল ম্যাগাজিনের স্টলে ভিড় উপচে পড়ছে। বড় প্রকাশনার স্টলের সামনে দীর্ঘ লাইন। খুব মনোযোগ দিয়ে অবনী টিভি দেখছে না। তার মনোযোগ মায়ের দিকে। মা কি একটু রোগা হয়ে গেছে? মাকে প্রেশারের ওষুধ খেতে হয়। এছাড়া অন্য কোনও সমস্যা মায়ের নেই। লম্বা চুল পিঠের উপর ছড়ানো। দ্রুত মায়ের চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে। গায়ের ফর্সা রঙের সঙ্গে মানানসই। মায়ের সঙ্গে এবার কথা বলতে হবে। লিটিল ম্যাগাজিনের স্টলে অসংখ্য কবিতার বই। অনেক নতুন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলা সংখ্যা। নামগুলো তার অজানা। কবিতা পড়তে অবনীর ভালো লাগে না। বিশেষ কয়েকজন কবির লেখা ছাড়া। অথচ বাবা কবিতা-পাগল মানুষ ছিলেন। তখনকার অনেক কবি ওঁর বন্ধু ছিলেন। নিয়মিত কবিতা সভায় যাতায়াত ছিল। প্রিয় কবির কবিতার কথা মনে রেখে বাবা তার নাম রেখেছেন অবনী। প্রিয় কবির উদাস মন, ভবঘুরে মন, বাউল মন বাবাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ঘরের প্রতি টান, একইসঙ্গে সব কিছু ছেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আকর্ষণ সেই কবির মধ্যে মিলেমিশে একাকার। সেই কবির কবিতা অনর্গল বলতে পারতেন। কবির মনের সঙ্গে বাবার মনের বোধ হয় কোনও মিল ছিল। বাবা কবিতা লিখতে চেষ্টা করতেন। কিছু কবিতা ছাপাও হয়েছিল। নিজের লেখা কবিতা পড়তে পড়তে বাবা ঘন ঘন মাথা নাড়তেন। মা জিজ্ঞেস করতেন,
—‘কী হয়েছে!’
—‘কিচ্ছু হয়নি বনলতা। আমি পারছি না।’
বনানী না বলে বাবা মাকে বনলতা বলেই ডাকতেন। মা বাবাকে প্রশ্রয় দিতেন। উৎসাহ দিতেন। তাই বোধ হয় বাবার কবিতা লেখা থেমে থাকেনি। কিছু প্রশংসা বাবা পেয়েছিলেন। বাবার বেশ কয়েকটি কবিতা নিয়ে একটা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংকলন গ্রন্থ এখন আর পাওয়া যায় না। কিছু বন্ধুবান্ধব আর নিজেদের বাড়ি ছাড়া। আর দশ দিন পর বাবার মৃত্যুদিন। বাবার ছবিতে মালা পরানো ছাড়া আর কিছুই করা হয় না। অবনী এবার তার ব্যতিক্রম ঘটাবে। বাবার মৃত্যুদিনে তাদের ফ্ল্যাটে সাহিত্যসভার আয়োজন করবে। বাবার কবি-সাহিত্যিক বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। তাদের কারও সঙ্গে অবনীর যোগাযোগ সেভাবে নেই। কেউ কেউ ফোনে খবরাখবর নেন। মা রাজি হলে তাঁদের সঙ্গে অবনী যোগাযোগ করবে।
অবনীর মুখের দিকে অবাক হয়ে বনানী তাকিয়ে রইল। এটা তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। সেই বিস্মিত মুখের চোখের দিকে তাকিয়ে অবনী মায়ের সম্মতি টের পেল। মাকে কোনও কথা বলবার সুযোগ দিল না।
—‘চট করে বাবার বন্ধুদের ফোন নম্বরগুলো দাও। আমি প্রথমে ফোন করব। তারপর তুমি কথা বলবে।’
