প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
রাজ্যগুলোকে অবশ্যই কেন্দ্রীয় সহায়তা দিতে হবে
আমি কেন বলি যে অন্য সব রাস্তা ছেড়ে রাজ্যগুলোকে সহায়তা করার পথেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাঁটা উচিত? কারণ, কেন্দ্র এবং রাজ্যের ক্ষমতা একেবারেই আলাদা:
১. নিজস্ব অধিকারে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা ঋণ নিতে পারে। সেখানে রাজ্য সরকারগুলোকে ঋণ নিতে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের আগাম অনুমতি নিয়ে।
২. সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কেন্দ্রীয় সরকার নিজে ঋণ গ্রহণের সময় সুদের হার সর্বনিম্ন রাখার নির্দেশ দিতে পারে। অন্যদিকে, রাজ্য সরকারগুলোকে বেশি সুদের হারে ঋণ নিতে হয়। এমনকী, বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষেত্রে সুদের হারে তারতম্যও হতে পারে।
৩. আরও একটি ব্যাপার হল, কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লভ্যাংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে নেওয়ার অধিকারী। সাম্প্রতিককালে এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, নিয়মানুযায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যতটা ডিভিডেন্ড দিতে চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি পরিমাণ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে আরবিআইয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। অন্যদিকে, আররিআইয়ের লাভের উপর রাজ্য সরকারগুলোর কোনও দাবি নেই।
৪. মুদ্রাকরণের মাধ্যমে বা টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারে। এই ধরনের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে টাকা ছাপানোর নির্দেশ দেয় এবং ছাপানো টাকা কেন্দ্রীয় সরকারকে হস্তান্তর করতে বলে। রাজ্য সরকারগুলোর এই ধরনের কোনও সার্বভৌম ক্ষমতা নেই।
সুতরাং আর্থিক সঙ্কটের কালে রাজ্য সরকারগুলোর সহায়তা প্রয়োজন। রাজ্যগুলো জিএসডিপির (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) ৩ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে প্রতিটি রাজ্যের এই ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমাটা পেরিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ রাজ্যগুলি আর ইচ্ছে করলেও ঋণ নিতে পারবে না। তার ফলে রাজ্য সরকারগুলো ঋণ গ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর আর্জি রেখেছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ঋণ গ্রহণের ঊর্ধ্বসীমা মাত্র ০.৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। বেশিরভাগ রাজ্যই, হয়তো-বা সব রাজ্যই, এবছর এই বর্ধিত সীমার পুরোটা ব্যবহার করে ফেলবে। এর অতিরিক্ত ঋণ নিলে সেটা রাজ্যগুলির পক্ষে বোঝা হয়ে যাবে। সেই ঋণ গ্রহণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তা পূরণ করার জন্য কোনও রাজ্যই প্রস্তুত নয়, বিশেষ করে এই অর্থবর্ষে।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে বন্দোবস্ত
জিএসটি চুক্তিটা হল কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে কর সংক্রান্ত একটা বন্দোবস্ত, যেটা অনেক বছরের আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে স্থির করা হয়েছে। এই বন্দোবস্তের ভিত্তি হল বিশ্বাস। আইনের যেমন একটা ভাষা আছে, তেমনি রয়েছে আইনের অন্তর্নিহিত ভাব। রাজ্যগুলোর কোষাগারের জন্য মূল্যযুক্ত কর (ভ্যাট) ছিল একটা কামধেনু। রাজ্যগুলোর কোষাগার ভরিয়ে দিত। এছাড়া এন্ট্রি ট্যাক্সের মতো কিছু কর কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়ের কোষাগারের জন্য ছিল আশীর্বাদ। জিএসটি চালুর সময় এই যাবতীয় ক্ষমতা একটি কাউন্সিলের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্যগুলোকে রাজি করানো হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ওই কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এর প্রতিদান স্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকার দু’টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: (১) বিক্রয় কর তুলে দেওয়ার পর ভ্যাট যেমন বেড়েছিল, জিএসটি সূত্রে রাজস্বও ঠিক তেমনি হারে বাড়বে। (২) যদি রাজস্ব বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশের নীচে নেমে যায়, তবে প্রথম পাঁচ বছর কেন্দ্র সেই ঘাটতির পুরোটাই পূরণ করে দেবে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে।
