প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
এমনকী সংসদেও প্রশ্নোত্তর পর্ব বাতিল। সংসদে যাঁরা উপস্থিত থাকেন, তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তাঁরাই সংসদে জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। সেখানে প্রশ্নোত্তর পর্বকে খর্ব করা মানে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা। আমরা কোনও রাজতন্ত্রে বাস করি না। কিন্তু কেন সরকার এমন পদক্ষেপ নিল? আসলে সরকার ভালো করেই জানে, সংসদ বসলেই প্রশ্নোত্তর পর্বে তাদের দিকে উম-পুন ঝড়ের মতো অসংখ্য অপ্রিয় প্রশ্ন উড়ে আসবে। করোনা নিয়ে সরকারের লেজে গোবরে হওয়া, সুশান্ত-রিয়া বিতর্ক, কঙ্গনার ওয়াই-প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা, শিক্ষানীতি ইত্যাদি প্রশ্নের চাপে সরকারের নাভিশ্বাস উঠতে পারত। তার থেকে বাঁচতে কেন্দ্র সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘরে তালা মেরে বলে দিল , কোনও প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেনস!
প্রশ্নকে ভয় পাওয়া বা মোদিজির প্রশ্ন-ফোবিয়া নিয়ে একটা গল্প শোনা যাক। এটা রয়েছে সাংবাদিক করণ থাপারের ‘ডেভিলস অ্যাডভোকেট’ বইতে। সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। যেমন রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, এল কে আদবানি প্রমুখ। এই বইয়ের শেষ অধ্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎকার এবং পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন করণ। ২০০৭ সালে আমেদাবাদে মোদির সাক্ষাৎকার নিতে যান করণ। তখন মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। ২০০৭ সালে মোদির সাক্ষাৎকার নিলে গোধরা প্রসঙ্গ আসবেই। স্বাভাবিকভাবেই গোধরা কাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন এসে যায়। ২০০৪ সালে গোধরা কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মোদিকে বলেছিল,‘আধুনিক যুগের নিরো’। করণ সেটা নিয়েও প্রশ্ন করেন। মোদিজি এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যান। একটু পরে মোদিজি মাইক্রোফোন খুলে দিয়ে বলেন, ‘আমাকে একটু বিরতি নিতে হবে। আমার তেষ্টা পেয়েছে।’ তারপর আর মোদি তাঁকে ইন্টারভিউ দেননি। করণ থাপার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, ইন্টারভিউটা শেষ করতে। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর করণকে ফিরে আসতে হয়। তার আগে মোদি তাঁকে চা, মিঠাই এবং গুজরাতি ধোকলা খাইয়ে তবে ছাড়েন। সাক্ষাৎকার না দিলেও মোদি তাঁর সঙ্গে সেদিন খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন। আসার সময় হাসিমুখে মোদি তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনার যা মত, আপনি তা বলতে থাকুন, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে।’
মুখে মোদি সেকথা বললেও, সেই বন্ধুত্ব থাকেনি। আর কখনও তিনি সাক্ষাৎকার দেননি। এমনকী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর মন্ত্রিসভার কেউই করণকে কোনও সাক্ষাৎকার দেননি। অবশেষে করণ অমিত শাহের দ্বারস্থ হন। অমিত কথা দেন তিনি সাক্ষাৎকার দেবেন। কিন্তু তিনিও দেননি। বিষয়টি নিয়ে তিনি বিজেপির অন্দরে নানাভাবে খোঁজখবর নিতে থাকেন। করণ পরে বিশিষ্ট রাজনীতিক, এমপি, ডিপ্লোম্যাট পবন ভার্মার কাছ থেকে কিছু কিছু কথা শোনেন। পবন ছিলেন প্রশান্ত কিশোর এবং নীতীশ কুমারের খবই ঘনিষ্ঠ। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদির মেন্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। সেইসময় প্রশান্ত বার বার মোদিকে শেখাতেন, কীভাবে অপ্রিয় প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়। তখন মোদি প্রশান্ত কিশোরকে বলেছিলেন, ‘আমি সেদিন সুকৌশলে করণের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেছিলাম। যাতে ও আমার মতিগতি বুঝতে না পারে।’ মোদি সেদিন প্রশান্ত কিশোরকে আরও বলেছিলেন, করণকে তিনি কোনওদিন ক্ষমা করবেন না। সুযোগ পেলে এর জবাব দেবেন। এই গল্পের সব তথ্যটুকুই করণের লেখা থেকে পাওয়া।
সুতরাং কারও প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার স্বভাবটা তিনি যে দীর্ঘদিন ধরেই গড়ে তুলেছেন, সেটা বোঝাই যায়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। হয়তো করণের সেই সাক্ষাৎকারের স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে মারে। ফেলে আসা দিনের কালো কালো প্রশ্নগুলো আবার যদি উড়ে আসে? অতীতের বা এখনকার নানা ব্যর্থতার কৈফিয়ত চেয়ে বসেন সাংবাদিকরা? সেই ভয় থেকেই কি তিনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান?
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে। অ্যালোডোক্সাফোবিয়া। এর অর্থ, যিনি অন্যের মতামত বা ভিন্নমত শুনতে ভয় পান। অর্থাৎ এঁরা শুধু স্তুতিই পছন্দ করেন। অতীতে রাজতন্ত্রের কালে এমন রাজা অনেক এসেছেন। রাজবিরোধী কথা বললেই তাঁরা প্রজাদের প্রাণ নিতেন, শূলে চড়াতেন। এখন সেই অতীত নেই। এখন গণতন্ত্রের কাল। সকলের সমানাধিকার। এখন দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারেন। বলতে পারেন, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’ দেশের গণতন্ত্র এবং সংবিধান তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় উল্লেখিত পরান্নভোজী, কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চকরা অবশ্য যুক্তি দিয়ে বলবেন, ‘রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম,/ চোখে পড়ছে না যদিও, তবুও আছে,/ অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।’
এই মুহূর্তে সুশান্ত-রিয়া, কঙ্গনা নিয়েও অনেক প্রশ্ন মানুষের মনে। কেন হঠাৎ এদের খবরে তুলে আনা হল? কারণ মোদি, অমিত শাহ তথা বিজেপি নেমে পড়েছে বিহার জয়ে। সেখানে অবশ্য নীতীশের হাত ধরে বিজেপিকে ভোট বৈতরণী পার হতে হবে। সেখানে রাজপুত ভোট আর ক্ষত্রিয় ভোট নিজেদের বাক্সে আনতে বিজেপিকে খেলতে হল দু’টি খেলা। একজনকে ডাইনি বানানো হল, অন্যজনকে দেবী বানানো হল। সুশান্ত সিং রাজপুতের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে রিয়া চক্রবর্তীকে স্কেপগোট করা হল সিবিআইকে দিয়ে আর অন্যদিকে কঙ্গনা রানাওয়াতকে দেবী বানিয়ে ফেলা হল। তিনি যেন জোয়ান অব আর্ক। সুতরাং চুলোয় যাক করোনা। প্রতিদিন রোজ আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছুঁয়ে ফেললাম যে! এহ বাহ্য, আগে কহ আর। বিহারে সাম্প্রতিক বন্যায় আশি লক্ষেরও বেশি মানুষ গৃহহীন! এহ বাহ্য, আগে কহ আর। আরে বাবা, জিডিপি মৃত্যুশয্যায়, মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে! এহ বাহ্য, আগে কহ আর।
সুতরাং বলার মধ্যে রইল সুশান্ত-কঙ্গনা কথা। হায় রে, করোনা তুমি হেরে গিয়েছ সুশান্ত, কঙ্গনার কাছে। সুশান্ত সিং রাজপুতের পুরনো গল্পটা অনেকেই জানেন। ২০১৮ সালে সুশান্ত অভিনীত ‘কেদারনাথ’ ছবিটা রিলিজ করেছিল। সেইসময় গেরুয়া পার্টি হুল্লোড় করে নেমে পড়েছিল ছবিটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য। সুশান্ত সেই ছবিতে মনসুর নামে এক মুসলিম ডুলিবাহকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সারা ছিলেন সেই ছবিতে একটি হিন্দু পুরোহিতের মেয়ে। এই দু’জনের প্রেম বা লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল গেরুয়া বাহিনী। সুশান্তের ছবি সংবলিত পোস্টারে তারা আগুন ধরিয়ে তখন কী না বলেছিল! এখন ভোটের তাগিদে তাঁর কাছেই নতজানু হতে হল। এখন তাঁর ছবি নিয়ে, তাঁকে মহান সাজিয়ে ভোটে ফায়দা লোটার দ্বিচারিতা করতেও তাদের বাধছে না। সুশান্ত ছেলেটা নাকি এতই ভোলাভালা যে, সে নেশা বস্তুটা কী জানত না, একের পর এক প্রেম করে যাওয়া কী জানত না। ওই রিয়া মেয়েটাই নাকি ওর মাথা খেয়েছে। সুতরাং আহারে, সুশান্ত তোমাকে আমরা ভুলছি না, ভুলব না। সুশান্তকে শহিদের মর্যাদা দিয়ে জয়বাবা ভোটনাথ বলে বিজেপি বিহার মাতিয়ে তুলেছে। এরাজ্যে বসে তার আঁচ পাওয়া সহজ নয়।
‘পদ্মাবতী’ ছবির কথা মনে পড়ছে? ছবিটার নাম ‘পদ্মাবত’ করে ছাড়ল। সেই ছবির শ্যুটিংয়ের সময় বার বার করণি সেনার হামলার ঘটনা ঘটেছে। করণি সেনা দীপিকার মুণ্ড কেটে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল। কই, সেই সময় তাঁকে কোনও নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তো ভাবা হয়নি? আজ হামলার আশঙ্কার কথা জানাতেই কঙ্গনা পেয়ে গেলেন ওয়াই প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা? আর তাও পুরো মুফত মে। ২০১৩ সালে মুকেশ আম্বানির উপর হামলার আশঙ্কায় তাঁকে জেড ক্যাটিগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য তাঁকে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ১৬ লক্ষ টাকার বিল পাঠানো হতো। এখন ওসব যুক্তিতর্কের দিন নয়। উপেক্ষিত এই গণতন্ত্রের ধস্তভূমিতে দাঁড়িয়ে আমাদের কি তবে শুধু ওই জটায়ুর মতো বিড় বিড় করে বলে যেতে হবে, ‘কোনও প্রশ্ন নয়, নো কোয়েশ্চেনস?’ নাকি সবাই গলা মিলিয়ে বলব, আমরা প্রতিটি কাজের জবাব চাই।