প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
সাল ২০১২। লন্ডনের অভিবাসন দপ্তরের আধিকারিকের চক্ষু চড়কগাছ! আব্দুল মোবুদুরের পাসপার্ট বলছে, তাঁর জন্ম ১৮৩২ সালে। হিসেব কষলে দাঁড়াচ্ছে ১৮০ বছর! এত বছর কেউ বাঁচে নাকি! মোবুদুরও ছাড়ার পাত্র নন। তাঁর দাবি, যে গ্রামে তিনি বাস করেন, সেখানকার মানুষের গড় আয়ু নাকি ১২০ বছর! শুধু তা-ই নয়, দুর্গম পাহাড়ি সেই অঞ্চলের মেয়েরা কীভাবে বদলে দিচ্ছে গোটা প্রদেশ, অভিবাসন দপ্তরের আধিকারিককে সে কথাও জানান তিনি। কেমন সে প্রদেশ
২০১২-র এই ঘটনা গোটা দুনিয়ার নজর আমূল ঘুরিয়ে দেয় পাকিস্তানের উত্তরে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের একটা ছায়াসুনিবিড় গ্রামের দিকে। কারাকোরাম, পশ্চিম হিমালয়, পামির ও হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী দিয়ে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর প্রদেশ গিলগিট-বাল্টিস্তান। এরই উত্তরে হুনজা উপত্যকা। নিসর্গ এখানে মানুষের পাশে হাঁটে।
২০১২ থেকে ২০২০। এই আট বছরে গবেষক, পর্যটকরা যতই হুনজা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, ততই তাঁদের জন্য থরে-বিথরে চমক সাজিয়ে দিয়েছে হুনজারা। তাঁদের আয়ুষ্কাল ছাপিয়ে সে চমক এক অন্য বিপ্লবের গল্প শোনায়। নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতার এক জীবন্ত উপাখ্যান যেন এই পাহাড়ি প্রদেশে ঘুরে বেড়ায়। কেমন সে উপাখ্যান?
অন্ধকারে আলো
দেশের এক কোনায় পড়ে থাকা পাহাড়ি এই গ্রাম সূর্যাস্তের পরই নিঝুম অন্ধকারপুর। পাহাড়-জঙ্গল মিলিয়ে এক দুর্বোধ্য গম্ভীর এলাকা। এক সময় অবধি তা-ই ছিল। ছবিটা বদলাতে শুরু করল ২০০০-এর পর থেকে। অন্ধকার নামলেও টিমটিমে আলোয় ভরসা করেই গ্রামের বাজারে কাজ করতে শুরু করলেন মেয়েরা। সন্ধের পরেও তখন রুটিরুজির তাগিদে নানা কাজ করতে শুরু করলেন তাঁরা। দু’টো বাড়তি রোজগার বাড়িয়ে দিল সাহস। দেখা দিল অন্ধকারে আলোর দিশা।
দেখব এবার জগৎটাকে
দিনে দিনে সাহসে ভর করে হুনজা প্রদেশের মেয়েরা পা বাড়ালেন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও। সালটা ২০১৩। ছোটবেলায় নিজের প্রদেশের চারপাশের পাহাড়গুলোয় ওঠা ছিল যে মেয়ের নেশা, সেই সামিনা বাইগ জয় করে ফেললেন মাউন্ট এভারেস্ট! তাও আবার কনিষ্ঠতম পর্বতারোহী হিসেবে। এমনকী, বিশ্বে প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে জয় করে ফেললেন কারাকোরামের ‘চাসকিন সার’ শৃঙ্গটি। তাঁর সম্মানে তাই এই শৃঙ্গের নামকরণ হয় ‘সামিনা পিক’। ২০১৫-য় ফের সাফল্য। গ্রামের সবচেয়ে ছটফটে মেয়েটা সূর্যাস্তের পরেও হ্যাজাকের আলোয় চালিয়ে যেত তার ব্যাট-বলের প্র্যাকটিস। ফল মিলল হাতেনাতে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক মহিলা ক্রিকেটে ডাক পেলেন ডানহাতি মিডিয়াম পেসার দিয়ানা বাইগ! হুনজা মেয়েরা ছড়িয়ে পড়ল ক্রিকেটীয় সভ্যতায়। এমনকী, হুনজা প্রদেশেও ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে মহিলা স্পোর্টস লিগ!
