প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
বিশ্বে সব থেকে কম সময়ে, ভূমিষ্ঠ হয়েছিল মাম্পসের ভ্যাকসিন। ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ থেকে ফেজ-থ্রি ট্রায়ালের গাঁট পেরিয়ে এফডিএ-র অনুমোদন পেয়ে, ১৯৬৭ সালে, মাত্র চার বছরে ভ্যাকসিনটি দিনের আলো দেখেছিল। কোভিড মাত্র আট মাসের ফোকলা শিশু। তাড়াহুড়ো করে নামকা ওয়াস্তে ট্রায়ালের পর ভ্যাকসিন বাজারে এনে মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে তা নির্বিচারে দেওয়া শুরু হলে কোনও অভাবিত বিপদের সম্মুখীন মানবসভ্যতাকে হতে হবে না তো? ভয়াবহতায় যা কোভিডকেও হার মানাবে! এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ, ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি, নিউ জার্সির ‘ফোর্ট ডিক্সে’একটি সেনা ছাউনিতে শ’-খানেক সৈন্য ‘এইচ-ওয়ান এন-ওয়ান’ বা ‘সোয়াইন ফ্লু’তে বেমক্কা সংক্রামিত হলেন। ১৯১৮-র সোয়াইন ফ্লু মহামারীর স্মৃতি তখনও ঝাপসা হয়নি। পাঁচ কোটি লোক মারা গিয়েছিল ১৯১৮-র সোয়াইন ফ্লুতে। কিন্তু ১৯১৮-র সোয়াইন ফ্লুর দাপটের সিকিভাগও ১৯৭৬-তে অবশিষ্ট ছিল না। অবশিষ্ট ছিল ১৯ মাস আগে ছেড়ে যাওয়া রিচার্ড নিক্সনের গদির প্রলোভন। নির্বাচনে জিতলেই হোয়াইট হাউসের চার বছরের রাজ্যপাট নিশ্চিত ছিল জেরাল্ড ফোর্ডের।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অবাধ মিউটেশনের চরিত্রহীনতার বহর দেখে তখন ‘হু’ বছরে দু’বার ভ্যাকসিন তৈরির ফরমায়েশ করত। দরদি প্রেসিডেন্ট, জেরাল্ড ফোর্ডের জনগণের দুর্দশায় চোখের জলের বাঁধ মানল না। ‘হু’-কে বাধ্য করে তড়িঘড়ি ভ্যাকসিনের বরাত দেওয়া হল। মিলল না নিয়মমাফিক ট্রায়ালের ফুরসত। সমাজের কেষ্টবিষ্টু থেকে সাধারণ মানুষ লাইন লাগিয়ে ভ্যাকসিন নিতে শুরু করলেন। একটি মানুষের প্রাণও যাতে না যায় তার জন্য রাতারাতি মার্কিন কংগ্রেস ১৩.৫ কোটি ডলার বরাদ্দ করল। শুরু হল গণটিকাকরণ। ওভাল অফিসে আস্তিন গুটিয়ে ক্যামেরার অজস্র ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানির মধ্যে জেরাল্ড ফোর্ডও বসে পড়লেন টিকা নিতে। ভ্যাকসিন পর্ব সমাধা হতে না-হতেই ৪৫০ জন ভ্যাকসিন-গ্রহীতা ‘গ্যুলেন-বেরি সিনড্রোমে’ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। মারা পড়লেন তিরিশেরও বেশি মানুষ। টিকা নেওয়ার বহু বছর পরেও অসংখ্য মানুষ কালাত্মক ‘গ্যুলেন-বেরি সিনড্রোমে’ আক্রান্ত হয়ে চিরকালের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। জনগণের জন্য দরদের পরাকাষ্ঠা, না কি রাজনীতির চাল, না কি চটজলদি জনপ্রিয়তার অমোঘ হাতছানি—কোন অছিলায় অবৈজ্ঞানিক ব্যর্থ টিকার হোমানলে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হল অসংখ্য অসহায় মানুষকে? সে-যাত্রায় সোয়াইন ফ্লু-র ভ্যাকসিনে আমেরিকার দোসর হয়নি কোনও দেশই। ফলে, বরাতজোরে তারা বেঁচে গিয়েছিল। ফোর্ট ডিক্সেও একটি ব্যতীত মৃত্যু হয়নি আর কোনও সৈনিকের। ট্রাম্পের সঙ্গে বা মোদিজির সঙ্গে কিঞ্চিৎ মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি জেরাল্ড ফোর্ডের? নভেম্বরে আমেরিকার নির্বাচন, আগামী বছরে পশ্চিমবঙ্গে ভোট। নির্বাচনে ভরাডুবির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তুরুপের তাস হতেই পারে ভ্যাকসিন! দু’-দশ কোটি লোকের ফাঁকতালে মহাপ্রয়াণেই-বা তাতে কী ক্ষতি?
কোভিডের নেই কোনও ওষুধ, ভাবিজি পাঁপড় বা ‘সংশামনি বটিকা’ বা গোমূত্র ছাড়া নেই কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি। সাধারণ মানুষের কাছে উত্তাল করোনা-সমুদ্রে ভাসার খড়কুটো ভ্যাকসিনের দুরাশা। গুটিবসন্ত, প্লেগ, হাম, পোলিও বাগ মেনেছে ভ্যাকসিনে। সবগুলিই করোনার তুলনায় বহুগুণ ভয়াবহ। ‘নিউট্রালিজিং অ্যান্টিবডি’ বা ‘নিউট’ মারফত ভ্যাকসিন ইমিউনিটি জোগায়। ‘ল্যানসেটে’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট কোভিডের ক্ষেত্রে যে ক’টি ভ্যাকসিন ফেজ-থ্রি ট্রায়ালে কিঞ্চিৎ আশার আলো জ্বালিয়েছে তারা কেউই ৩০ শতাংশের বেশি ‘নিউট’ তৈরি করতে পারছে না। ৩০ শতাংশ নিউটে কাজের কাজ অর্থাৎ ‘হার্ড ইমিউনিটির’ পরিবর্তে হতেই পারে ‘ভ্যাকসিন এনহান্সমেন্ট’ বা ‘অ্যান্টিবডিডিপেনডেন্ট এনহান্সমেন্ট’। ফিলিপিন্সে ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন ‘ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার’ ভ্যাকসিন এনহান্সমেন্টে ৬০০ নিষ্পাপ শিশু-সহ হাজার জনেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে জাতীয় স্তরে পরিকল্পনামাফিক শিশুদের টিকাকরণ শুরু হয়েছিল ফিলিপিন্সে। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর এমন তেড়েফুঁড়ে ডেঙ্গু ফিরে এল যে কোনও চিকিৎসাতেই মারণ ডেঙ্গু আটকানো গেল না। কোভিডের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে ঘটবে না তা হলফ করে বলা মুশকিল।
গুটিবসন্ত, প্লেগ, হাম, পোলিও, টিবি, এডস, কোভিডের সঙ্গে লড়ার ক্ষেত্রে শরীরের স্বাভাবিক সহজাত ‘ইনেট ইমিউনিটি’র সঙ্গে প্রয়োজন ‘অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি’র জোশ। ভ্যাকসিন সচরাচর ‘টি সেল’ মারফত বাইরে থেকে ঠেকান দেয় সেই ‘অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি’কে। ভ্যাকসিন ‘টি সেল’ মারফত যে ধরনের সুরক্ষা প্রদানে অভ্যস্ত কোভিডের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনুপস্থিত। থোরাসিক লিম্ফ নোড বা প্লীহার, জার্মিনাল সেন্টার, ‘টিএনএফ-আলফা’র দু’কুল ভাসানো প্লাবনে চিরাচরিত ‘টি সেল’ তৈরিই করতে পারছে না। অথচ ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন’ বা ‘এস-আরবিডি’তে ৮৬% ও ভাইরাসটির ‘নিউক্লিয় ক্যাপসিড’ বা ‘এন-প্রোটিনে’ তৈরি হচ্ছে ৭৪% ‘নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি’। আবার নভেল করোনার পিসি-মাসি বা ‘কমন কোল্ড করোনা ভাইরাসদের’ দৌরাত্ম্যে গা-সওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার সৌজন্যেই ‘সিডিফোর’ ও ‘সিডিএইট প্লাস’ টি সেলের বিরাট এক সাঁজোয়া বাহিনী শরীরের সমরাঙ্গণে আগে থেকেই প্রস্তুত রয়েছে। নভেল করোনাকে পরাভূত করার পক্ষে তাও যথেষ্ট কার্যকর। ভ্যাকসিন মারফত পরিচিত ‘টি সেলের’ অ্যান্টিবডি মিলছে না বলে হা-হুতাশ করা নির্বুদ্ধিতা। ভ্যাকসিনের অভাবে হাজারো অপরিচিত অ্যান্টিবডিকে সম্মুখসমরে নামিয়ে শরীর অক্লেশে করোনার মোকাবিলা করছে। ভ্যাকসিনের ‘ছদ্ম নিরাপত্তায়’ না-ভুলে মাস্ক পরে, অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোভিডকে কিন্তু সহজেই পরাস্ত করা যায়।
লেখক লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন -এর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মতামত ব্যক্তিগত