প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
জুলির মতো অনেক মেয়েরই ‘অন্যরকম’ পেশা নির্বাচনের স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, কারণ আমাদের সমাজের মেয়েদের স্বপ্নের গণ্ডিটাও নেহাত সীমিত। একটু গভীরে ভাবলে দেখা যায়, পেশার জগতে আমরা ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে যে বিভাজন করি সেটা নেহাতই অবান্তর এবং পিতৃতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন। নারী, পুরুষ অথবা রূপান্তরকামী মানুষের দক্ষতা এবং পেশার সঙ্গে তার লিঙ্গ পরিচিতির কোনও যোগ নেই। কোন কাজ কে ভালো পারবে, তা নির্ভর করে কাজের প্রতি ব্যক্তির আগ্রহ, জীবনের পরিস্থিতি ও সুযোগের ওপর।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সাধারণত আমাদের সমাজ মেয়েদের আংশিক সময়ের কাজে অথবা বাড়ির কাছাকাছি কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। যেসব কাজে বাড়ির বাইরে বেশি সময় কাটাতে অথবা রাস্তায় ঘুরতে হয়, আমাদের সমাজ সেইসব কাজকে মেয়েদের ‘আদর্শ’ কাজ বলে না। মেয়েদের যোগ্যতার তুলনায় রোজগার খানিক কম হলেও ক্ষতি নেই, যদি মেয়েরা বেশি সময় বাড়িতে থাকতে পারেন। এই ধরনের চিন্তার সঙ্গে কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার সম্পর্ক সচরাচর থাকে না। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারেও মেয়েদের রাস্তায় ঘুরে কাজে আপত্তি দেখা যায়। বলা হয়, মেয়েরা পথেঘাটে নিরাপদ নয়। অথচ বাস্তবে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনের প্রথম যৌন অত্যাচারের অভিজ্ঞতা পরিবারের চৌহদ্দির মধ্যে ঘটে এবং আজও ভারতে প্রতি তিনজনে একজন মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।
আসলে পথেঘাটের জুজু দেখিয়ে মেয়েদের সব ধরনের পেশা থেকে বিরত রাখার একটা লাভ-লোকসানের দিক আছে। মেয়েরা অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে, ঘরের কাজের ঝক্কি সামলাবে কে? সংসার সকলের অথচ সংসারের বেগার শ্রমের দায় মেয়েদের, এই পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্যের কারণে মেয়েদের পেশার ধরন, স্থান, সময় এবং শ্রমশক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখে পরিবার। পরিবারের এই নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রও ঘৃতাহুতি দেয়। কারণ, নারী পুরুষ যদি সমানভাবে অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণ করে, তাহলে বাচ্চা এবং বুড়ো মানুষদের দেখাশোনার জন্য যে সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, ক্রেশ ইত্যাদির জন্য যে সম্পদ খরচ করতে হবে, তা বিনা পয়সায় মেয়েদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে হয়ে যায়। সেইজন্যই দেশের কর্মীবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমশ কমলেও (২০০৬-এ ৩৭% থেকে ২০১৯-এ ১৮%-এ এসে ঠেকেছে) মেয়েদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বৃত্তটিকে বাড়ানোর কোনও চেষ্টাই নেই রাষ্ট্রের। ভারত রাষ্ট্র আজও মনে করে মেয়েদের পেশা মানেই টেলারিং কিংবা বিউটিশিয়ান, খুব বেশি হলে কম্পিউটার ট্রেনিং।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পরিবার থেকে রাষ্ট্র, কেউই মেয়েদের কখনও জিজ্ঞেস করে না, তাঁরা কী কাজ চান? পিতৃতন্ত্রের পোষা তোতাটির মতো মেয়েদের দক্ষতা অর্জনের পরিকল্পনায় আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকরা বাঁধাধরা গতের বাইরে ভাবেন না। তাদের চিন্তার দৈন্যের কারণে মেয়েদের দক্ষতার পরিসর এবং পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সম্প্রতি সখা কনসাল্টিং উইংগস-এর উদ্যোগে ভারতবর্ষের চারটি শহর, দিল্লি, জয়পুর,কলকাতা এবং ইন্দোরের পেশাদার মেয়ে ড্রাইভারদের অধিকার বিষয়ে একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারাভিযান এবং সমীক্ষা চালানো হয়। সেই সমীক্ষায় তিনজনের মধ্যে একজন মেয়ে ড্রাইভার বলেছেন, এই পেশায় এসেছেন, কারণ তাঁরা দুনিয়াকে দেখাতে চান যে মেয়েরা সব পেশারই উপযুক্ত, প্রতি সাতজনে একজন বলেছেন, তাঁরা জীবনে চ্যালেঞ্জিং পেশা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ মেয়েদের নিজেদের হাতে যদি দক্ষতা অর্জন এবং পেশা পছন্দের অধিকার থাকত, তাহলে এই লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁরা অনেক বেশি রোজগার করতেন, কর্মীবাহিনীতে বেশি অংশগ্রহণ করতে পারতেন, দেশের অর্থনীতিতে মূল কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু সে অধিকার মেয়েদের হাতে নেই। সেই অধিকার তাঁদের হাতে আছে, যাঁরা মেয়েদের শুধুমাত্র ভালো স্ত্রী অথবা মা হিসেবেই দেখতে চান, কর্মী নারী হিসেবে নয়।