সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, তাঁরা জানেন ‘হাত ঘড়ি’ ও ‘রোদ চশমা’-এ দুটি জিনিসের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ আছে। সংগ্রহের শখও আছে বলা যেতে পারে। তবে এ শখের জন্ম শৈশব বা কৈশোরে নয়, অনেক পরে। সাতের দশকে যাঁদের মফস্সল শহরে শৈশব বা কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে, সে সময় ছেলেবেলাতে হাতে ঘড়ি পরা বা রোদ চশমা চোখে পরার ব্যাপারটাকে ডেঁপোমি হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো। আমার অনেক সহপাঠীদের মতো আমিও প্রথম হাত ঘড়ি পরি ক্লাস টেনের মাঝামাঝি সময়। ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার কাকার কিনে এনে দেওয়া সস্তা দামের ইলেকট্রনিক্স রিস্ট ওয়াচ। ঘড়ি মিলিয়ে টেস্ট পেপার সল্ভ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তবে টেস্ট পরীক্ষা দেবার আগে পর্যন্ত সে ঘড়ি হাতে পরে বাইরে যাবার অনুমতি ছিল না। আর সত্যি কথা বলতে সে সময় ঘড়ি, জুতো-জামার প্রতি আমাদের কোনও আগ্রহও ছিল না। বরং এ সবের থেকে অনেক বেশি আগ্রহের বিষয় ছিল গল্প-কমিক্সের বই, তাপ্পি দেওয়া চামড়ার ফুটবল, শীতকালে ক্রিকেট ব্যাট। বাড়িতে আমার চাকুরিরত বাবা-কাকা-পিসিরা ঘড়ি পরতেন, মা-কাকিমাদের তেমন ঘড়ি পরতে দেখিনি। ভোরবেলাতে ঘুলঘুলির ফাঁক গলে আসা দিনের প্রথম আলো আর শক্ত টিনের পাতে মোড়া টেবিল ঘড়ির কর্কশ ধাতব শব্দ জানিয়ে দিত এবার বিছানা ছাড়তে হবে। বেলা ন’টায় দেওয়াল ঘড়ির শব্দ জানাত এবার বই গুটিয়ে স্নান-খাওয়া সেরে রওনা হতে হবে স্কুলের দিকে। ঠিক যেমন ইস্কুলের শেষ ঘণ্টার শব্দ জানিয়ে দিত বেলা সাড়ে চারটে বাজে। বাড়ির কাছেই স্কুল। বাড়ি ফিরে কোনওরকমে খাবার নাকে মুখে গুজেই সোজা ছুট দেওয়া খেলার মাঠে। হ্যাঁ, সে সময় আমাদের খেলার মাঠ ছিল। সে মাঠে গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফুটবল ছিল, শীতকালে ক্রিকেট। কেউ কেউ ঘুড়িও ওড়াত। মাঠ সংলগ্ন রেল কোয়ার্টারের আউট হাউসের বাসিন্দারা কয়লার আগুন জ্বালাত। সূর্য ডোবার পর তাদের উনুনের ধোঁয়া পেঁজা তুলোর মতো মাঠে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলেই আমরা বুঝতে পারতাম কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে অন্ধকার নামবে, এবার খেলা থামিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। অন্ধকার নামার আগে, বাড়িতে শাঁখ বাজার আগেই স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের বাড়ি ফেরার কঠোর নিয়ম ছিল আমাদের মফস্সলে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে সামান্য টিফিন করে আবার বই নিয়ে পড়তে বসা। যখন মা-পিসিরা খাবারের জন্য ডাক দিতেন, তখন আমরা বুঝতে পারতাম রাত ন’টা বাজে। খাবার পর সোজা বিছানাতে। এ ভাবেই হাত ঘড়ি বিহীন অবস্থাতে অথচ সময় মেনেই ছেলেবেলা, স্কুল জীবন অতিবাহিত হতো আমাদের।