রাজ্যগুলোকে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়বদ্ধতাটা কোনও মৌখিক ব্যাপার নয়, এটা আইনসিদ্ধ রূপে লেখাজোকা রয়েছে। জিএসটি সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে জিএসটি কমপেনসেশন ফান্ড নামে একটা তহবিলও গড়া হয়েছে। এই ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছিল বাধ্যবাধকতা হিসেবে, কোনও শর্তনির্ভর ব্যবস্থা হিসেবে নয়। অর্থমন্ত্রী এবং তাঁর অফিসাররা এই দিকটি তাঁদের সুবিধামতো এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এই তহবিল যে-কোনও বছরে উদ্বৃত্ত হতে পারে অথবা পাঁচ বছর শেষে ঘাটতিও হতে পারে। যদি এই তহবিলে পাঁচ বছর পর কিছু উদ্বৃত্ত হয় তবে তার ৫০ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারকে হস্তান্তর করতে হবে। কিন্তু যদি ঘাটতি হয় তখন কী করা হবে? বিষয়টি নিয়ে জিএসটি কাউন্সিলে লম্বা বিতর্ক হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বিতর্ক হয়েছিল কাউন্সিলের সপ্তম, অষ্টম এবং দশম মিটিংয়ে। ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম বৈঠকে এই আলোচনায় ইতি পড়ে। সেদিন স্বাক্ষরিত কার্যবিবরণীর ৬.৩ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছিল:
‘‘৬.৩. তেলেঙ্গানা থেকে আগত মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, ক্ষতিপূরণ আইনটিতে এই ব্যবস্থা রাখতে হবে যে, ক্ষতিপূরণ তহবিলে টাকার ঘাটতি হলে তা অন্য সূত্রে সংগ্রহ করতে হবে। সচিব বলেছেন, খসড়া ক্ষতিপূরণ আইনের ৮(১) ধারায় এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে, পাঁচ বছর ধরে ‘সেস’ সংগ্রহ করা যেতে পারে, অথবা সংগ্রহ করা যেতে পারে কাউন্সিলের সুপারিশ মতো সময়ের জন্য। তিনি বলেছিলেন, প্রকারান্তরে এটাই দাঁড়াবে যে ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগাড়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অন্য উপায়ে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারবে এবং এটা পুষিয়ে দেওয়া যেতে পারে পাঁচ বছরের পরেও ‘সেস’ চালু রেখে। তিনি বলেছিলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের সম্ভাবনার মতো আরও কিছু সিদ্ধান্ত ছিল অষ্টম বৈঠকের কার্যবিরণীর অংশ। কাউন্সিলের অষ্টম বৈঠকটা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩ ও ৪ জানুয়ারি। বলা হয়েছিল যে, এটা আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন। এই পরামর্শের ব্যাপারে কাউন্সিল সেদিন সহমত হয়েছিল।’’
দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত
কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেটা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে না। ‘ক্ষতিপূরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অন্য কোনও উপায়ে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারত’, যার মধ্যে ‘ক্ষতিপূরণের জন্য বাজার থেকে টাকা ধার নেওয়ার সম্ভাবনা’ও ছিল। কোনও প্রকার কূটতর্ক ‘রেকর্ড’ পাল্টে দিতে পারে না। ধার করার জন্য রাজ্যগুলোকে ‘দু’টো অপশন’ কেন্দ্র দিয়েছে—এটা একটা প্রতারণামূলক কাজ। প্রতিটা রাজ্যের চলতি বছরের রাজস্ব বাজেটে একটা ছিদ্র রয়ে গিয়েছে। ধার গ্রহণ এই ছিদ্র বন্ধ করবে, কিন্তু রাজ্যের মূলধনী হিসাবে এটাকে ‘ঋণ’ হিসেবে দেখানো হবে। রাজ্যকে এর সুদ গুনে যেতে হবে এবং শেষমেশ এই ঋণ পরিশোধও করতে হবে। যদি রাজ্য ধার না করে এবং কেন্দ্র ক্ষতিপূরণ না দেয় তবে এই ছিদ্র ছিদ্রই থেকে যাবে। এবং, এর অনিবার্য পরিণতি এটাই হবে যে চলতি বছরে রাজ্য তার মূলধনী ব্যয় অথবা জনকল্যাণ খাতের ব্যয় ছেঁটে ফেলবে। এই দু’টোর কোনওটাই কিন্তু কাম্য নয়।
রাজ্যগুলো ঠিক কাজই করেছে—দু’টো অপশনই খারিজ করে দিয়ে এবং এই ছিদ্র পূরণের সম্পদ জোগাড়ের ব্যবস্থা কেন্দ্রকে করতে বলে। কেন্দ্র কি তার দায়িত্ব পালন করবে, না কি ‘মাই ওয়ে অর দ্য হাইওয়ে’ (হয় আমার কথা মনো, নয়তো ভাগো’) খেলা খেলবে?
লেখক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত