সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
পাটলিপুত্র তখনও আসেনি, কিন্তু কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে পাটলিপুত্র, পাটলিপুত্র। যাতে বাসের আরোহীরা প্রস্তুতি নিতে পারে। আমরা দরজার সামনেই ছিলাম। বাসটা হঠাৎ থামতেই মহারাজ বললেন, নেমে পড়ুন। বাস থেকে নেমে একটু অবাক হলাম। এখানে নামলাম কেন? মহারাজ বোধহয় অনুমান করছিলেন, আমি এই প্রশ্নটা করতে পারি। তিনি বললেন, ‘দশটা বাড়িতে মাধুকরী করব, তাই নামলাম।’ হাইওয়েতে নেমে দেখি প্রায় সব বাড়ি নতুন, সম্ভবত নতুন শহরতলি গড়ে উঠছে। বাড়িগুলো দেখতেও সুন্দর। সকালের নরম রোদে বাড়িগুলোর রং যেন জগতের আনন্দযজ্ঞে যোগ দিয়েছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। মহারাজ আগে আগে হাঁটছেন, হাইওয়ের একদিকে যেমন সুন্দর সুন্দর বাড়ি, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। আরেকটা চোখে পড়ার মতো বিষয়— সুন্দর শহরের উল্টোদিকে হাইওয়ে বরাবর প্রচুর ঝুপড়ি। চারদিক দেখতে দেখতে আমরা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। প্রশান্ত মহারাজ মাধুকরী শুরু করবেন। মহারাজ মুণ্ডিত মস্তক, সাদা পোশাকে অনিন্দ্যকান্তি। আমি নিজেও মাঝে মাঝে ভাবি, ঈশ্বর নিজের পুরুষদের সুন্দর করেন কারণ আমাদের কাছে বার্তা দিতে চান, ‘আমার প্রতিনিধিদের দেখে আমি কত সুন্দর তোমরা অনুভব করার চেষ্টা করতে পার।’ মহারাজ বললেন, ‘ভবতী ভিক্ষাং দেহি।’ দরজা খুলে যিনি বাইরে এলেন, তিনি নবতীপর বৃদ্ধা। আবদার করলেন, ‘ভিক্ষা দেবেন না, ভোজন করাবেন।’ মহারাজ একটু অপ্রস্তুত হয়েছেন। কারণ তিনি মাধুকরী করবেন স্থির করেছেন। দ্বিতীয়ত, পাটলিপুত্রের মঠে আমাদের দুপুরে প্রসাদ পাওয়ার কথা। সেই বৃদ্ধা মা কিছুতেই ভিক্ষা দেবেন না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওঁকে বোঝানোর পর বললেন, সারাটা জীবন আমি দুঃখ পেলাম কেউ আমার কথা শুনল না। তারপর আঁচল থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট সাধুকে দিলেন। তবে তার আগে কথা দিতে হল, এরপর কোনওদিন পাটলিপুত্রে এলে, তাঁর বাড়িতে ভোজন করতে হবে।
দ্বিতীয় বাড়িতে অনেক ডাকাডাকি করলেও কেউ দরজা খোলেনি। তৃতীয় বাড়িতে কুকুর ছিল। কুকুরের নিরবচ্ছিন্ন কর্কশ চিৎকার শুনে বাড়ির মানুষজন বাইরে এল। এরাও খুব আন্তরিক। সৌম্য দর্শন সাধু দুয়ারে ভিক্ষা চাইছেন, এঁরা যেন কৃতার্থ হয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা সিধে গুছিয়ে ফেলেছেন। চাল, ডাল, তরকারির পরিমাণ দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। এত বইবে কে? প্রশান্ত মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর ভিক্ষা গ্রহণ করে বললেন, এটা এখন থাক, যাওয়ার সময়ে নিয়ে যাব।
আমরা পরের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করতেই মহারাজ বললেন, দাদা দশ বাড়ি মাধুকরী করব না। আর দুটো বাড়ি যাব। কারণ সবাই যদি এত দেয়, আমরা নিতে পারব না। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে তিনি হাসলেন, কিছু বললেন না। আমরা আলোচনা করছিলাম ভারতবর্ষে এখনও এমন শহর আছে, যেখানে সাধুকে ভিক্ষা চাইতে হয় না। সন্ত কবীর বলেছেন, মত ঘর তত রাম, অর্থাৎ প্রতি ঘরে রাম আছেন। সাধুদের সঙ্গে মাধুকরী করতে করতে আমার মনে হয়েছে ভারতবর্ষের সব ঘরে মা অন্নপূর্ণা আছেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে সাধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি, মায়েরা সবাই অন্নপূর্ণা। হঠাৎ পাঞ্জাবির কোণায় টান পরতেই দেখি এক শিশুকন্যা আমার জামা ধরে টানছে। খালি পা, জামাটাও পরিষ্কার নয়, পিঠে একটাও বোতাম নেই। প্রায় ঘাড় পর্যন্ত চুল, তাতে যত্ন হয় বলে মনে হয় না। হঠাৎ মনে হল মা অন্নপূর্ণা আসেননি তো? আমি হাঁটু গেড়ে বসে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, কী চাই মা? সে মাথা নেড়ে বলল, কিছু না। মহারাজ ভেবেছেন ও বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারেনি। তাই হাঁটু মুড়ে বসে হিন্দিতে বললেন, মাতাজি , তোমার কী চাই?
মাথা নাড়িয়ে বলল, কিছু চাই না।
ও কথা বলে না? বোবা! পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে ওর হাতে দিই। ও লজেন্সটা পেয়েই বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। আমরা দু’জনে চমকে উঠেছি। আমাদের অনুমান মিথ্যা হয়েছে। ও মূক নয়। বললাম, আরেকটা চাই? ও অপর হাত পাতল। আমি হাতে না দিয়ে মোড়কটা খুলে ওর মুখে দিয়ে দিলাম। হাসিতে মুখটা ভরে উঠল। এক শিশুকন্যা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পরম আনন্দে হাসছে। সূর্যের আলোয় সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা দু’জন অবাক বিস্ময়ে আপাতমলিন সেই শিশুকন্যাকে দেখছিলাম ময়লা উড়ে গিয়ে আসল রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। কতক্ষণ আমরা ওকে দেখছিলাম জানি না। ওর কথাতে সম্বিত ফিরল,আমাদের বাড়ি যাবে না ভিক্ষা করতে?
তোমাদের বাড়ি কোথায়?
ওইদিকে, বলে রাস্তার উল্টোদিক দেখাল।
মহারাজ বললেন, নিশ্চয়ই যাব। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে আর একটা বাড়ি যাব।
আমরা পরের বাড়িটায় গেলাম। বাড়িটায় গিয়ে অবাক হলাম। মনে হল ওরা কারওর জন্য অপেক্ষা করছে। দরজাটা হাট করে খোলা, উঠোনে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার, বাড়ির সব সদস্যই উপস্থিত। দৃশ্য দেখে আমরা ভেবেছি, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে, তাই...। আমরা দরজার কাছে গিয়ে ফিরে আসছিলাম। ভিক্ষা চাওয়া হয়নি।
ওরাই এগিয়ে এলেন, মহারাজ চলে যাচ্ছেন?
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের সব কুশল তো?
হ্যাঁ। হ্যাঁ সব কুশল।
তাহলে...!
আসলে পাশের বাড়িতে দেখে আমরা আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাতেই তিনি বললেন, পাশের বাড়িতে আপনাদের দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ আমরা সাধুসেবা করবই।
কথা বলতে বলতে ওঁদের বাড়িতে ঢুকে চেয়ারে বসেছি। শিশুকন্যাটি ওদের বড়গেটের থামের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল। আমরা বসতে না বসতেই ছাচ হাতে তুলে দিলেন। আমরা দু’জনেই গ্লাস হাতে কন্যার দিকে তাকিয়েছি। সে হাসছে। আমি ইশারায় বললাম খাবি? সে বলল, না।
আমরা মেয়েটির সঙ্গে চললাম তার বাড়ির দিকে। যাওয়ার পথে আগের বাড়ির সিধে নিয়েছি। রাস্তা পার হয়ে একটা ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এটা আমাদের বাড়ি। নিজেই একটা চৌপায়া পেতে দিল। আমরা বসতেই বলল, বসো, ভিক্ষা নিয়ে আসি।
ও ঝুপড়িতে ঢুকতেই ওর মা এলেন। প্রণাম করে আড়ষ্ট হয়ে একপাশে দাঁড়ালেন, আমরা খুব গরিব, ভিক্ষা দেওয়ার মতো আমাদের কাছে কিছু নেই। পাগলি যখন ডেকে এনেছে একটু অপেক্ষা করুন। তিনি ঝুপড়ির ভিতরে চলে গেলেন। আমরা উন্মুক্ত হাওয়ায় বসে আছি। রোদ উঠছে। শিশুকন্যাটির দেখা নেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গিয়েছে। ঝুপড়ির বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোনও উত্তর এল না। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উঠে যাব। তখনই এক আকাশ হাসি নিয়ে উদয় হল শিশুকন্যা, তার হাতে শালপাতায় কিছু একটা আছে। আমাদের সামনে এসে শালপাতাটা মেলে ধরল, মহারাজ খা লো।
শালপাতায় রসে ভর্তি দুটো জিলাবি। মহারাজ দু’হাত পেতে গ্রহণ করলেন। শিশুকন্যাটি পরম তৃপ্তির সঙ্গে হাতে লেগে থাকা রসটা চেটে নিল।মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দাদা...