প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
হ্যাঁ, মোদি সরকারের আনা এই বিল কৃষকদের মৃত্যুর পরোয়ানা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কৃষিবিল দেশের চাষিদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেবে। তাঁদের মঙ্গলের নামে অমঙ্গল ডেকে আনবে। কৃষিক্ষেত্রটাই বৃহৎ শিল্পপতিদের দখলে চলে যাবে। কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চলে যাবে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার হাতে। কয়েকটি সংস্থা মিলে ঠিক করবে, কোন কৃষিপণ্যের কী দাম হবে। সেক্ষেত্রে তারাই বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন বাজারের মূল ভাষ্য হয়ে দাঁড়াবে, ‘হে চাষিগণ, হয় এই দাম নাও, নাহলে ভাগো।’ ভাগো মানে তুমি জাহান্নামে যাও, আমরা মুনাফা করে নিই। বানিয়া সরকারের বানিয়া সঙ্গীরা লুটেপুটে খাবে। আর চাষি কীটনাশক খেয়ে মর্গে পড়ে থাকবে ময়নাতদন্তের অপেক্ষায়।
সারাদেশের খোলাবাজারে চাষিরা কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন বলে লোভ দেখিয়ে তাঁদের কর্পোরেট সংস্থার গাড্ডার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে মান্ডি কি থাকবে? সরকার বলছে থাকবে। কিন্তু এমন চালাকি করে তা করা হচ্ছে যে, দু’একবছর পরে তার আর কোনও প্রয়োজনই থাকবে না। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কি থাকবে না? সরকার বলছে থাকবে। কিন্তু সরকার নামার আগে কর্পোরেট সংস্থাগুলি বাজারে নেমে ধান কিনতে শুরু করে দিলে এর আর কোনও মূল্যই থাকবে না। সরকার বলছে, বিক্রির বাজার বড় হয়ে গেলে ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কয়েকটি কোম্পানি যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তখন তা মনোপলি মার্কেটিং হয়ে যায়। সেখানে ছোট ব্যবসায়ীদের প্রবেশাধিকার থাকে না। ছোট বিক্রেতারা তাদের সঙ্গে টাকার প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। একচেটিয়া বাজার দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। এভাবেই নিঃশব্দে লেখা হয়ে যায় মৃত্যুর পরোয়ানা।
সরকারের যদি ভালো উদ্দেশ্যই থাকবে, তবে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফাভাবে এই বিল চাপিয়ে দিচ্ছে কেন? আসলে এতে রাজ্যগুলির ক্ষতি হবে। এতে রাজ্যের খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। খাদ্যসামগ্রীর দাম চড়চড় করে উঠতে থাকবে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাষির থেকে কম দামে কিনে তা খোলাবাজারে দেশের মানুষের কাছে বেশি দামে বিক্রি করবে। মানুষ কী দামে খাদ্যসামগ্রী কিনবে, তাও তারা ঠিক করে দেবে। তাদের কাছে গচ্ছিত থাকবে দেশের সিংহভাগ খাদ্যসামগ্রী। তাই তাদের মুনাফার ব্যবস্থা মোদি সরকার করে দিল। কৃষিবিলের প্রতিটি শর্তের মধ্যে লেখা রয়েছে কৃষকের অন্তিম শ্বাস। অতীতের মতোই আবার দেখা গেল, দেশের বড় বড় শিল্পপতিদের স্বার্থকেই তিনি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাঁদের হাতে তামাক খেয়ে তিনি দেশের সবক্ষেত্রেই নীতি নির্ধারণ করছেন। এর কারণ আছে। দেশের শিল্পপতিদের একটা বড় শিক্ষা দিয়ে গেল করোনা। করোনার সময় শিল্প-টিল্প সব বন্ধ। যেটুকু সক্রিয় ছিল, সেটা হল দেশের কৃষিক্ষেত্র। তাই শিল্পপতিদের নজর পড়েছে এবার কৃষিক্ষেত্রে। শিল্পপতিরা হয়ে উঠতে চাইছেন কৃষিপতি। হে চাষি, তোমার লাঙল, তোমার জমি, আমার প্রফিট। তুমি আসলে আমার কৃষিদাস।
পাঞ্জাবে ইতিমধ্যেই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। হরিয়ানায় শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে তা বিহার, ঝাড়খণ্ড সহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। কৃষকঘাতী এই আইনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গও অবিলম্বে রুখে দাঁড়াবে। সামনে বিহারে ভোট। এই কৃষিনীতি সেখানেও চাষিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন ফেলবে। এই সময়ে বিহারে বিরোধী দলগুলি যদি সাবালকের মতো আচরণ করতে না পারে, তবে তারা চাষিদের এই সরকার বিদ্বেষী মনোভাবের ফসল ভোটবাক্সে তুলতে পারবে না। আগামী বছর এই রাজ্যে বিধানসভা ভোট। এখনই গেরুয়া শিবিরের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য দেখা যাচ্ছে, তাতে তারা ধরেই নিয়েছে, এখানে বিজেপি সরকার গড়ে ফেলেছে। একটা কথা এখানে বলাই যায়। সেটা হল, মোদি সরকারের যাবতীয় জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী একটা মুখই দেশে আছে। তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই মোদি-বাহিনী জানে, তাঁকে কোনওভাবে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলে মোদির যাবতীয় খুড়োর কলের প্রকল্প বিনা বাধায় দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে এখানে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। হায়রে, ভোটারদের মনের খবর দেবা ন জানন্তি কুতো লিডার। কৃষিবিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শিরোমণি অকালি দলের হরসিমরতের পদত্যাগের পর চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন হরিয়ানার উপ মুখ্যমন্ত্রী দুষ্যন্ত সিং চৌতালা। বিজেপির টোপ গিলে তিনি উপ মুখ্যমন্ত্রীর পদ পেয়ে আহ্লাদিত হয়েছিলেন। এখন জাঠ-কৃষকদের আন্দোলন দেখে ঠিক করতে পারছেন না সিংহাসন আঁকড়ে থাকবেন, নাকি ওই পদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কৃষকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন। ইতিমধ্যেই তাঁর দল জননায়ক জনতা পার্টিতে ভাঙন শুরু হয়েছে। দলের ভিতরেই একটা শক্তি দুষ্যন্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছে। তারা বুঝেছে, এভাবে বিজেপির তোষামোদ করে ক্ষমতার রসগোল্লা খেতে থাকলে আগামীদিনে তাদের রাজনৈতিক কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে। তখন একফোঁটা রসও জুটবে না। সুতরাং এই মুহূর্তে কৃষকদের পাশেই দাঁড়াতে হবে। যে কারণে হরসিমরতকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষকরা হুমকি দিয়ে বলেছেন, যাঁরা এই বিলকে সমর্থন করবেন, তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেবেন না। রাজনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে এনডিএ জোটে ভাঙন ধরতে শুরু করেছে। বিহারে ভোটের আগে দোনামোনায় অন্য শরিকদল রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। একেই আসনরফা নিয়ে কোণঠাসা রামবিলাসের দল পাল্টা জবাব দিতে চাইছে। এই অবসরে তাঁর রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে কৃষি বিল।
