প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
২০০৫ সালে কার্গিল গিয়েছিলাম। একপাশে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আর অন্য পাশে বহু নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুরু নদী। নদীর গা বেয়ে উঠে গিয়েছে বিশাল আর এক পাহাড়। পাহাড়ের ওপাড়েই পাকিস্তান। প্রথম দর্শনে কার্গিল দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। শহরে ঢোকার মুখেই গুলিবিধ্বস্ত ঘরবাড়ি যেন যুদ্ধের নীরব সাক্ষী। দুর্গম রাস্তাঘাট, বন্ধুর আবহাওয়া আর রুক্ষ প্রকৃতি সেই প্রতিকূলতারই আভাস দিচ্ছে। এ হেন পরিবেশে নিস্তরঙ্গ নদীর অবিরাম বয়ে চলা একটুকরো শান্তির সঙ্কেত। দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। কার্গিল শহরে ঢুকে পড়লাম আমরা। ‘গুঞ্জন সাক্সেনা: দা কার্গিল গার্ল’ ছবিটা কার্গিলের সেই সুরু নদীকে সমুখে রেখে শুরু হলেও যুদ্ধ বা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং পথ বদলে পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের স্বপ্নের উড়ান হয়ে উঠেছে এই ছবির কেন্দ্রবিন্দু। ছবির নাম ভূমিকায় তাই আইএএফ পাইলট গুঞ্জন সাক্সেনা। নিজের ওপর তৈরি ছবিটি দেখার পর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাঁর? বললেন, অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ছবির দোষ ত্রুটি কিছুই তখন ধরা পড়েনি। হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে ওড়ার সময় যেমন রোমাঞ্চ হয়, ছবিটা দেখেও ঠিক তেমন হয়েছিল তাঁর।
এই ছবি মেয়েদের আকাশছোঁয়া সাফল্যের গায়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিধিনিষেধের দাগ লাগিয়েছে। মেয়েদের স্বপ্নের উড়ান যে কত রকম বাধার সম্মুখীন, তা বারবার বলেছে। আর তাই মুক্তির পর থেকেই ছবিটি হয়ে উঠেছে বহু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। অভিযোগের আঙুল তুলে প্রযোজকের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। কিন্তু আজ সে বিতর্কে নাই বা গেলাম। আমরা বরং কার্গিল কন্যা গুঞ্জন সাক্সেনার মুখেই শুনি তাঁর জীবন-উড়ানের কাহিনী। মেসেঞ্জারে কথা হল তাঁর সঙ্গে।
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
‘আমার বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। ছোট থেকেই তাই আমাদের বাড়ির পরিবেশ আলাদা। সেই ভিন্ন পরিবেশই বোধহয় আমার ভাবনাচিন্তাগুলো অন্য ছন্দে বেঁধে দিয়েছিল’, বললেন গুঞ্জন। প্লেনের জানলা দিয়ে আকাশ দেখার নেশা ছিল তাঁর। গুঞ্জনের কথায়, ‘প্লেন ওড়ানোর ইচ্ছে ছিল ছোটবেলায়। তখন ভাবিনি এয়ার ফোর্সের পাইলট হব। সেটা বাড়ির প্রভাব বলতে পারেন। কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটা আমার একান্ত নিজের। আমি ভাগ্যবান, এমন ভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখায় কোনও বাধা পাইনি।’
কেরিয়ার শুরুর দিনগুলো
