প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
কফি হাউসের আড্ডা তো সেই কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভিড় জমছে না রেস্তরাঁতেও। বড়ই দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। তবু বাঙালির খাওয়াদাওয়া চলছে নিয়মমাফিক। এই অনিশ্চিত সময়েও বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত রাখতে এগিয়ে এসেছেন মেয়েরা। মেয়েদের জীবন মানেই যে তা ঘোমটার আড়ালে অন্তঃপুরে কেটে যাবে, এমন নিয়ম ভেঙে তো সেই কবেই বেরিয়ে এসেছেন নারীরা। তাঁরা এখন ঘরে বাইরে সমান পারদর্শী। তবু আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা যেন নারীর মজ্জাগত। আর সেই আন্তরিকতাকে পুঁজি করেই অন্দরমহল থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে নব রূপে নারীর ক্ষমতায়ন। নিজের বাড়ির হেঁশেল থেকেই বহু মেয়ে শুরু করেছেন নানা হোম ডেলিভারি বা পপ-আপ রেস্তরাঁর মতো ছোটখাট ব্যবসা।
কাজে লেগে থাকার ইচ্ছা
রন্ধন ব্যবসায় যুক্ত মহিলারা বয়সের তোয়াক্কা করেন না। এই যেমন ষাট বছরে দিব্যি ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন শ্রাবণী মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য কোনওকালেই গৃহবধূ ছিলেন না। চাকরি জীবনে ওবেরয় গ্রুপে কাজ করেছেন। শ্রাবণী জানালেন, রান্নার প্রতি ঝোঁক তাঁর বরাবরের, তবে ভিন্ন ধাঁচের রান্না করার সাহস পেয়েছেন কর্মসূত্রে। রান্নার ব্যবসায় শুধুই স্বাদের দিকে খেয়াল রাখলে চলে না। ওটা মাত্র ৫০%। বাকি ৫০%-র মধ্যে রয়েছে স্টাইলিং ও প্রেজেন্টেশন। অর্থাৎ প্রতিটি আইটেম কীভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, তা দেখতে কেমন হল এবং তার মধ্যে নিজস্বতা কীভাবে বজায় রাখা সম্ভব, এই সবই রন্ধন ব্যবসাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
শ্রাবণীর কথায়, ‘আমার কন্যা তৃণার উৎসাহেই এই ব্যবসাটা শুরু করি। কোভিড ১৯-এর জন্য সারা দেশে যখন লকডাউন ঘোষণা হল, তখন থেকেই রান্না নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতে শুরু করি আমরা মা-মেয়ে। লোকে যদি রেস্তরাঁ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে, তাহলে তাঁদের বাড়িতেই ঘরে তৈরি রেস্তরাঁ স্টাইলের খাবার পৌঁছে দেওয়া হোক না কেন? মেয়ের এই প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরেছিল আমার। সেই থেকেই খাবারের রেসিপি, মেনু ইত্যাদি নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। ভাবলাম, লকডাউনে অবসাদগ্রস্ত না হয়ে পড়ে বরং একটু গঠনমূলক কাজেই সময় কাটানো যাক।’ ভাবনা যেহেতু কন্যার, তাই নামটাও ‘মা’জ সোল কিচেন।’
কিছু চেনা কিছু অচেনা
শ্রাবণীর চেয়ে মধুশ্রী বসুরায়ের ব্যবসার ধরন আবার আলাদা। ফুড ব্লগার মধুশ্রী বললেন, ‘ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম লকডাউনের আগে থেকেই। তবে সেটা ছিল শুধুই এলাকাভিত্তিক। এরপর লকডাউন শুরু হয়ে গেল। ব্যবসাও গুটিয়ে ফেললাম আমি। মন খারাপ করে বসেইছিলাম, এমন সময় উদ্ধার করল সুইগি জিনি। জিনির ওপর ভরসা করে আমিও ব্যবসা ছড়িয়ে দিলাম গোটা শহরে।’ খাওয়াদাওয়া নিয়ে নিজস্ব ব্লগ রয়েছে মধুশ্রীর। তাই বাড়িতে নানারকম রান্না করা তাঁর অভ্যাস। আগে রান্না করে তা পাড়াতেই বন্ধুবান্ধবের মাঝে বিতরণ করতেন। বন্ধুরা খেয়ে প্রশংসা করলে ভীষণ ভালোও লাগত। তারপর এক বন্ধুর প্রস্তাবে পাড়াতেই টুকটাক পার্টি বা জন্মদিন ইত্যাদিতে রান্না ডেলিভারি করতে শুরু করেন তিনি। ক্রমশ তাঁর রান্না বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমন সময় দুঃস্বপ্নের মতো এসে হাজির হল লকডাউন। কলকাতা যেন চোখের নিমেষে অচল হয়ে পড়ল। তাবলে ভেঙে পড়েননি মধুশ্রী। বরং তাঁর মনে হয়েছিল, এই নিরাশার মাঝে লোকের মুখে একটু হাসি ফোটাতে নানারকম রান্না করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিলে কেমন হয়? সেই থেকেই ব্যবসার পরিকল্পনা ছকে ফেলতে শুরু করেন তিনি। বললেন, ‘আমার স্বামী অনিন্দ্যও ভালো রাঁধেন। ওঁর আর আমার রান্না অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। প্রথমে ছোটখাট মেনু দিয়েই শুরু করেছিলাম। এখন তো ছোট-বড় সব রকমের মেনু নিয়েই কাজ করছি।’
মধুশ্রী একটু পরীক্ষামূলক রান্না দিয়েই শুরু করেছিলেন নিজের ব্যবসা। তাঁর হেঁশেলের নাম ফ্যাব কিচেন। শ্রীলঙ্কা, গোয়া, দক্ষিণ এশিয়া ইত্যাদি জায়গা থেকে রেসিপি জোগাড় করে নানা রকম রান্না করতেন তিনি। তারপর দেখলেন লোকে কিন্তু চেনা রান্নাই খুঁজছেন। তাই কষা মাংস, মাছের কচুরি, কাঁচা আম দিয়ে মুরগির ঝোল ইত্যাদি চেনা রান্নার দিকে ঝুঁকলেন তিনিও। তবে তার মধ্যেও একেবারে যে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন না, তা নয়। এই যেমন তাঁর চিকেন কাফরেল, চিকেন মাসামান কারি, শ্রীলঙ্কার চিকেন কারি ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মধুশ্রী জানালেন, খাবারের ব্যাপারে লোকে চেনা পদ খোঁজে ঠিকই, কিন্তু মিষ্টি বা ডেজার্টের বেলায় কিন্তু অচেনার দিকেই ঝোঁক বেশি। তাই তো তাঁর ভিয়েতনামি কফি ফ্ল্যান, ক্যারামেল কাসটার্ড, কোকোনাট জেলি ম্যাংগো ইত্যাদির এত কদর। খাবারের দামের দিক দিয়ে মধুশ্রী খুবই গেরস্ত পোষানো। চিকেনের প্লেট মোটামুটি ১৮০ টাকায় চার পিস, মাটনের প্লেট ৩০০ টাকায় ৩ পিস, পোলাও মোটামুটি ১৫০ টাকা থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে। আর মিষ্টির এক দর, ১৫০ টাকা প্লেট।
সাহায্য, রোজগার এবং
লকডাউনে অনেকের চাকরি চলে গিয়েছে। সেইসব বেকার যুবক-যুবতীর রোজগারের উপায় হয়ে ওঠে ‘কারি ওয়াইজ’। ঘরের হেঁশেলে ভিন্ন স্বাদের পদ তৈরি করেন সগুফতা হানাফি। বললেন, রান্না করতে বরাবরই ভালোবাসতেন। তবে স্বামীর উৎসাহে এই লকডাউনে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছেন। সগুফতা মূলত এশিয়ান খাবার বানান। তার মধ্যে আবার চাইনিজ ও বারমিজ রান্না তাঁর বিশেষত্ব। চিকেন স্পাইডার রোল, প্যান ফ্রায়েড চিলি ফিশ, চিকেন ইন তোবাঞ্জান স্যস, হানি ক্রিসপি চিকেন, চিলি পিপার মাশরুম, বারমিজ চিকেন খাউসে ইত্যাদি সগুফতার কিচেনে বিশেষ জনপ্রিয়। চীনে পদের দাম মোটামুটি ১৩০ টাকা থেকে শুরু। ন’টি পদের একটি চীনে প্ল্যাটার রয়েছে ৯৯৯ টাকায়। বারমিজ খাউসে পাবেন ৪৭৫ টাকায়। এছাড়া বাঙালি মহাভোজ থালিও রয়েছে সগুফতার হেঁশেলে। আর রয়েছে ভিন্ন স্বাদের মোগলাই খাবার। যেমন ফিশ বিরিয়ানি, কোপ্তা বিরিয়ানি ইত্যাদি। ৩ কিমি দূরত্বে ৫০০ টাকার অর্ডারে ফ্রি ডেলিভারি রয়েছে। কিন্তু তার বেশি দূরত্ব হলে ডেলিভারির জন্য ১০০ টাকা ধার্য করেছেন সগুফতা। এই ১০০ টাকা তিনি দিচ্ছেন কারি ওয়াইজের ডেলিভারি বয় ও গার্লদের। সুইগি বা জোম্যাটোর মাধ্যমে খাবার সরবরাহ না করে বরং বেকার যুবক-যুবতীদের দিয়েই সেই কাজ করাচ্ছেন সগুফতা। বিনিময়ে প্রতি ডেলিভারি তারা পাচ্ছে ১০০ টাকা।
