প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
‘মা বুঝি চইলাছে কোয়ারেন্টিনে...’ বরেণ্য লোকগীতি শিল্পী অমর পাল জীবিত থাকলে বুঝি এমনটাই গাইতেন। যদিও তিনি গেয়েছিলেন, ‘মা বুঝি কৈলাসে চইলাছে...’
মহালয়া থেকে সপ্তমী, দিন পঁয়ত্রিশের এই ব্যবধান পাল্টে দিল এমন একটি গানের লাইন। আসলে মানুষের মুখে মুখে এখন যে ফিরছে এই কথাটি। হয়তো বা আপনারাও শুনে থাকবেন। শুনে নেওয়া যাক কি বলছেন এই মানুষেরা, ‘কৈলাস থেকে সমতল। দূরত্ব তো কম নয়। মাকে তাই থাকতে হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টিনে। সুতরাং দিন সাতেকের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ গুণে। অর্থাৎ ৩৫ দিনে। তাঁরা এও বলছেন মানুষের ক্ষেত্রে হোম কোয়ারেন্টিন চৌদ্দ দিনের হলেও মায়ের বেলায় তা হবে আড়াই চৌদ্দ-র। অর্থাৎ গুণে গুণে পঁয়ত্রিশ। দীর্ঘ পথ। ছানা পোনা বাবা সহ মা-র এই আসা। সেটাও একটা কারণ এই দিন বৃদ্ধির।’ এমন একটা ব্যাখ্যা তাঁরা দিচ্ছেন।
এদিকে নীলিমা মাসি মানে নীলিমা চট্টোপাধ্যায় দুঁদে ব্যারিস্টার মন্মথনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী। রীতিমত হুমকির স্বরে মোবাইলে আমাকে সতর্ক করে দিলেন। আপনারা কি শুনবেন সেই সতর্কবাণী? বলছি তবে শুনুন।
‘বলি ভেবেছিসটা কী? দুটো শাস্ত্র পড়েছিস বলে যা ইচ্ছে তাই করবি? মহালয়ার পরের দিনই দেবীপক্ষ। আজও আমার শ্বশুরবাড়িতে মায়ের প্রতিপদের ঘট বসে তা কিনা বসবে এ্যাদ্দিন বাদে? সামনে পেলে আমি এই হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতাম। এইভাবে পাঁজি কেউ লেখে? সতর্ক করে দিলাম এমনটা আর যেন না দেখি!’ অথচ বিশ্বাস করুন নীলিমা মাসির আমি অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। সেই মাসি কিনা আজ আমায় এই ভাষায় কথা বলল? সামনে পেলে তিনিই হয়তো-বা আমার ধড় থেকে গর্দানটা নামিয়ে দিতেন।
এই তো সেদিন প্রাতঃভ্রমণে দেখা হল মিত্তির বাড়ির প্রদোষদার সঙ্গে। রোজকার মত। অন্যদিন যে যার মত আসি-যাই হেদুয়া পার্কে। কথা বড় একটা হয় না সকালটা সকলেরই ব্যস্ততার মধ্যে কাটে তাও মুচকি হাসিটা থাকে। আর বড়জোর, করোনা আবহে কেমন কাটছে ভাই। ব্যস, এই পর্যন্ত।
সেদিনটা ছিল রথের আগের দিন। রথের দিন মিত্তিরবাড়ির রথের সঙ্গে মা দুর্গার কাঠামো পুজোও হয়। তিন মহলা এই মিত্তিরবাড়িতে কি না হয়! দোল থেকে দুর্গোৎসব সবই বেশ মহা আড়ম্বড়ে হত এক কালে আজ কিন্তু নামেই তাল পুকুর কিন্তু ঘটি ডোবে না। শরীকি মামলায় বিপর্যস্ত এই মিত্তির বাড়ির মানুষগুলো জমি জায়গা টাকাপয়সা সঞ্চিত যা কিছু সবই প্রায় খুইয়ে বসেছে। তবু পোর্ট ট্রাস্ট থেকে অবসর নেওয়া প্রদোষদা টিকিয়ে রেখেছে ধর্মীয় কৃত্য গুলো। নমো নমো করে হলেও। পায়ে পায়ে ডেকে নিলেন একান্তে। একটি বেঞ্চিতে। একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘আর বোধয় টিকিয়ে রাখতে পারলুম না পরিবারের দুর্গাপুজো।’ আমি বললাম, ‘কী এমন হল প্রদোষদা?’ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে প্রদোষদা বললেন, ‘স্রেফ তোমাদের জন্য।’ প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, ‘একটু পরিষ্কার করে বলবেন?’
‘পরিষ্কার করার কী আর আছে? জানোই তো আমাদের পনেরো দিনের দুর্গা পুজো। কৃষ্ণা নবমীতে বোধন বসে চলে মহানবমী পর্যন্ত। এতেই হিমশিম খাচ্ছি। দুম করে এবার তা হয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ দিনের?’ আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম, ‘এও কি আমরা করছি?’
‘পঞ্জিকায় বসে আছ দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে। আর খামখেয়ালিপনা করে যাচ্ছ একটার পর একটা?’ অগ্নিশর্মা প্রদোষদার উক্তি। ‘প্রদোষদা, এগুলো অঙ্ক মেনেই হচ্ছে! পুরোটাই গাণিতিক ব্যাপার! গণিত তো গণিত মেনেই চলে। আর তিথি নক্ষত্র যাই বলুন না কেন সবই তো গণিত নির্ভর।’ খানিকটা রাগ সামলে বিনয়ের সুরেই বললাম সত্যিটা। এতে আরও জ্বলে উঠলেন তিনি। তর্জনী সঞ্চালন করে বললেন, ‘সব তোমাদের কারসাজি সব তোমাদের কারসাজি! নইলে কিনা মহালয়ার পঁয়ত্রিশ দিন বাদে সপ্তমী হয়? এও কি সম্ভব? বাপের জন্মে দেখিনি ভাই। বাপের জন্মে দেখিনি।’ আমার কিছু বলার আগেই গজ গজ করতে করতে ট্রাম রাস্তা বরাবর বিধান সরণি ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন বাড়ির দিকে। কোনও কথা না শুনে।
যদিও তিনি ফেলুদা নন, তবুও তো প্রদোষ মিত্র। তাই সত্যান্বেষী ফেলুদার মতো রহস্যভেদ করতে হবে। এবং, সেটা আমাকেই। তাই প্রচলিত লোকমুখের কথা। নীলিমা মাসির অকারণ দোষারোপ খণ্ডন, অবশেষে প্রদোষদার আবেগতাড়িত খানিকটা রাগত কথার উত্তর শুনব শাস্ত্রমুখে।
স্মার্ত ভট্টাচার্য রঘুনন্দন তাঁর ‘মলমাস তত্ত্ব’ গ্রন্থে বলছেন, ‘একটি মলমাস থেকে পরবর্তী মলমাসের ব্যবধান হবে দু’বছর তিন মাস থেকে দু’বছর ন’মাসের মধ্যে। মলমাস হল একটি অতিরিক্ত মাস এবং তা অশুদ্ধ মাস বলে পরিগণিত হয়েছে ধর্মীয় কৃত্যের ক্ষেত্রে। কেবল নিত্য নিরবকাশ কৃত্য অর্থাৎ অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি অপশন-হীন কাজগুলিই এই মলমাসে হয়ে থাকে। বাকি সব সাবকাশ ধর্মীয় কৃত্য অর্থাৎ অপশন-যুক্ত কাজগুলো শুদ্ধ মাসে হবে। এদের মধ্যে শারদীয়া দুর্গাপুজো অন্যতম। রঘুনন্দন-এর ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’ বলছে, ‘৬ আশ্বিন থেকে ৬ কার্তিকের মধ্যে অর্থাৎ গৌণচান্দ্র আশ্বিন এর মধ্যে শারদীয়া দুর্গোৎসব হবে। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ এবছরের শারদীয়া দুর্গাপুজো। আশ্বিন মাস মলমাস এর আগে বহুবার দেখা গিয়েছে। আর তখনই পনেরো দিনের পুজো পঁয়তাল্লিশ দিনের হয়ে যায়। পুরোটাই পাটিগণিত মেনে।
তবে ভাদ্র সংক্রান্তি অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মহালয়া আর পয়লা আশ্বিন থেকে মলনাস বড় একটা দেখা যায় না। তাই হয়তো অনেকের কাছে এটা নতুন ঠেকছে। এখন আসা যাক মলমাস অর্থাৎ অশুদ্ধ একটি অতিরিক্তি মাস কীভাবে হয়। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর ‘তিথিতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেছেন ‘ষষ্ঠী দণ্ডাত্মক কালঃ’ অর্থাৎ একটি তিথির মান ষাট দণ্ড। আবার এক দণ্ড হল ২৪ মিনিট। ঘণ্টায় তা দাঁড়াচ্ছে কম-বেশি চব্বিশ ঘণ্টা। আবার এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। অর্থাৎ রঘুনন্দন বলছেন, ‘বাণো বৃদ্ধি রস ক্ষয়ঃ’ অর্থাৎ বাণ মানে হল পাঁচ, মানে পঞ্চবাণ। অর্থাৎ চব্বিশের সঙ্গে পাঁচ যোগ হয়ে ২৯ ঘণ্টা হতে পারে, আবার রস কথাটা হচ্ছে নবরস অর্থাৎ রস-এর সংখ্যা হল নয় অর্থাৎ নবরস। আর ক্ষয়ঃ মানে হ্রাস পাবে। ফলত চব্বিশ বিয়োগ নয় অর্থাৎ পনেরো ঘণ্টা হতে পারে একটি তিথির মান।
এই হল ব্যতিক্রম।
এইভাবেই তিথির মানের হ্রাসবৃদ্ধির ফলে দু’বছর তিন মাস থেকে দু’বছর ন’মাসের মধ্যে একটি মলমাস আসবে। যেভাবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেনন্ডারে একটি লিপ ইয়ার হয়। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাস আঠাশ দিনের পরিবর্তে ঊনত্রিশ দিনে হয়। বছর তিনশো পঁয়ষট্টির জায়গায় তিনশো ছেষট্টি দিনে হয়।
চৌদ্দশো পঁচিশ বঙ্গাব্দের খুব সম্ভবত জ্যৈষ্ঠ মাসে মলমাস হয়েছিল। ঠিক দু’বছর চার মাসের মাথায় এবছর আশ্বিন মাসে মলমাস হল, কাকতালীয়ভাবে ভাদ্র সংক্রান্তি। অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মহালয়া হল। অর্থাৎ পিতৃপক্ষের অবসান হল। আর তাই পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষ এল না। এল একটি অশুদ্ধ মাস। তাই তিরিশ দিন বাদে হবে দেবী পক্ষ আর ৩৫ দিনের মাথায় সপ্তমী।
লেখক সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা আকাদেমি-র অধ্যক্ষ। মতামত ব্যক্তিগত