প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
সেদিন কেঁপে উঠেছিল সিনেমা হল। ভরাট গলায় তখন স্ক্রিন জুড়ে নতমস্তকে ভারতকে অভিবাদন আফগানভূমি থেকে আসা এক পাঠানের। সীমান্ত ছাড়িয়ে সেই আবেগ ঝড় তুলেছিল আফগানিস্তানেও। বলিউডের মারকাটারি সিনেমা ‘খুদা গাওয়া’। আর দুরন্ত এক পাঠান—বাদশা খান।
নব্বইয়ের দশকে অমিতাভ বচ্চন আফগান মেহমান! তখনও আফগানিস্তানে শাসনে বসেনি তালিবান। সোভিয়েত সেনা সেখান থেকে চলে গেলেও তার প্রভাব ছিল। সেই শক্তিতেই ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লা। তিনি ভারতীয় হিন্দি ছবির গুণমুগ্ধ। পরিচালক মুকুল এস আনন্দ ‘খুদা গাওয়া’ ছবির প্লট আফগানিস্তানে করেছেন জানতে পেরেই নাজিবুল্লা সরকার সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শ্যুটিং হয়েছিল বালখ প্রদেশের বিখ্যাত মাজার ই শরিফে। সেদিনের আফগান আপ্যায়নের কথা ভোলেননি অমিতাভ। ভোলেননি নাজিবুল্লা সরকারের দেওয়া রাজকীয় আতিথ্য ও নিরাপত্তার কথা। স্মৃতি জুড়ে থাকা পাঠান ভূমির কথা। যেখানে তিনি শুধু অভিনেতাই নন, একজন অকুতোভয় সর্দার। আফগানদের আপনজন। আসলে আফগানিস্তান মানেই ভারতের চির বন্ধু।
কিন্তু হঠাৎই বদলে গিয়েছিল সব! আফগানিস্তানে তখন প্রাক্-শীত মরশুম। বছরের এই সময় কাবুলের আবহাওয়া থাকে মনোরম। কয়েক মাস পরই বরফ পড়ার সময়। ঠিক এই সময়ই তালিবান দুনিয়া কাঁপিয়ে কাবুলে ঢুকে পড়েছিল। নাজিবুল্লার ‘পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান’, সংক্ষেপে পিডিপিএ-এর এন্তেকাল ঘনিয়ে এসেছিল, তাসের ঘরের মতো সেই শাসন ভেঙে পড়ল বলে! মূলত মার্কিন প্রচারমাধ্যমের নিরন্তর ঢক্কানিনাদের কারণেই এমন একটি ধারণা গোটা দুনিয়া জুড়েই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ছবিটা একেবারে পরিষ্কার। জালালাবাদে আফগান মুজাহিদিনরা জিতে যাবে। জিতলেই আফগান সেনার একটা বড় অংশ শিবির পাল্টে তাদের দিকে ভিড়বে। ব্যস, তার পরে কাবুলের পতন তো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়রের নেতৃত্বে গেরিলারা তখন জালালাবাদ দখলে তৎপর। তাদের প্রচ্ছন্ন মদতদাতা একদিকে ওয়াশিংটন, অন্যদিকে ইসলামাবাদ। ঝাঁকে ঝাঁকে পশ্চিমি সাংবাদিক ততদিনে কাবুলে রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছেন। মুখিয়ে আছেন আফগানিস্তানে সোভিয়েত -মদতপুষ্ট জমানার বিয়োগান্তক পরিণতিটির আঁখো-দেখা বিবরণী লেখার জন্য।
১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লা ও তাঁর ভাই শাহপুর আহমেদজিকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের পাশের ট্রাফিক পোস্টে। দু’দিন এভাবেই ঝুলে থাকলেন নাজিবুল্লা। তালিবান জঙ্গিদের বাধায় কাবুলে তাঁদের কবরও দেওয়া গেল না। নাজিবুল্লার জমানা যে ফুরোল, তার বড় কারণ মোটেই তালিবানবাহিনী নয়, বরং সোভিয়েতের স্বপ্নভঙ্গ, সোভিয়েতের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া এবং বরিস ইয়েলৎসিনের উত্থান। এ সবের সম্মিলিত প্রভাবে কাবুল নৈরাজ্যে নিমজ্জিত হল। নাজিবুল্লার স্ত্রী ও কন্যা নয়াদিল্লি থেকে এসব সংবাদ শুনে গেলেন আটচল্লিশ ঘণ্টাজুড়ে। আফগানিস্তানের মাটিতে এভাবেই শুরু তালিবান শাসন।
নখ রাঙানোর জন্য নেলপলিশ লাগানোর অভিযোগে চাবুক খেতে হতো মেয়েদের। আফগানিস্তানে তখন তালিবানের রাজত্ব। বোরখা ছাড়া অন্য পোশাকে মেয়েরা রাস্তায় বেরলেও জুটত চাবুকের বাড়ি। পরকীয়ার অভিযোগ এনে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শুক্রবারের প্রার্থনার পরে খেলার স্টেডিয়ামের সামনে মুণ্ডচ্ছেদ করা হতো তাঁদের।
