প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
দিনের প্রথম আলোটুকু এমনই হয়। তাতে বেলাভূমির এক অনাদরে পড়ে থাকা ঝিনুকও মুক্তোর মতো ঝকঝক করে। এরপর সাগরের ঢেউ এসে সেই ঝিনুক শিকার করে নিয়ে যায়। আবার আর এক ঢেউয়ের পিঠে চেপে সৈকতে ফিরে আসে সে। সেই কমলা রঙের সকালে এমন মজার লুকোচুরি খেলা দেখে একটি বছর নয়-দশের বালিকা হাততালি দিয়ে ওঠে। দুই বিনুনি করা চুল দুলিয়ে সে বলে, ‘দাদু, ম্যাজিক’! দাদু তখন তাঁর এই একরত্তি নাতনিকে বলেন, ‘সমুদ্র তো জীবনের মতোই রে দিদি, সে যেমন অনেক কিছু নেয়, তেমনি সব কিছু ফেরতও দেয়।’
সেই যে বালিকা, অনেক অনেক বড় হয়েও সে সেই সব সকালগুলি ভোলেনি। কমলা হ্যারিসকে এখনও নাম ধরে পিছু ডাকে সেই ‘কমলা রঙের দিনগুলি’! কমলার দাদু পি ভি গোপালন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং পরে স্বাধীন ভারতের দুঁদে আমলা। আপসহীন আদর্শপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর। নাতনিকে বেশি কাছে পাননি তিনি। কিন্তু মেয়ে, কমলার মা শ্যামলাকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছিলেন। শ্যামলা দেশ ছেড়ে আমেরিকাতে আসেন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। সেখানেই আদর্শের উত্তরাধিকার তাঁকে ঠেলে দেয় সেই সময়ের আমেরিকার নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের অগ্নিবলয়ে। মেধাবী বিজ্ঞানী শ্যামলা হয়ে ওঠেন সামাজিক সুবিচার আন্দোলনের এগিয়ে থাকা মুখ। মিছিলেই তাঁর পরিচয় হয় জামাইকার কৃতী যুবক ডোনাল্ড হ্যারিসের সঙ্গে। এভাবেই দু’জনের প্রণয় ও পরিণয়। এবং তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় কমলা ও মায়া।
কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য শ্যামলার একক লড়াকু জীবন শুরু হয়, ডোনাল্ডের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর। কমলার বয়স তখন সবে ছয়। একই সঙ্গে ‘বাবা ও মা’ শ্যামলা অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলেছিলেন দুই কন্যাকে। তাই শুধু তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটি নন, মায়াও সব সময় বলেন, ‘এখন আপনারা যে কমলাকে দেখছেন, সে আসলে শ্যামলার নতুন প্রজন্ম। দিদি প্রকৃত অর্থেই মায়ের আত্মজা’! শত ব্যস্ততার মধ্যেও দু’বছরে একবার দুই মেয়েকে নিয়ে আমেরিকা থেকে ‘বাপের বাড়ি’ চেন্নাই যেতেন শ্যামলা। আর তখনই প্রতিদিন বড় নাতনিকে ‘নীল সাগরের কমলা সকাল’ দেখাতে নিয়ে যেতেন গোপালন। দাদু এবং মায়ের কাছ থেকেই সারা পৃথিবীর ইতিহাস ভূগোলের শিক্ষা পেয়েছিলেন কমলা। তাঁদের কাছ থেকেই কমলা দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বাধীনতা, সুবিচার ও সাম্যের। রাজনীতি করতে গিয়ে সংসারটুকু করার সময় পর্যন্ত পাননি কমলা। বছর ছয়েক আগে, পঞ্চাশ বছর বয়সে সাদা আমেরিকান ডগলাস এমহফকে বিয়ে করেন তিনি। তাই, ‘আমাকে নয়, আমার ইতিহাসকে জানুন’, এই কথাটা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন কমলা।
এই কমলাকেই ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন। ঐতিহাসিক ঘটনাই বটে। আমেরিকার সালতামামিতে ‘সম্ভাব্য মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে কমলা তিন নম্বর, ওই অভিধায় অশ্বেতাঙ্গ মহিলা হিসেবে তিনিই প্রথম, এবং অবশ্যই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা হিসেবেও প্রথম। পেশায় আইনজীবী এবং সুবক্তা কমলা আদালতের চোখা সওয়ালের মতোই রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গে সমান তালে তর্ক করেন। ঘাড় ঝাঁকিয়ে তেজি সুরে কথা বলেন দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশে। এ ব্যাপারে কমলা এক্কেবারে ‘মায়ের মেয়ে’!
যদিও ডেমোক্র্যাটিকদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর দৌড়ে কিছুদিন আগেই বাইডেনের কাছে হেরেছেন কমলা। সেই বাইডেনই আবার ‘ভোটে জিততে’ তাঁকে দলে টেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাতে কতটা সুফল ফলবে, তা বলা মুশকিল। রিপাবলিকানরা বলছে বটে যে, কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয়-মার্কিনদের ভোট টানতেই বাইডেন শিখণ্ডী খাড়া করেছেন কমলাকে। যদিও ওই দুই সম্প্রদায়ের কারও কাছেই কমলা ‘বিকল্পহীন পছন্দ’ নন। সেটা অবশ্য অযোগ্যতার কারণে নয়, বরং কমলার রাজনীতির কলাকৌশলের কিছু ত্রুটির পরিণামে। কিন্তু সেই নির্বাচনী চালচিত্রের বাইরে, আমেরিকার সুশীল সমাজ কমলাকে স্রেফ একজন ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী’ হিসেবে দেখছে না। বরং তারা কমলাকে বিবেচনা করছে সমকালের মার্কিন মুলুকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক সামাজিক প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে! কী সেটা? কমলার হাতে যেহেতু মেহেন্দির রং, যেহেতু কাঁটাচামচ ছেড়ে তিনি হাত দিয়ে ইদলি-দোসা খান, সেহেতু ‘শ্বেতমৌলবাদী’ আমেরিকা তাঁকে প্রশ্ন করতেই পারে, ‘আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’ অথচ কমলা জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক, বিবাহসূত্রেও। তবু ওই ‘ইন্ডিয়া’ ব্যাপারটা এসেই যাচ্ছে, কারণ এখনকার আমেরিকায় ‘চামড়ার রং’ করোনার মতোই একটা জঘন্যতম সংক্রমণ! এবং কমলা এক্ষেত্রে ‘কোমরবিড’, কারণ তিনি না-এশিয়ান, না-আফ্রিকান, না-আমেরিকান। তাঁর একটাই পরিচয়, তিনি অভিবাসী। এই ‘অভিবাসী’ শব্দটা বাস্তবে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীর সমতুল।
মোদ্দা কথাটা হল, কমলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন, কি হবেন না, সেটা হালের আমেরিকার সমাজজীবনে তেমন কোনও আহামরি ব্যাপার নয়। তার চেয়ে অনেক বৃহত্তর সমীকরণ হল, কমলা কি ‘অতিথিবৎসল’ আমেরিকাকে, ‘বহুজাতিবাদ’-এর আমেরিকাকে চিরস্থায়ী করতে পারবেন? নাকি তাঁর গায়ের রং দেখে ভাবীকালের আমেরিকা কমলাকে প্রশ্ন করবে, ‘হোয়্যার আর ইউ ফ্রম’?