নমো-র শাসনকালে আমরা বারবার তাঁর হাতে দেখি মানুষের মৃত্যুর পরোয়ানা। নোটবাতিলের রূঢ় নৌটঙ্কিতে ব্যাঙ্ক আর এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে কত মানুষ মারা গিয়েছেন, সরকারের কাছে তার কোনও হিসেব আছে? এনআরসি, সিএএ’র মতো নষ্ট আইন প্রতিষ্ঠা করার গা-জোয়ারিতে কত মানুষের চোখের জল পড়েছে, আত্মহত্যা করেছেন কতজন, মোদি সরকারের কাছে তার কোনও হিসেব আছে? লকডাউনে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে কষ্টে, যন্ত্রণায়, অনাহারে সারাদেশে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মোদি সরকারের কাছে তার কোনও হিসেব আছে? নেই। কেননা এসব চোখের জল আর মৃত্যুর কোনও দামই নেই এই কর্পোরেট সরকারের কাছে। সরকারের প্রাত্যহিক ড্রামাবজির আড়ালে দেশের নানা প্রান্তে মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঔদ্ধত্য তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছে দেশের মানুষের কথা। একদিকে ধনী আরও ধনী হয়ে উঠছে, গরিব আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেট ভাবনায় এসবের কোনও মূল্যই নেই। একদিন তিনি রেলস্টেশনে চা বেচতেন। আজ তিনি দেশের রেলস্টেশনই বেচে দিতে মরিয়া। তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্তে লাভবান হচ্ছেন দেশের বৃহৎ শিল্পপতিরা। তাঁদেরই শতশত কোটি টাকার সাহায্য এসে জমা হচ্ছে পিএম কেয়ার্স ফান্ডে।
মার্চ মাসে করোনা হানার আগে ফোর্বস সারা বিশ্বের ধনীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। একশো কোটি ডলারের মালিকদের সেই তালিকায় ভারতের ১১২ জন বিলিওনার ছিলেন। কয়েকদিন আগে আবার ফোর্বস একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ভারতের ১১৭ জনের নাম আছে। অর্থাৎ করোনাকালে আরও ১৫ জন ভারতীয় তাঁদের সম্পত্তি বাড়িয়ে এই তালিকায় ঢুকে পড়েছেন। যাঁরা তালিকায় ছিলেন, তাঁদের সম্পত্তিও অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি মার খেতে খেতে ক্রমেই পিছু হটছে এদেশের দরিদ্র আর মধ্যবিত্তরা। জিডিপি মাইনাসে, করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন এদেশের প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষ। ওই ৪২ লক্ষ মানুষ অন্তত দেড় থেকে দু’ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান করত, সেই সব পরিবার এখন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে। ব্যাঙ্কের সুদ কমতে কমতে এমন জায়গায় এসেছে, যেখানে প্রবীণরা তাঁদের ওষুধ কেনার পয়সা জোগাড় করতে পারছেন না, রুটি জোগাড় তো দূর কি বাত! চাকরির পর ব্যাঙ্কে জমানো পিএফের উপর সুদের টাকায় কোটি কোটি মানুষের সারা মাস চলে। তাঁদের মুখের খাবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে বিনিয়োগ করছেন শেয়ার বাজারে। লক্ষ্য করার বিষয়, কীভাবে নিঃশব্দে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তার দিকে। শেয়ার বিক্রি বাড়ছে, তার দরও বাড়ছে। লাভবান হচ্ছেন বড় বড় শিল্পপতিরা। এভাবেই নিঃশব্দে তৈরি হয়ে যায় মৃত্যুর পরোয়ানা।
আরও আছে, ধৈর্যং রহু। কর্মীদের ছাঁটাই করার অধিকার বৃহৎ মালিকগোষ্ঠীর হাতে দিয়ে তাঁদের সুরক্ষিত করা হচ্ছে। যে কোনও সময় কর্মীদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার অধিকার তুলে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের হাতে। তাহলে কী চায় এই সরকার? এই সরকারের একটিই মাত্র মুখ্য প্রকল্প। মানুষে মানুষে বিভেদ সঞ্চার কর, ঘৃণা ঢুকিয়ে দাও মানুষের মনে। সমাজে সব সময় একটা সঙ্কট তৈরি করে দাও। অর্থাৎ দেশে সবসময় একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে রাখ, অসন্তোষ তৈরি করে রাখ। হিটলার বলেছিলেন, মানুষকে ঠেলতে ঠেলতে এমন কোণঠাসা করে দাও, যেখানে তার মনে হবে, কোনওভাবে বেঁচে থাকা মানেই ভালোভাবে থাকা। ঠিক তাই। আজ তাই প্রত্যেকটি মানুষের মনে হচ্ছে, এই দেশটা একটা অবরুদ্ধ ক্যাম্প! অবিলম্বে অক্সিজেন দরকার।