নাজিবুল্লার সঙ্গে ভারতের বরাবর বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। পুরোনো মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তত দিনে ভেঙে গিয়েছে। মুজাহিদিনদের আক্রমণে ১৯৯২ সালে পদত্যাগের পর স্ত্রী-কন্যাকে ভারত পাঠিয়ে নাজিবুল্লা নিজেও দিল্লি চলে আসবেন ভেবেছিলেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘও সেটা চাইছিল। একটা বিমানও পাঠায় ভারত। উজবেক নেতা আবদুর রশিদ দোস্তামের বাধায় শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। এমনকী কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েও পাননি নাজিবুল্লা। হত্যার আগে তাঁকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্থানীয় দপ্তর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নাজিবুল্লার নির্মম হত্যাযজ্ঞ তালিবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে এক ঐতিহাসিক কাঁটা হয়ে রয়েছে। আজও। কিন্তু বিশ্ব তো সব সময় বিজয়ীদের সঙ্গেই থাকতে চায়। সম্প্রতি কাবুলে রাজনৈতিক সমীকরণ যতই তালিবানের পক্ষে যাচ্ছে, গোটা দুনিয়া ততই সেই ‘নৃশংস-মানবতার শত্রু’ বলে পরিচিত তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে চাইছে।
১৯ বছর আগের সেপ্টেম্বরে এক যুদ্ধের শুরু। আর ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাতারের দোহায় একই প্রতিপক্ষরা বসেছিল যুদ্ধের বদলে শান্তির খোঁজে। ইতিহাসের নির্মম কৌতুক ছাড়া একে কী বলবেন? কোনও এক অনাগত ইতিহাস এ রকম যুদ্ধবাজ আর কপট শান্তিবাদীদের নিশ্চয়ই হাজার হাজার সাধারণ মানুষের খুনের দায় নিতে বলবে। তারপরও সাধারণ আফগানরা এখনই শান্তি চায়। কিন্তু তালিবান কী পারবে সেটা দিতে? বন্দুক হাতে পাহাড়ের ফাঁকফোকর থেকে বিদেশি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেয়েও কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। আলোচনার টেবিলে ন্যাটো জেনারেলরা নেই এখন। এবার স্বদেশি ভিন্ন মতাবলম্বীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। যুক্তিতর্ক আর আশ্বাসে নিজ দেশের বিভিন্ন মহলকে আশ্বস্ত করতে পারলেই কাবুলে ক্ষমতার ভাগ পাবে তারা।
দোহা আলোচনায় তালিবানের মতোই জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে আফগান সরকারের জন্যও। এই সরকারে আছে অনেক উপদল। তালিবানকে ছাড় দেওয়ার সীমা নিয়ে সরকারের ভিতরে রয়েছে অনেক মতভিন্নতা। এই দূরত্ব সামলাতে আমেরিকাকে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হবে। আর ভারত? আফগানিস্তানের পুরোনো ‘বৈধ সরকার’ হিসেবে তালিবানের দাবি ভারত এখনও মানে না। কিন্তু এরপরও ভারতের বিদেশমন্ত্রী ১২ সেপ্টেম্বর দোহায় তালিবান নেতাদের সঙ্গে আফগান সরকারের শান্তি বৈঠকের সময় অনলাইনে বক্তৃতা দেন। আফগানিস্তানে একটি হানাহানি-মুক্ত স্থিতিশীল পরিবেশ গড়ে ওঠার উপরে জোর দেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বলেন, হিংসা মুছে ফেলার পাশাপাশি আফগানিস্তানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র কায়েম এবং সংখ্যালঘু ও মহিলাদের সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা হবে— এমন শান্তিচুক্তির পক্ষে ভারত। তালিবান উপস্থিতি আছে, এমন কোনও আসরে ভারতীয় মন্ত্রীর প্রকাশ্যে মুখোমুখি এই প্রথম। তাহলে কি ঘৃণ্য তালিবানকেও মেনে নিতে হবে ভারতকে? তালিবান নেতাদের কি স্বীকৃতি দেবে ভারত? না কি দুর্ধর্ষ খুনে বাহিনী তালিবান রাতারাতি অস্ত্রশস্ত্র তুলে রেখে সভ্য হয়ে যাবে?