আমার বেশ কিছু সহপাঠী আমাদের পাড়াতেই বসবাস করত। একই পাড়াতে এক সঙ্গেই বেড়ে উঠতাম আমরা। এক সঙ্গে আমরা খেলতাম, স্কুলে টিফিন আর মাস্টারমশাইদের বেতের দাগ ভাগ করে নিতাম, দুর্গাপুজোতে একসঙ্গে দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরতাম। আমার তেমনই এক সহপাঠীর নাম ছিল শঙ্কর এবং তার বাবার নাম ছিল রমাপতি বাবু। বলা বাহুল্য এ ক্ষেত্রে আমি কাল্পনিক নামের আশ্রয় নিলাম। তবে যে ঘটনা বলতে যাচ্ছি তা সত্যি। শঙ্কর ছিল বেশ নিরীহ গোছের ছেলে আর রমাপতি ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাঁর চেহারা ছিল বেশ শক্তপোক্ত ধরনের, মাথায় কদম ছাঁট চুল। ভদ্রলোকের যেমন কুস্তিগীর ধরনের চেহারা, তেমনিই বাজখাই গলা! আমার সহপাঠী শঙ্কর তো বটেই এমনকী তার বাড়ির অন্য সবাইও সব সময় তটস্থ হয়ে থাকত ভদ্রলোকের ভয়ে। উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে রমাপতি অসম্ভব নিয়ম ও সময় মেনে তাঁর জীবন যাত্রা পরিচালনা করতেন। তাঁর বাজখাই গলার সামনে কোনও সময় দাঁড়াতে হলে পা কাঁপত আমাদের। বন্ধু শঙ্করের মুখেই শুনেছিলাম যে, তার বাবার হাতের সোনালি ডায়ালের ঘড়িটা অ্যাংলো সুইস ঘড়ি। সে ঘড়ি আসলে ছিল শঙ্করের প্রয়াত ঠাকুরদা অর্থাৎ রমাপতির পিতৃদেবের সম্পত্তি। ঘড়িটার বয়স নাকি পঞ্চাশ বছর। রমাপতি নিয়মিত দম দিয়ে, প্রয়োজন মতো অয়েলিং করিয়ে চালু রেখেছেন সেই রিস্ট ওয়াচ। ও ঘড়ি স্পর্শ করার অধিকার নেই কারও। আর ওই ঘড়িই নাকি আসলে পরিচালিত করে রাশভারী রমাপতি বাবু ও তাঁর সংসারকে।
আমরা যখন ক্লাস টেনে উঠলাম তখন সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে পড়াশোনার চাপ একটু বেশি হয়ে উঠল ইস্কুল বা বাড়িতে। তখন আমাদের পড়াশোনা প্রধানত স্কুলকেন্দ্রিকই ছিল, প্রাইভেট টিউশনকেন্দ্রিক নয়! কাজেই ক্লাস টেনে ওঠার পর পারত পক্ষে স্কুল কামাই করতাম না আমরা। টেস্ট পরীক্ষার কিছুদিন আগের ঘটনা, হঠাৎই একটানা তিনদিন স্কুলে উপস্থিত হল না শঙ্কর! একই পাড়াতে বাড়ি হলেও রমাপতির সামনে পাছে গিয়ে দাঁড়াতে হয় সেই ভয়ে আমরা শঙ্করের খোঁজও নিতে যেতে পারলাম না। তিনদিন পর শঙ্কর যখন স্কুলে ফিরল তখন তাকে দেখে আমরা সহপাঠীরা তো বটেই, এমন কী মাস্টারমশাইদের অনেকেই শিউরে উঠলেন। শঙ্করের সারা শরীরে কালশিটে দাগ। প্রহারের স্পষ্ট চিহ্ন! ঘটনাটা জানা গেল শঙ্করের কাছেই। সে তার বাবার অবর্তমানে সেই অ্যাংলো সুইস ঘড়িটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল এবং তা করতে গিয়ে কীভাবে যেন ঘড়ির চাবিটা খুলে যায় আর তার ফলশ্রুতি হিসাবে রমাপতি বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছেন শঙ্করকে। তিন দিন জ্বরে পড়েছিল শঙ্কর। তাই সে স্কুলে আসেনি। স্কুলে বা বাড়িতে সে সময় কম-বেশি মার আমরা অনেকেই খেতাম। সে যুগে শাসনের অঙ্গ ছিল এটা। তবে শঙ্করের মতো বীভৎস মার আমরা কাউকে খেতে দেখিনি।