কোনও পেশায় যখন বড় ধরনের বদল আসে, তখন একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় পেশায় বর্তমান লোকজনের মধ্যে, বললেন কার্গিল-কন্যা গুঞ্জন। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রথম এয়ার ফোর্স পাইলট হিসেবে যখন যোগ দিলাম, তখন আমার সঙ্গে আরও পঁচিশজন মহিলাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। সেই সময় এয়ার ফোর্সে আমরা একটা মহিলা টিম হিসেবে কাজ করতাম। একে অপরকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত থাকতাম। নাহলে পুরুষ অধ্যুষিত চাকরিক্ষেত্রে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যেত।’ কেমন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, জানতে চাইলে গুঞ্জন বলেন, অনেকদিন আগের কথা। সব স্মৃতি তাঁর মনেও নেই। তাছাড়া স্মৃতি সততই সুখের। ফলে পুরুষ সহকর্মীদের সাহায্য যতটা মনে পড়ে, তাঁদের বিরূপ মনোভাব ততটা পীড়িত করে না আর। তবু একটা মজার ঘটনা মনে পড়লে আজও হাসি পায় গুঞ্জনের। ‘সেই সময় মেয়েদের কোনও চেঞ্জিং রুম ছিল না। আসলে এয়ার ফোর্সে তার আগে কোনও মহিলাই ছিল না যে। তাই হেলিকপ্টার ওড়ানোর আগে ইউনিফর্ম বদলানোর জন্য আমরা মেয়েরাই এক অভিনব পন্থা বার করেছিলাম। একজন পোশাক বদলালে বাকি ২৪ জন তাকে ঘিরে গার্ড দিতাম। এইভাবে সবাই পোশাক বদল করতাম।’ পুরুষ সহকর্মীদের কটাক্ষ শুনতে হয়নি এই নিয়ে? প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গুঞ্জন উত্তর দিলেন, ‘অনেকে অবাক হতেন, অনেকে মেনে নিতেন, কেউ বা আদৌ বিচলিত হতেন না।’
কার্গিলের সময়টা
‘১৯৯৯ সালে, প্রথম যখন উধমপুরে পোস্টিংয়ের নোটিস পেলাম, তখন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি অমন যুদ্ধে সামিল হতে হবে। বাড়িতে শুধু পোস্টিংয়ের খবর জানিয়েছিলাম। সঙ্গে বলেছিলাম, যোগাযোগ করতে না পারলে যেন কেউ চিন্তা না করেন। আমাদের সেনাবাহিনীর বাড়ি। বাবা কর্নেল ছিলেন। এই নিয়ে তাই বিশেষ প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু উধমপুর পৌঁছেই পরিস্থিতি টের পেতে শুরু করলাম। অচিরেই ‘চিতা’ হেলিকপ্টার নিয়ে কার্গিল, বাতালিক ও দ্রাস সেক্টরে আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। সেইসব অঞ্চলের পরিস্থিতি দেখে এসে রিপোর্ট করতাম। প্রথম যেদিন সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ পাই, সেই দিনটি জীবনে ভুলব না। সে এক চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা। অসম্ভব উত্তেজনায় ছটফট করছিলাম মনে মনে। দেশের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করার সুযোগ সবার হয় না। আমি ভাগ্যবান, দেশের কাজে লাগতে পেরেছি।’ একটানা কথাগুলো বললেন গুঞ্জন। তারপর একটু থেমে বললেন, তাঁর আগে মহিলারা যুদ্ধবিমান ওড়ানোর সুযোগ পাননি কখনও। তাই একইসঙ্গে দু’রকম ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন তিনি। এবং সেইজন্য যথেষ্ট গর্বিতও বটে। প্রথম দিকে ওষুধ, খাবার ইত্যাদি এয়ার-ড্রপ করার সুযোগ পেতেন। ক্রমে একদিন আহত সেনা উদ্ধারের সুযোগ ঘটল।
‘সে এক অন্য ধরনের রোমাঞ্চ’, জানালেন কার্গিল গার্ল। ‘আকাশে ওড়ার জন্য একটা স্বপ্ন লাগে ঠিকই, কিন্তু সেনাবাহিনীতে কাজ করতে লাগে সাহস। আর সেই সাহসটা কাজের মাধ্যমে ক্রমশ অর্জন করা যায়। মহিলা বলে আমাকে ডিউটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য আমি পিছিয়ে যাইনি। আহত সেনা উদ্ধার করার আনন্দের ভাগ ছাড়ব কেন? সেনাবাহিনীতে নাম যখন লিখিয়েছি, তখন তার ভালো মন্দ সবেরই সাক্ষী থাকার পণ করেছি। সেই পণ ভাঙার পাত্রী আমি নই।’
বিতর্কের জবাব
কিছু স্মৃতি হয়তো কটু, তবে বেশিরভাগই মধুর, জানালেন গুঞ্জন। তাঁর কথায়, ‘যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমায় ও অামার আর এক সহকর্মী শ্রীবিদ্যাকে সক্রিয়ভাবে দেখে অনেক সহকর্মীরই চোখ কপালে উঠেছিল। আমরা আদৌ কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে পারব কিনা, সে নিয়ে প্রশ্নও যে কেউ তোলেননি তা নয়।
কিন্তু যত দিন কেটেছে, আমাদের প্রতি সহকর্মীদের ব্যবহার ততই স্বাভাবিক হয়েছে। শেষের দিকে আমাদের বন্ধুত্বও জমে উঠেছিল। আমার এক কো-পাইলটকে বিয়ে করেছি আমি। অতএব সবটাই মন্দ, তাই বা বলি কী করে? আশার কথা এই যে সেনাবাহিনীতে নারীর অবস্থান ক্রমশ উন্নত হয়েছে। এখন তো মেয়েরা স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবেও কাজ করছেন। পুরুষতন্ত্র আছে, থাকবেও। তবু তারই মাঝে ডানা মেলে উড়তে হবে েময়েদের। আমি জানি স্বপ্নের ডানায় চড়ে দূরদূরান্তে পাড়ি জমাতে মেয়েরাই পারে।’
গুঞ্জন ম্যাডামের সান্নিধ্য আমায় সাহস জুগিয়েছে : জাহ্নবী কাপুর
গুঞ্জন সাক্সেনার চরিত্রে অভিনয় করাটা আমার জীবনের খুবই উল্লেখযোগ্য কাজ। ছবিটা করে কিছুদিন খুশির জোয়ারে ভেসেছিলাম। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর বিতর্কের ঝড় উঠল। আমি একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। কিছুটা হয়তো ভেঙেও পড়েছিলাম। কিন্তু গুঞ্জন ম্যাডামের প্রতিক্রিয়া আমায় লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে।
ছবিটার শ্যুটিং চলাকালীন গুঞ্জন ম্যাডামের সঙ্গে প্রথম আলাপ হল। ওঁর সম্পর্কে তার আগে পড়েছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম, তা আমার সব হোমওয়ার্ক, ধারণা বদলে দিয়েছিল। ভীষণ সাধারণ, স্বাভাবিক মহিলা গুঞ্জন। অথচ ওঁর দৃষ্টির মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে। একটা আগুন আছে। আমি অভিনয়ের মাধ্যমে ওঁর চরিত্রের সেই আগুনটা বার করার চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি, জানি না। তবে ম্যাডাম যখন ছবিটা দেখে প্রশংসা করলেন, তখন অসম্ভব ভালো লেগেছিল। উনি বলেছিলেন, ‘আমার ভেতরের সব অনুভূতি কী অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছ তুমি। এমন কথা বলেছ এই চরিত্রটার মাধ্যমে যা ইচ্ছা থাকলেও হয়তো আমি বলে উঠতে পারিনি। ফলে বিতর্ক উঠলে উঠুক, তবু অভিনয়ে তোমাকে আমি ফুল মার্কস দেব।’ ওঁর মন্তব্য শুনে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। কোমর বেঁধে লড়াই করার সাহস পেয়ে গিয়েছিলাম। গুঞ্জন সাক্সেনার চরিত্রটার সঙ্গে ব্যক্তি জাহ্নবী কাপুরের মিল একটাই, দু’জনেই কঠোর পরিশ্রম আর নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে চলতে পারি। সেই বিশ্বাস আমাদের স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। এবং ওই বিশ্বাসের উপর ভর করেই ইচ্ছেগুলো বাস্তব রূপ পায়।