কে না জানে তালিবান জঙ্গিরা আদতে পাকিস্তানের সৃষ্টি। আফগান সীমান্তবর্তী নিজেদের ভূখণ্ডে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সংগঠিত করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। শান্তিচুক্তিতে ক্ষমতাবান হওয়ার পরে আফগানিস্তানের সম্ভাব্য তালিবান অধ্যুষিত এলাকাগুলি পাকিস্তানি ও কাশ্মীরি জঙ্গিদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
তালিবান নেতারা যুদ্ধের ময়দানে ১৯ বছর থাকার পর এখন নিশ্চিতভাবেই জানে, ন্যাটোর বাইরে কারা কারা আফগান সরকারকে সমর্থন-সাহায্য দিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে তালিবানবিরোধী নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রতি ভারতের সাহায্য ছিল বিপুল। আজকের আফগানিস্তানে ভারত দ্বিতীয় প্রধান ‘দাতা’। তালিবানমুক্ত সমৃদ্ধ আফগানিস্তান চায় ভারত । ন্যাটো সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমেরিকাও আর এই যুদ্ধের খরচ জুগিয়ে যেতে রাজি নয়। তাছাড়া তালিবানকে স্বীকৃতি দিতে আমেরিকার চাওয়াটা স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আফগান শান্তি আলোচনায় একধাপ এগনো দরকার। যা ট্রাম্পকে নির্বাচনী যুদ্ধের প্রচারে এগিয়ে রাখবে। ট্রাম্প দেখাতে চাইছেন, দেশকে ১৯ বছরের যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিচ্ছেন তিনি। এর জন্য ওই অঞ্চলের সব খেলোয়াড়কে তারা ‘শান্তি প্রক্রিয়া’য় শামিল করতে চায়। ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকে বিশেষভাবে চায় তারা।
কিন্তু তাতে ভারতের কী লাভ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তান রেষারেষির পরবর্তী অধ্যায় কাশ্মীর থেকে আফগানিস্তানের দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। পাকিস্তান তো ইতিমধ্যে ভাবা শুরু করেছে, তালিবানের সঙ্গে তার পুরোনো সম্পর্ককে সম্বল করে ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে তার প্রভাব হতে পারে একচ্ছত্র। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে। ভারত কি চাইবে তার মিত্র দেশ হাতছাড়া করতে? তালিবানও অতীতকে সামনে টেনে এনে হয়তো হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বরং দর–কষাকষি করতে আগ্রহী হবে। যা আবার পাকিস্তানের সঙ্গে দর–কষাকষিতেও তাদের এগিয়ে রাখবে। কিন্তু ওয়াশিংটন পাকিস্তান-তালিবান জোটের হাতে আফগানিস্তানকে ছেড়ে দিয়ে আসতে চাইছে না। চীন-পাকিস্তান মৈত্রীর কাছে আফগানিস্তানকে ছেড়ে দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। জানে ওয়াশিংটন। ভারতকে তারা দোহা সমঝোতায় যেকোনওভাবে যুক্ত করতে আগ্রহী। বলা বাহুল্য, পাকিস্তান ও চীনের তরফ থেকে বিরোধিতা থাকবে এতে। তালিবানের একাংশও ইসলামাবাদ ও বেজিংয়ের হয়ে ভারতের প্রতি বৈরিতা দেখাবে। কিন্তু ভারতের জন্য সুবিধার দিকও আছে। আফগান সরকার এখনও নয়াদিল্লির পাশে।
তবে তালিবান ও ভারতের পারস্পরিক স্বীকৃতির মুহূর্তটি অবশ্যই নাজিবুল্লার পরিবারের জন্য হবে চরম বেদনাময়। ১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বর এবং ২০২০–এর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতের বিদেশনীতির মোটা দাগে এই মোড় পরিবর্তনে তারা এখন শোকার্ত দর্শকমাত্র। কিন্তু এটাই ভূরাজনীতির বাস্তবতা। বিশেষ করে যখন চীন-ভারত-পাকিস্তান-ইরানের মধ্যে আফগানিস্তান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। ইতিহাস তো নির্মমভাবে শক্তির পূজারি! এই দুনিয়ায় নাজিবুল্লার স্ত্রী ফাতানা নজিব এবং তাঁর তিন কন্যার চোখের জলের কোনওই মূল্য নেই!