ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর এমন হঠাৎ ‘রাষ্ট্রহীন’ মানুষের সংখ্যা ১৯ লক্ষ ছাড়িয়েছে। অপরাধ, তাঁরা কেউ এদেশের নাগরিক হওয়ার মতো যথাযথ কাগজপত্র এনআরসির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের সামনে পেশ করতে পারেননি। আর তাই এই ১৯ লক্ষ মানুষ বলতে পারবেন না, তাঁরা ভারতীয়। উদ্যোগটা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। উঠতেও পারে না। কারণ, শীর্ষ আদালত এই প্রক্রিয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সীমান্তবর্তী ওই রাজ্যে ফাঁকতালে ঢুকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বসবাসকারী বহু ‘বিদেশি’কে চিহ্নিত করার জন্য। হয়তো তারা বাংলাদেশি। হয়তো নয়। মোদ্দা কথা হল, সীমান্তে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে আসবে, আর এই নেতা ওই নেতাকে ধরে ভোটার বা আধার কার্ড বানিয়ে ভারতীয় হয়ে যাবে... এটা চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যাদের ‘ঘুসপেটিয়ো’ বলে থাকেন আর কী! তাই ক্যাম্প বানাও, বিদেশি হটাও। প্রশ্ন এখানে দু’টি, ১) যে পদ্ধতিতে নাগরিক বা অ-নাগরিক বাছাই হয়েছে সেটা কি ঠিক? এবং ২) যাঁরা চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেলেন না, অর্থাৎ এই ১৯ লক্ষ ‘রাতারাতি রাষ্ট্রহীনের’ ভবিষ্যৎ কী?
আসা যাক প্রথম প্রশ্নে। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে খেদানোর পাইলট প্রজেক্ট কিন্তু মোদি জমানার নয়! অনুপ্রবেশকারী বলতে যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর এদেশে এসেছেন। প্রক্রিয়াটির সূচনা হয়েছিল ২০১০ সালে। অসম থেকেই। তবে গোটা রাজ্য নয়। দু’টি মাত্র সার্কেলে। একটি কামরূপ জেলা, আর অন্যটি বরপেটা। চার সপ্তাহের
মধ্যেই সরকারকে পাততাড়ি গুটাতে হয়। কারণ, ভারতীয় বাছাই শুরু হওয়া মাত্র যেভাবে গোটা অসমে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে, তা সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। উন্মত্ত জনতা বরপেটায় ডেপুটি কমিশনারের অফিসে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায় পুলিস। তাতে চারজনের মৃত্যু হয়। মোটামুটি তালা ঝুলে যায় এনআরসি ক্যাম্পে। তিন বছর পর, ২০১৩
সালে প্রক্রিয়াটি ফের শুরু করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি রোহিংটন ফলি নরিম্যানের বেঞ্চ কেন্দ্র ও অসম সরকারকে এনআরসির ঝুলে থাকা প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দেশ দেয়।
২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারির পর প্রায় ছ’বছর লাগল অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা তৈরিতে। খরচ হল ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তারপরও বিতর্ক থামল না। কেন? কারণ, এমন অনেকেই চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পাননি, যাঁদের বাদ যাওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারই তালিকায় জায়গা পায়নি। বাদ গিয়েছেন শহিদ কোনও সিআরপিএফ জওয়ানের বাড়ির লোক, আবার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর পরিবারও। অসমের এক প্রান্তে যে নথি দেখে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়েছে, অন্য প্রান্তে সেই ধরনের পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে মাথা কুটেও দেশের নাগরিক হয়ে উঠতে পারেননি অনেকে। এই বৈষম্যের কারণটা কী? উত্তর একটাই হতে পারে—প্রক্রিয়া কার্যকর করাতেই বড়সড় গলদ থেকে গিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা। অথচ জন্ম জন্মান্তর ভারতের মাটিকেই আঁকড়ে থাকা বহু মানুষ আজ অ-ভারতীয় হয়ে গিয়েছেন। অসমের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা পর্যন্ত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গোটা দেশে এনআরসি চালু করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার ভোটের আগে যে হারে উঠেপড়ে নেমেছিল, সেই আগ্রাসন কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। হয়তো এবার পর্যালোচনা হবে! কিন্তু আসল কথাটা হল, পদ্ধতি মোটেও ঠিক ছিল না। বহু সত্যিকারের ভারতীয়ের নাগরিকত্ব চলে যাওয়াটাই যার প্রমাণ।
তাহলে কি ধর্মীয় মেরুকরণ কি কোনওভাবে এর জন্য দায়ী? এই প্রশ্ন কিন্তু বিজেপিকে তাড়া করতে শুরু করেছে। ধরে নেওয়া যাক কাছাড় এলাকার কথা। এখানে একটা সময় হিন্দু বাঙালিরাই সংখ্যাগুরু ছিল। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর নামে শাসক দলের দিন কে রাত করার প্রবণতা এই এলাকার জনবিন্যাস গত কয়েক দশকে বদলে দিয়েছে। এই এলাকায় গেলে এখন বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদেরই বেশি দেখতে পাওয়া যাবে। যাঁদের বেশিরভাগই হয়তো আটের দশকে বা তারও পরে এখানে এসেছেন। এবং তৎকালীন রাজ্য সরকারের বদান্যতায় ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড বানিয়ে পাকাপাকিভাবে ভারতীয় হয়ে গিয়েছেন। বহু অঞ্চলের ডেমোগ্রাফি বা জনবিন্যাস এভাবে বদলে যাওয়ায় অতীতে অসমীয়া বনাম বাঙালি যে তীব্র জাতিবিদ্বেষ এবং আন্দোলন, তা ১০ বছরে পুরোপুরি স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। ভাষা নয়, এভাবেই চোরাস্রোতের মতো অসমে বেড়ে গিয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণ। বিরোধীদের অভিযোগ, এর সুবিধা নিয়েছে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় তার প্রভাব পড়ার অভিযোগও বহু বিরোধী দল করেছে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। কী হবে এই ‘রাষ্ট্রহীন’দের? সরকারি উত্তর, ১২০ দিন সময় আছে। সোজা চলে যান ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। আবেদন করুন। ট্রাইব্যুনাল পর্যালোচনা করে দেখবে। বিচারকরা যদি মনে করেন, তালিকায় নাম চলে আসবে! আর না হলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যেতেই পারেন। মামলা চলবে। ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁর পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকেই ভারতে রয়েছেন। কিন্তু ১৯ লক্ষ মানুষের আবেদন পর্যালোচনা করতে কত সময় লাগবে? নিশ্চয়ই ১২০ দিনে সবটা সেরে ফেলা সম্ভব নয়? আরও বড় প্রশ্ন হল, এই লক্ষ লক্ষ মানুষ কি ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে পারবেন? অসমে ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আছে এবং সরকার আরও ২০০টি করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? এতদিন ধরে তো সেই সব মানুষ
যাবতীয় কাগজপত্র পেশ করেই রেখেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তিনি বা তাঁর পূর্বপুরুষরা উল্লিখিত ওই তারিখের আগেই ভারতে এসেছেন। তালিকা প্রস্তুতের সময় সেই কাগজপত্র মান্যতা পায়নি। ট্রাইব্যুনালে গিয়ে তো তাঁরা আর নতুন কোনও কাগজ তৈরি করতে পারবেন না! তাহলে লাভটা কী?
ততদিন কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি কোনও সুযোগ-সুবিধা পাবেন না ওই ‘অ-ভারতীয়’রা। অর্থাৎ, তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না। খাদ্য সুরক্ষা বা শিক্ষার অধিকার আইনের ভিত্তিতে তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে কিছু দাবি করতে পারবেন না। নরেন্দ্র মোদির আয়ুষ্মান ভারতের কার্ডও পৌঁছবে না তাঁদের কাছে। ভবিতব্য? বাংলাদেশ বা অন্য কোনও প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বললেই তো আর তারা এই ১৯ লক্ষ মানুষকে জামাই আদর করে নিয়ে যাবে না! অর্থাৎ, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া অসম্ভব। কাজেই ডিটেনশন ক্যাম্প। রাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া নিয়মে, ওই শিবিরেই কাটবে দিন... রাত। থাকতে হবে সরকারের নজরদারিতে। গতিবিধি ঠিক করে দেবে সরকার।
ইতিমধ্যে ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে অসমে। আরও একটি তৈরি করছে রাজ্য সরকার। তাতেও কিন্তু ১৯ লক্ষাধিক মানুষের ঠাঁই হবে না। তাঁরা তখন কোথায় যাবেন? হয়তো নিজের নিজের বাড়িতেই তাঁদের থাকার অনুমতি দিতে বাধ্য হবে সরকার। শুধু কেড়ে নেওয়া হবে সুবিধাগুলি। অন্য কোনও পথনির্দেশিকা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, সরকার এই সমস্যা আসলে জিইয়ে রাখতে চায় না তো? পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যাবে যে, রাষ্ট্রের খবরদারি মেনে নিতে বাধ্য হবে মানুষ। ১২০ দিনের সময়সীমা বাড়বে। তালিকার বাইরে রয়ে যাওয়া এই ‘রাষ্ট্রহীন’দের জন্য ‘বিকল্প’ কিছুর ব্যবস্থাও করতে পারে রাষ্ট্র। একথা ঠিক যে তালিকায় যাঁদের স্থান হয়নি, তাঁদের অধিকাংশই তথাকথিত ‘ঘুসপেটিয়ো’। এই জাতীয় অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত এনআরসিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিল। দেশের মানুষের প্রাপ্য সুবিধা খেয়ে যাবে অবাঞ্ছিত কিছু ‘অ-নাগরিক’, তা একজনও ভারতীয় মেনে নিতে পারবেন না। এই অনুপ্রবেশকারীদের ঘাড়ধাক্কাই ভবিষ্যৎ হওয়া উচিত।
কিন্তু লক্ষাধিক এমন মানুষও তো রয়েছেন, যাঁরা সত্যিকারের ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও ভাগ্যের ফেরে আচমকাই আতান্তরে পড়েছেন! তাঁদেরও যে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই! কারণ, যাঁরা তালিকাভুক্ত হয়ে গিয়েছেন, বাকিদের ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন। প্রশ্ন করলে বলছেন, আমার নাম তো তালিকায় আছে! ব্যাস, তাহলেই হল। অসমের কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন এখনও প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবাদের সুর শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বা অন্য রাজ্যে। যেখানে শাসক অবশ্যই বিজেপি নয়। কিন্তু ভারতের মানচিত্রকে গেরুয়াকরণের লক্ষ্যে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ। রাজনীতি থেকে মুক্তি নেই এখানেও। বিচ্ছিন্নভাবে আওয়াজ তুলে বিরোধীরা কি কিছু করতে পারবেন? সম্ভব তখনই, যদি ভারতীয়রা এই ‘রাষ্ট্রহীন’দের পাশে দাঁড়ায় ...!