রান্নায় চাই নতুন ধরন
শ্রাবণীর মেনুতে আবার চেনা অচেনা মিলিয়েই পাবেন। এই যেমন পর্ক ভিন্দালু রয়েছে, তেমনই আবার রয়েছে শাম্মি কাবাব। তাঁর চিকেন চাপ, চিকেন ভর্তা তো সবাই ভীষণ পছন্দ করছেন। চেনার মাঝেই একটু অচেনাকে ভরে দিতে চান তিনি। বিরিয়ানির বদলে তাই তাঁর হেঁশেলে পাবেন ইয়াখনি পোলাও, চিকেন হোয়াইট পোলাও ইত্যাদি। সাধারণত শুক্রবার থেকে রবিবারের মধ্যেই খাবার ডেলিভারি করেন শ্রাবণী। সপ্তাহের অন্যান্য দিনও যে তাঁর হেঁশেল বন্ধ থাকে তা নয়, তবে অর্ডার দিতে হয় অন্তত ৪৮ ঘণ্টা আগে। আর সপ্তাহের মাঝে ডেলিভারি চাইলে নিজেকে ব্যবস্থা করে নিতে হয়। শ্রাবণীর হাতের স্ন্যাকস খুবই জনপ্রিয়। ডিমের ডেভিল, চিকেন প্যানত্রাস, মায়ের হাতের চিকেন চাপ, চিকেন মিনস কাটলেট ইত্যাদি অনেকইে চেয়ে চিনতে কিনছেন। এছাড়া শ্রাবণীর মেয়ে তৃণা জানালেন, তাঁদের রেডি টু ফ্রাই খাবারও ভীষণ হিট। বেশি মাত্রায় এই ধরনের খাবার অর্ডার দিয়ে তা রেখে রেখে খাচ্ছে লোকে। আর আছে ড্রাই বেকড গুডিজ। যেমন মাফিন, ড্রাই কেক ইত্যাদি।
রান্না দিয়েই শুরু, রান্নায় শেষ
মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল রুনু দুগারের। রান্নার প্রতি আকর্ষণ তাঁর বিয়ের পর থেকেই। ক্রমশ সংসারে জড়িয়ে গেলেন। নিজের কথা ভাবার আর সময় পেলেন না। তারপর ছেলে মেয়ে বড় হয়ে বাইরে চলে গেল পড়তে। রুনুর সংসারে আর মন টেকে না। নিজেকে অকেজো মনে হয় বারবার। সেই থেকেই রান্না নিয়ে ব্যবসা শুরু করার ভাবনা তাঁর। দেখতে দেখতে ব্যবসাটি কুড়ি বছরে পার করেছে। খাঁটি নিরামিষ থালি তৈরি দিয়েই ব্যবসা শুরু করলেন রুনু। রাজস্থানি, পঞ্জাবি, গুজরাতির পাশাপাশি আবার একটু নতুনত্ব আনতে চালু করলেন ইতালিয়ান, কন্টিনেন্টাল থালিও। এছাড়া নানা রকম রান্না মিলেমিশে রয়েছে তাঁর কম্বো থালিতে। থালি যদি না চান, তাহলে কর্ন মশলা, মালাই কোপ্তা, নবরত্ন কোর্মা, পালক পনির ইত্যাদির মতো একক ডিশও চেখে দেখতে পারেন। পাশাপাশি রয়েছে ম্যাকারনি হট পট, ভেজ গ্রাতিন, লাসানিয়া, পাস্তা ইত্যাদিও। দাম মোটামুটি ১০০ টাকা থেকে শুরু। থালি পাবেন ১২০ টাকা থেকে। ভিন্ন ধাঁচের এই রান্নার ব্যবসার নাম তিনি দিলেন গুরমে। নামেই স্পষ্ট এখানে ঘরোয়া মেনুতেও রেস্তরাঁর কায়দা সম্ভব।
রান্না থেকে রোজগার
‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’-কে কেন্দ্র করে যাঁদের জীবন অতিবাহিত হত বলে ব্যঙ্গ করত সমাজ, তাঁরা নিজেদের সেই অতিপরিচিত রান্নাবান্নাকে কাজে লাগিয়ে রোজগেরে তো হয়েছেন বটেই, অন্যের মুখে হাসির ঝিলিক আর মনে স্বস্তির স্বাদও এনেছেন নিমেষে। প্রথম প্রথম কিছুটা নিজেকে কাজের মধ্যে রাখা অথবা নিজের পারদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে রোজগারের উপায় খোঁজার তাগিদ থাকলেও পরবর্তীকালে সেই কাজেই পেশাদারিত্ব নিয়ে এসেছেন মহিলারা।