লেখাপড়ার মতিগতি
গোটা দেশের নিরিখে তাদের নিজস্ব প্রদেশে শিক্ষিত-হারও অনেক বেশি। প্রায় ৯৫ শতাংশ। হুনজা এলাকায় সরকারি স্কুলে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই মেয়ে।
নারীর ক্ষমতায়ন
শিক্ষাকে কাজে লাগাতে ২০০৯-এ ‘সিকোয়াম’ নামে মহিলাদের জন্য এক সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ তৈরি করলেন তাঁরা। নারীজাগরণের বিপ্লবে ঢুকে পড়ল আর্থিক বিপ্লবও। কাঠের কাজ, হাতের কাজ, নানা রকম ক্রাফ্টিং দিয়ে এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ধাঁচে নিজেদের রুটিরুজি জোগান দিতে শুরু করলেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানে প্রথম মহিলাচালিত ক্যাফেও বানিয়ে ফেলেছেন হুনজার মেয়েরা! এই ক্যাফে শুধু পরিচালনা করাই নয়, ২০১২-তে নির্মাণের গোটা দায়িত্বও সামলেছেন তাঁরাই। মেনুতে রেখেছেন তাঁদের প্রদেশেরই নানা জৈবিক খাবার!
সংস্কৃতির বাহক
জীবনযুদ্ধ লড়তে লড়তে হুনজারা হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের প্রদেশের গান-বাজনার ঐতিহ্যকে। তা ফিরিয়ে আনতে ২০১৬ সালে সিকোয়াম-এর উদ্যোগে ‘লেফ লারসন মিউজিক সেন্টার’ খোলা হয়। এখান থেকেই প্রথম মহিলা রাবাব শিল্পী সুনেইরা বাইগ ও সানিয়া তাজ আন্তর্জাতিক স্তরে হুনজাদের গানবাজনাকে পৌঁছে দেন। সানিয়া প্রথম বুরুশাকি গায়িকা হিসেবেও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন।
শারীরিক বল
যেহেতু ১২০ বছর গড় আয়ু, তাই ৭০-৮০-তে পৌঁছেও বার্ধক্যের স্বাদ পান না হুনজা নারী বা পুরুষ। ৭০ বছর বয়সেও সন্তানধারণ করতে পারেন হুনজা-নারী। উদ্বেগ, মানসিক চাপ এসব ছুঁতেও পারে না। ক্যানসার, ডায়াবিটিস, টিউমার এসব ভিলেনের নামই শোনেননি তাঁরা! সত্তরোর্ধ্ব হুনজা নারী-পুরুষের কাছে দুর্গম পথে প্রতিদিন ১০-১৫ কিমি হাঁটা একেবারে জলভাত। বয়স ১০০ পেরলেও ৪০-৫০ কেজি শস্যের বস্তা অনায়াসেই পিঠে বা মাথায় চাপিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম এঁরা।
শক্তির নেপথ্য
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন হুনজাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার বিষয়টি ততটা সত্যি নয়। বরং ক্যালেন্ডার ও বয়সের কোনও নথি না থাকায় তাঁদের বয়স সম্পর্কে ধারণা ঠিক নয়। তাঁরা অসুস্থও হন, তবে দ্রুত রোগ সারিয়ে উঠতে পারেন। তবে আর এক দল মনে করেন, হুনজাদের দীর্ঘায়ু ও নীরোগ থাকার নেপথ্যে রয়েছে দূষণমুক্ত পরিবেশ, হিমবাহের জল, দুর্গম পাহাড়ে শ্রম ও প্রাকৃতিক খাবার।
তবে মন্ত্রগুপ্তি যা-ই হোক, তামাম বিশ্বকে চমকে দিয়ে জীবনের স্লগ ওভারে ঝোড়ো ব্যাটিং করে চলেছেন হুনজারা। আর সেই দীর্ঘ জীবনে নিয়ত নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নের অন্য বিপ্লব এঁকে চলেন হুনজা মেয়েরা!
ডায়েট চার্ট
দিনে মাত্র দু’বার খাবার খান হুনজারা। ভারী ব্রেকফাস্ট দিয়ে শুরু করেন দিন। আর তা শেষ হয় সূর্যাস্তের পর হালকা খাবার খেয়ে। হুনজাদের প্রাকৃতিক ক্ষমতা সামনে আসতেই তাঁদের খাদ্যাভ্যাস নিয়েও শুরু হয়েছে গবেষণা। গবেষকদের মতে, এঁরা খাবারের জন্য মূলত নির্ভর করেন খোবানি বা অ্যাপ্রিকট জাতীয় ফলের উপর। মার্কিন জিওলজিস্ট জন ক্লাের্কর বইও তারই হদিশ দেয়। তাঁর মতে, খোবানির পাশে লেবু জাতীয় ফল, বাদাম, শিম, ভুট্টা, বার্লি ও বাজরার মতো শস্যও থাকে তাঁদের পাতে। মাংস প্রায় খানই না। খেলেও বছরে এক দু’বার ভেড়া বা মুরগির মাংস খান। মাখন, ডিম, দুধ, চিজ পনিরও তুলনায় কম খান। তুমুরু নামের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ এক ধরনের গাছের পাতা ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করেন ওঁরা। এই পাতায় জীবনীশক্তির অনেকটা লুকিয়ে বলে দাবি গবেষকদের।