বুক র্যাক থেকে ফোনের ডায়েরিটা বনানী এগিয়ে দিল। অবনী মায়ের হাতে হালকা কাঁপুনি দেখতে পেল।
শেষ পর্যন্ত পনেরো জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। যাঁরা এক সময় কবিতা লিখেছেন। এখনও লেখেন। ব্যক্তিগতভাবে চেনা-পরিচয় না থাকলেও বাবার লেখা কেউ কেউ পড়েছেন। ওঁরা খুবই উৎসাহিত। শরীর সুস্থ থাকলে সবাই আসবেন বলেছেন। শুক্রবার বাবার মৃত্যুতিথি। সেই দিনটিই স্থির করা হয়েছে। অবনীকে ছুটি নিতে হয়েছে। কোনও সভাকক্ষ ভাড়া করে নয়। ফ্ল্যাটে বসবার ঘরেই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খবরটা অবনী কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়নি। তাই খুব বেশি লোকজন আসবে বলে মনে হয় না। ঘরের কোণে টেবিলে বাবার ছবি রাখা হয়েছে। রজনীগন্ধা নয়। বিভিন্ন রঙের গোলাপ দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। এটা মায়ের ইচ্ছে। বিস্মৃত হলেও মানুষটা তো মনেপ্রাণে এক কবি। তাঁর মনের ভিতর কবিতার জন্ম হয়েছে। খাতা-কলমে হয়তো সেভাবে রূপ দিতে পারেনি। কখনও সে ব্যর্থ। কখনও বা পাঠক অনুধাবনে ব্যর্থ। তাতে তো কবির কাব্যানুরাগ মিথ্যে হয়ে যায় না। শেষ হয়ে যায় না। সাদা রজনীগন্ধার গন্ধ যেন শেষের ইঙ্গিত বয়ে আনে। তাই গোলাপ। বনানীর ভাবনাটা সেইরকম। শেষ পর্যন্ত সবাই না এলেও অনেকেই এলেন। একঘেয়ে স্মৃতিচারণা। বনানীর ভালো লাগছে না। স্বামীর কবিতার আলোচনা সে শুনতে চায়। সে কথা বিশেষ কেউ বলছেন না। টেবিলে রাখা কবিতা সংকলনটি সবাই একবার নেড়েচেড়ে দেখলেন। তাদের সংগ্রহে এই সংকলনটি নেই। পাঠ করলেন নিজেদের লেখা কবিতা। সেগুলো ওঁরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন। অনেক কবিতাই বেশ ভালো। তবু অপেক্ষা। উপস্থিত কেউ হয়তো তার স্বামীর লেখা কোনও একটা কবিতা পাঠ করবেন। একটু দেরি করে এলেন জন্মেজয় রায়।
এ কালের বিখ্যাত এক কবি। অবনীর প্রিয় কবি। ফোনে অনুরোধ করেছিল আসবার জন্য। আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন।
—‘একটু দেরি হয়ে গেল। আপনাদের অসুবিধায় ফেললাম না তো! সকালে অন্য একটা সভায় যেতে হয়েছিল।’ ঈষৎ সংকুচিতভাবে সোফায় এসে বসলেন। মৃত কবির ছবির দিকে একবার তাকিয়ে টেবিল থেকে কাব্যগ্রন্থটি তুলে নিলেন।
—‘ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ তো আমার নেই। তবে ওঁর লেখা কবিতা আমি পড়েছি। তবে এই গ্রন্থটি আমার সংগ্রহে নেই। ওর লেখা একটি কবিতা পড়ে আমার শ্রদ্ধা, প্রণাম জানাচ্ছি।’
চোখ বন্ধ করল বনানী। কানে বেজে চলেছে আবেগভরা কণ্ঠে তাঁরই স্বামীর লেখা কবিতা। এত যে কান্না মনের মধ্যে জমে ছিল সেটা বনানীর জানা ছিল না।