যাই হোক, একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন এসে গেল। আমি বাবার এইচএমটি ঘড়ি পরে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতাম। এক বেঞ্চে আমার আর শঙ্করের সিট। শঙ্করও ঘড়ি পরে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেত। তবে সেটা তার মামার কিনে দেওয়া অন্য একটা ঘড়ি, রমাপতির অ্যাংলো সুইস ঘড়ি নয়। সেদিন অঙ্ক পরীক্ষা। প্রচণ্ড টেনশন সবার মনে। আমার পিসি আমাকে পরীক্ষার ঘরে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পরীক্ষা শুরু হবে। একে একে অন্য অভিভাবকরাও নিজেদের ছেলেদের বসিয়ে হল ত্যাগ করছেন। ঠিক সেই সময় আমি হঠাৎ আঁতকে উঠলাম। আমার মুখ থেকে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল– ‘এমা! আমি ঘড়ি পরে আসিনি!’ রমাপতি তখন আমার পাশে শঙ্করকে বসিয়ে ঘর থেকে বেরতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার আর্তনাদ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার পাণ্ডুর মুখের দিকে। তারপর আমাকে আর শঙ্করকে বিস্মিত করে তাঁর হাতের সেই অ্যাংলো সুইস ঘড়িটা আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ঘাবড়াবে না। মন দিয়ে পরীক্ষা দেবে। প্রয়োজন হলে বাকি পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘড়িটা তোমার কাছে রেখে দিতে পার,’ একথা বলে ঘর ছাড়লেন তিনি। যে ঘড়ির জন্য নিজের ছেলের গায়ে নির্মম ক্ষতচিহ্ন এঁকেছিলেন রমাপতি, সে ঘড়ি হাতে দিয়েই আমি মাধ্যমিকে অঙ্ক পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
বহু দিন হয়ে গেল রমাপতি তাঁর ঘড়ির মায়া কাটিয়ে সেই অনন্তলোকের দিকে যাত্রা করেছেন যেখানে সম্ভবত ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। শঙ্কর আজ একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ। আজকাল অনেক সময় শুনি যে, এই ইঁদুর দৌড়ের যুগে কিছু কিছু অভিভাবকরা নাকি তাঁদের সন্তানদের বলেন যে, পরীক্ষাকেন্দ্রে তাদের সহপাঠীদের পেন-পেন্সিল না দিতে। কারণ, পরীক্ষা মানেই হল অন্যদের পিছনে ফেলার প্রতিযোগিতা। এ কথা শুনলেই আজও মনে পড়ে যায় পরীক্ষা হলের ঘটনাটার কথা। আসলে সে যুগে রমাপতিবাবুর মতো মানুষরা ছিলেন অনেকটা বাজপাখির মতো— নখও ছিল, আবার বিরাট বুকে শক্ত ডানার আড়ালে তাঁরা অন্যকে আশ্রয় দেবার ক্ষমতাও রাখতেন। সহপাঠী শঙ্করের দেহে নির্মম আঘাতের চিহ্ন দেখে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই আমি আজও দেখতে পাই আমার হাতে পরিয়ে দেওয়া রমাপতিবাবুর সোনালি অ্যাংলো সুইস ঘড়ি। অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল