প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
কথায় আছে, মুখের কথা আর হাতের ঢিল ছোঁড়ার আগে সাতবার ভাবতে হয়। একবার তা বেরিয়ে গেলে ফেরানো যায় না। তার রেশ থেকে যায় মৃত্যুর পরেও। সেই নজির এরাজ্যে প্রচুর। বাম জমানার শেষলগ্নে সিপিএম নেতা অনিল বসু আরামবাগের একটি জনসভায় কর্মীদের চাঙ্গা করতে গিয়ে সেই ভুলটাই করেছিলেন। কর্মীদের হাততালি পেয়েছিলেন, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল জনগণ। লোকসভা আসনে অনিল বসুর রেকর্ড ভোটে জেতার কথা হয়তো মানুষ ভুলে যাবে, ভুলবে না তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে করা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় ‘লাইফ হেল’ করে দেওয়ার হুঙ্কার ছেড়েছিলেন সিপিএমের বিনয় কোঙার। সমাজসেবী মেধা পাটেকর নন্দীগ্রামে যাবেন শুনে বিনয়বাবু বলেছিলেন, ‘নন্দীগ্রামের মেয়েরা মেধা পাটেকরকে পাছা দেখাবে।’ তাঁর কথায় ছিল উস্কানি। কৃষক আন্দোলনের সামনের সারিতে
ছিলেন বিনয় কোঙার। ভাগচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর লড়াইয়ের গৌরব ম্লান করে দিয়েছে তাঁরই কুকথা। তবে অনিল বসু বা বিনয় কোঙার নন, প্রমোদ দাশগুপ্তকেই এরাজ্যে কুকথার স্রষ্টা বলে অনেকে মনে করেন। যুক্তফ্রন্টের আমলে নকশাল আন্দোলন দমনে ব্যর্থ পুলিসকে কটাক্ষ করতে
গিয়ে তিনি অত্যন্ত কুৎসিত মন্তব্য করেছিলেন। পুলিসের গুলিতে নকশালদের না মরার পিছনে
এমন কথা বলেছিলেন, যা মনে পড়লে এখনও বহু কমরেড লজ্জায় মুখ লুকান।
এরাজ্যের মানুষের কাছে যাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল নায়ক হিসেবে, তাঁর নাম তাপস পাল। সিনেমাপাগল লক্ষ লক্ষ মা-বোনের চোখে তিনি ছিলেন ‘হিরো’। একের পর এক হিট সিমেনা উপহার দিয়েছিলেন। সেই ইমেজের জোরেই তিনি বিধানসভা ও লোকসভার কঠিন আসনেও অনায়াসেই জয় হাসিল করেছিলেন। সেই তাপস পাল সিপিএমকে আক্রমণ করতে গিয়ে হারিয়ে ছিলেন ভাষার উপর নিয়ন্ত্রণ। তাঁর সেই কুৎসিত মন্তব্যের জন্যই তিনি নায়ক থেকে হয়ে গিয়েছিলেন ‘খলনায়ক’। রিলের হিরো আর রিয়েল নায়কের সংলাপ যে এক হয় না, সেটা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। তাই যাঁর মহাপ্রস্থানের দিনে বাংলার মা-বোনেদের চোখের জলে বান ডাকার কথা ছিল, সেই তাপস পাল ইহলোক ছেড়েছিলেন নীরবে।
প্রতিবাদ হিংসার পথ নিলে দিকভ্রষ্ট হয় আন্দোলন। তখন লক্ষ্যকে ছাপিয়ে বড় হয়ে যায় উপলক্ষ। একথা প্রমাণ হয়েছে বারে বারে। সাফল্যের কোনও শর্টকাট রুট নেই। সাফল্য আসে ধারাবাহিকতার হাত ধরে। ধারাবাহিক ও সংযত আন্দোলনেই পূরণ হয় উদ্দেশ্য। অবিরাম বৃষ্টিধারা মাটির একটার পর একটা স্তর ভেদ করে ধীরে ধীরে পৌঁছয় গভীরে। পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জলাধার। সেই বিশুদ্ধ জলই মানুষের জীবন বাঁচায়। আন্দোলনও তেমনই। ধারাবাহিক আন্দোলন মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নেয়। সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভরসা জোগায়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্মলগ্ন থেকেই লড়াইয়ের পথ নিয়েছিল দ্বন্দ্ব। সহিংস, না অহিংস? মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর অহিংস পথকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ছিলেন লালা লাজপত রায়, বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পালরা। তাঁদের আস্থা ছিল চরমপন্থায়। ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বাঘা যতীন, প্রফুল্ল চাকি, বিনয়-বাদল-দীনেশ। ভারতবাসীর ‘নয়নের মণি’ সুভাষচন্দ্র বসুও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এঁরা সকলেই আমাদের প্রণম্য। তবুও স্বাধীন ভারত গান্ধীজিকেই ‘জাতির জনক’-এর সম্মান দিয়েছে। কারণ তাঁর অহিংস নীতি। ভারত শান্তির পূজারি।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে ভবিষ্যতের পথ মসৃণ হয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের ছাপ বিন্দুমাত্র নেই। রাজনীতিতে কদর্য ভাষার প্রয়োগ দেউলিয়াপনার লক্ষণ। উস্কানিমূলক ভাষণ ও ব্যক্তি আক্রমণে স্তাবকদের হাততালি পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণ
মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ রাজনীতির চাওয়া-পাওয়ার বাইরে অসংখ্য মানুষ আছেন, যাঁরা শান্তি ছাড়া আর কিছুই চান না।
বড় হওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি। অন্যকে ছোট করে বড় হওয়ার চেষ্টা ভুল এবং বিপজ্জনক। কিন্তু রাজনীতিতে দিন দিন সেটাই জনপ্রিয় হচ্ছে। সমালোচনা করলেই হেনস্তার চেষ্টা। কম বেশি সব দলেই। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঙালি গর্ববোধ করে। বিজেপির সমালোচনা করায় অভিজিৎ বিনায়কের কৃতিত্বকে ছোট করার চেষ্টা চলে। বলা হল, ‘বিদেশিনীকে বিয়ে করেছেন বলেই তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।’ যুক্তি ও তর্কের ভাঁড়ার শূন্য হলে কদর্ষ ভাষাই নির্গত হয়।
২০১১ সালে ভোটের আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই।’ কারণ তিনি বুঝেছিলেন, সিপিএমের ৩৪ বছরের রাজত্বের অন্যায় ও অত্যাচারের বদলা নিতে গেলে গঙ্গার জল লাল হয়ে যাবে। তাই বঙ্গ রাজনীতির পালা বদলের পর তাঁরই নির্দেশে রাজ্যজুড়ে বেজেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত।
দিলীপবাবু বদলা নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। বহুবার তিনি প্রকাশ্যে তা ঘোষণা করেছেন। অনেকে মনে করেন, দিলীপবাবুর লক্ষ্য ছিল, এরাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি আদায়। সিপিএমের হতাশাগ্রস্ত কর্মীদের কাছে টানতেই তিনি বদলার কথা বলেছিলেন। তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল।
এবার তাঁর লক্ষ্য রাজ্যের ক্ষমতা দখল। তাই বিরোধী নেতা থেকে শাসক হওয়ার ‘ইমেজ বিল্ডিং’ই তাঁর সামনে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তার জন্য দরকার ভাষার সংযম। কিন্তু সেই রাস্তায় তিনি হাঁটতে নারাজ। হয়তো চাইলেও পারছেন না। কারণ দলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই তিনি আক্রমণের ধার দিন দিন বাড়াচ্ছেন। তৃণমূলের পাশাপাশি আক্রমণ করছেন পুলিসকেও। হয়তো ভাবছেন, পুলিসকে চাপে রাখতে না পারলে ‘গেম’ বের করা কঠিন। তাই পুলিস-পরিবারের মধ্যে ভয়টা চালান করে দিতে চাইছেন। সেই কারণেই পুলিসের সন্তানদের পড়া বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি।
গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে কানপুরওয়ালের এনকাউন্টারকে আগেই সমর্থন করেছিলেন দিলীপবাবু। এবার তাঁকেও ছাপিয়ে গেলেন তাঁর দলের সহ সভাপতি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুব্রত মণ্ডল ও মন্ত্রী স্বপন দেবনাথকে ‘ক্রিমিনাল’ আখ্যা দিয়ে এনকাউন্টার করার হুমকি দিয়েছেন রাজুবাবু। তাঁর সেই কথায় প্রচুর হাততালি পড়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। অনিল বসুও হাততালি পেয়েছিলেন। তাপস পালও পেয়েছিলেন। কিন্তু, সেই হাততালি কেড়ে নিয়েছিল তাঁদের সারা জীবনের সুনাম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন দল গঠনের এক বছরের মধ্যেই সিপিএমের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিলেন। সিপিএমের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ, ছোট আঙারিয়ার নৃশংস গণহত্যার মতো ঘটনায় বামেদের নেগেটিভ ভোট দিন দিন বাড়ছিল। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য মমতাকে প্রায় এক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তাঁর আপসহীন লড়াই-ই তাঁকে এক নম্বর বিরোধী নেত্রীর মর্যাদা দিলেও প্রশাসক হিসেবে তখনও তিনি পরীক্ষিত হননি। তাই মানুষ ভরসা করতে পারেনি। মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিপুল সাফল্য ও বাংলায় রেলের প্রভূত উন্নয়ন তাঁকে প্রশাসকের সেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। মানুষ বুঝেছিল, দায়িত্ব দিলে তিনি কাজ করতে পাবরেন। মানুষের সেই ভরসা ও বিশ্বাস তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে।
ইতিহাস শুধু কিছু অতীত ঘটনার সাক্ষীই নয়, শিক্ষাও দেয়। কী করা উচিত, আর কোনটা এড়িয়ে চলা দরকার, ইতিহাস সেই শিক্ষাও দেয়। তাই অনিল বসু, বিনয় কোঙার, তাপস পালরা হয়ে উঠেছেন রাজনীতির শিক্ষণীয় চরিত্র। তাঁরাই শিখিয়ে গিয়েছেন, কুকথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে স্তাবকদের হাততালি পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষ সরে দূরে। অনেক দূরে...।