প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
অমাবস্যার শেষে শুক্লপক্ষের শুভ প্রারম্ভে দেবী আরাধনার প্রস্তুতি শুরু। মহালয়ার শুভলগ্ন যতই পিতৃপক্ষের সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে থাকুক না কেন, লোকায়ত চেতনায় দেবী আরাধনার সঙ্গেই তার সংযোগ বেশি। বাঙালি মননে এই দিন দেবী কৈলাস থেকে পিতৃগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দেবী আমাদের কন্যাতুল্যা! তিনি আসছেন তাই মহালয়ার আগেই ঘর-দুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়। ঘরে ঘরে প্রস্তুত হয়ে যায় নানাবিধ মিষ্টান্ন। মহা উৎসবের ক্ষণ সমাগত। একেবারে সাধারণ এক ঘরোয়া গৃহিণীর মতোই তাঁর জীবন-ছবি এঁকেছি আমরা। তাই দেবীর পক্ষে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ— এই চার পুত্রকন্যাকে নিয়ে বেড়াতে আসা কম ঝক্কির ব্যাপার নয়, উপরন্তু উদাসীন ভোলানাথের সব ব্যবস্থা করে তবেই যাত্রা! তাতেও শান্তি নেই। যেদিন যাত্রা করবেন, সেই দিনটি কোন বার হবে তার উপর তাঁর বাহন নির্ধারিত হয়। কখনও তিনি তাই দোলায়, কখনও গজে বা ঘোড়ায়, কখনও বা পালকি করে ধীরেসুস্থে উপস্থিত হন।
পিতৃপক্ষ হল সেই পক্ষকাল যে পক্ষে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জলদান ও শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করা হয়। বলা হয়, এই সময় পিতৃপুরুষগণ আমাদের প্রদত্ত অন্নের জন্য পিতৃলোকে অপেক্ষা করেন। তাই এই অমাবস্যাকে বলা হয় সর্বপ্রীতি অমাবস্যা, পিতৃ অমাবস্যা, বা মহালয়া অমাবস্যা। গণেশ চতুর্থীর আগের পূর্ণিমার পর থেকে যে পক্ষটির সূচনা হয় সেই পক্ষই পিতৃপক্ষ রূপে চিহ্নিত। শাস্ত্রমতে পৃথিবী ও স্বর্গলোকের মধ্যস্থলে পিতৃলোক অবস্থিত। যম এই লোকের অধিদেবতা। কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে স্বয়ং যমরাজ তাঁকে এই লোকে প্রেরণ করেন। পরিবারের এক প্রজন্মের মৃত্যু হলে পরলোকে গিয়ে প্রথমে পিতৃলোকেই বাস করতে হয়, যতদিন না পরবর্তী প্রজন্মের মৃত্যু ঘটে। পরবর্তী প্রজন্মের মৃত্যু হলে পূর্বতন পিতৃগণের স্বর্গপ্রাপ্তি হয়। তাই যতদিন পিতৃলোকে পূর্বপুরুষগণ বাস করেন ততদিন আমাদের বিশেষ দিনে শ্রদ্ধাসহকারে শ্রাদ্ধ ও জলদান করা আবশ্যক। এই হল তর্পণের বিধি। তর্পণের সময় আমরা ব্রহ্মার মানসপুত্র ঋষিদের জলদান করি, ব্রহ্মচারী পিতামহ ভীষ্মকে জল দান করি, আবার তার সঙ্গে পরিবারের সপ্তপুরুষ, মাতৃকুল ও পিতৃকুলের উদ্দেশে তর্পণ করি। এইভাবে শাস্ত্র আমাদের মনকে বিরাটের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। গরুড় পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, পূর্ব-পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে তর্পণ করলে স্বাস্থ্য, সম্পদ, জ্ঞান, দীর্ঘায়ু, স্বর্গ ও মোক্ষ লাভ হয়।
পিতৃপক্ষের শ্রাদ্ধকার্যের পাশাপাশি পক্ষকাল ধরে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গ্রামাঙ্গনে শুরু হয় আগমনী গান। দেবী আগমনের প্রথম সুর শিউলির সুবাস মেখে গুঞ্জরিত হয় মানুষের মনে। সেই গানের মাধ্যমেই গিরিরাজের কাছে মা মেনকা করুণ নিবেদন রাখেন। ভিখারী শিবের কাছ থেকে গিরিনন্দিনীকে কয়েক দিনের জন্য বাপের বাড়ি নিয়ে আসতে হবে, কন্যাকে চোখে দেখার জন্য মেনকা উন্মাদপ্রায়, ব্যাকুল। এই গানে শ্মশানচারী গরিব শিব গৃহিণীর করুণ বারমাস্যার কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। স্বামী ভোলানাথ, কোনও উপার্জন নেই! একদিন যদি ভিক্ষাগ্রহণে বের হন তবে শিবাণীকে চব্বিশপদ রান্নার ফরমায়েশ করেন। আবার দু’টি পুত্র— একটি ষঢ়ানন অপরটি গজানন। যা রান্না হয়, তার অধিকাংশই তাদের উদরপূর্তিতে যায়। একজন খান হাতির খাবার আর অপরজন ছয় মুখে অন্নগ্রহণ করেন। হিমালয় কন্যা দেবী পার্বতীর তাই দুঃখের শেষ নেই!
দশপ্রহরণধারিণী পরম শক্তিময়ী দেবীকে আমরা নিজের ঘরের মেয়ের মতো অসহায় সংগ্রামী করে তুলেছি মঙ্গলকাব্যের কথকতার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি কাব্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। পুরাণের দেবী দুর্গা মধ্যযুগে কাব্যের মাধ্যমে যে ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছেন, তাতে নিদারুণ সামাজিক অবস্থায় আমাদের ঘরের নারীদের অবস্থাই প্রতিফলিত হয়েছে। সুখেদুখে মেশা সেই নারীর জীবন, যেখানে স্বামী দরিদ্র হলে মায়ের অবহেলাও সইতে হয়! একবার সখীদের নিয়ে খেলায় মগ্ন ছিলেন দেবী, মা মেনকা উনুনে দুধ বসিয়ে কার্যান্তরে গিয়েছেন। দুধ উথলে পুড়ে অঙ্গার হলেও পার্বতীর খেলা ভঙ্গ হল না! ফিরে এসে মেনকা চটলেন বিস্তর! ভিখারী স্বামী যার, তার এত সুখী হওয়া সাজে কি? যতই রাজনন্দিনী হন না কেন, রাজরাণী তো আর নন! স্বামীর ধনসম্পদ তখন নারীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সমাজের খুঁটিনাটি উঠে এসেছে মঙ্গলকাব্যে, সেখানে নারীর পোশাক থেকে রান্নার বত্রিশ পদ, সব কিছুরই হদিশ মিলবে। সাহিত্যের পথেই অসুরনিধনকারী, বিশ্ব বিমোহিনী রূপে দেব অস্ত্রে সজ্জিত মহাশক্তি বাঙালির কাছে কন্যারূপেই ধরা দিয়েছেন। এই রূপান্তরের ধারাপথ পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষকে এক অপূর্ব আলোকগ্রন্থিতে আবদ্ধ করেছে। বেজে উঠেছে আলোর বেণু।