ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
আমেরিকার আধুনিকতার প্রতীক, সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বেঁচে থাকলে ২৯ মে, ২০১৯ তারিখে ১০২ বছরে পা রাখতেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাসের ডালাস নগরীতে আততায়ীর গুলিতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রথম সেলেব্রিটি প্রেসিডেন্টের জীবন। ইতিহাস বলে, অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন ছাড়া আর কোনও প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে এত কাঁদেনি আমেরিকা! ষাটের দশকের বিশ্বের উত্তাল সময়ে হাল ধরেছিলেন আমেরিকার। নিজের ক্যারিশ্মায় প্রচারের সব আলো শুষে নিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউস থেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন মূল্যবোধ।
১৯৬০ সালটা ভাবুন। গোটা দুনিয়ায় তখন পরিবর্তনের জোয়ার। মতাদর্শের ভাবধারায় বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। বিশ্বে শীতলযুদ্ধের সময়কাল। পশ্চিমের শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-আধুনিকতার জোয়ার। আমেরিকার নাগরিক আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তখন ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। কেনেডি সমর্থন জানিয়েছেন সমান নাগরিক অধিকারের আন্দোলনকে। পাশে দাঁড়িয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গদের। সমালোচিত হয়েছেন, তবু বরাবর ওঁদের হয়েই কথা বলেছেন। বিখ্যাত হয়ে আছে তাঁর সেই মন্তব্য—‘একটা কালো বাচ্চা জন্মানোর পর, তার স্কুলে পড়ার সুযোগ একটা সাদা বাচ্চার অর্ধেক। কলেজে যাওয়ার সুযোগ তিন ভাগের এক ভাগ। কালোদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও সাদাদের এক তৃতীয়াংশ। নিজের একটা বাড়ি হওয়ার স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনাও অর্ধেক। কালোরা সাদাদের থেকে শুধু চার গুণ এগিয়ে আজীবন বেকার থাকার সম্ভাবনায়!’ এটাই ছিল সেই সময়ের আমেরিকা। কেনেডি সেটা স্বীকার করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। জিতে নিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের হৃদয়। তিনি যে এগিয়ে ছিলেন সময়ের থেকেও, তাঁর নিন্দুকেরাও স্বীকার করেছেন।
সংবামাধ্যমের পণ্ডিতরা অবাক হয়েছিলেন, টেলিভিশনের মতো একটা আনকোরা নতুন জনসংযোগ-মাধ্যমকে কেনেডি কী স্বাভাবিক দক্ষতায় ব্যবহার করেছিলেন। যে সব ফোটোগ্রাফার আর ক্যামেরাম্যান তার পরেও কেনেডির ছবি তুলেছিলেন, তাঁরাও একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন, কেনেডি জানতেন কী ভাবে প্রচারের সব আলো নিজের মুখে ফেলতে হয়। টিভি ক্যামেরা যে সচল, সজীব একটা ব্যাপার, তার সামনে আড়ষ্ট, ভাবগম্ভীর হয়ে বসে থাকতে নেই, সেটা কেনেডি সময়ের অনেক আগেই বুঝে ফেলেছিলেন। আর শোম্যান তো তিনি বরাবরই। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কেনেডি। প্লেন থেকে নেমে প্রেসিডেন্টের লিমুজিনে না উঠে একছুটে চলে যেতেন অপেক্ষারত জনতার সামনে। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাতেন হাসিমুখে, সই বিলোতেন।
কেনেডির জীবনটা বড় ছোট! আমেরিকার আইরিশ বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান কেনেডি সাংবাদিক হতেই চেয়েছিলেন। জোসেফ ও রোজ কেনেডির নয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন জন এফ কেনেডি। যিনি পরে জ্যাক নামে খ্যাত হয়ে ওঠেন। শৈশব পেরিয়েছেন বৈভবেই। হার্ভার্ড থেকে স্নাতক করা জ্যাক ব্রিটেনে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে নৌবাহিনী ছেড়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশ্ব তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায় উত্তাল। আমেরিকার সর্বত্র কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরমে। জন এফ কেনেডি দুই দফা কংগ্রেসে, পরে সিনেটর পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে সুদর্শন সিনেটর জ্যাক কেনেডি বিয়ে করেন সুন্দরী সাংবাদিক জ্যাকলিন লি বউভিয়ারকে।
১৯৬০ সালের ২ জানুয়ারি জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেন। বাছাইপর্বে আমেরিকার রাজনীতিতে উদারনৈতিক হিসেবে পরিচিত হার্বার্ট হাম্প্রিকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হন। সিনেটে তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা লিন্ডেন জনসনকে রানিং মেট করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নামেন। আমেরিকার সেই সময়ের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে শক্ত লড়াইয়ে নামতে হয় তাঁকে। মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন জন এফ কেনেডি। ১৯৬০ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ৩৫ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে জন এফ কেনেডি বিশ্বের শীতলযুদ্ধ, আমেরিকার ভিয়েতনাম অভিযান, পাশের দেশ কিউবাকে নিয়ে সঙ্কট মোকাবিলা করেছেন। তাঁর সঙ্গে সিআইএ-র দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা ওঠে। রহস্যঘেরা জীবন ছিল তাঁর। সুদর্শন এই রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে তখন হলিউড থেকে ওভাল অফিস তোলপাড় হয়েছে। হোয়াইট হাউস-এর ‘ওভাল অফিস’-এর পবিত্রতা নষ্ট করার দুর্নাম জুটেছিল কি না বেচারি বিল ক্লিন্টনের! তখনও নাকি মার্কিন আম জনতা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, কোথায় মেরিলিন মনরো, আর কোথায় মনিকা লিউইনস্কি! তবে, মনরো–কেনেডির এই প্রেম রীতিমত ঢাক–ঢোল পিটিয়ে উদ্যাপিত হয়েছে মার্কিন গণজীবনে। ১৯ মে ১৯৬২। কেনেডির আসল জন্মদিনের ১০ দিন আগেই উৎসব হয়েছিল নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে। ১৫ হাজার অতিথির তালিকায় তাবড় রাজনীতিক ও হলিউড সেলেবদের ছড়াছড়ি। বিরাট কনসার্টে মারিয়া কালাস, এলা ফিটজেরাল্ড-এর মতো ডাকসাইটে শিল্পীদের পাশাপাশি মেরিলিন মনরো! ইতিহাস হয়ে গিয়েছে সেই সন্ধ্যায় মনরোর গাওয়া ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মিস্টার প্রেসিডেন্ট’।
ডালাসের যে সড়কপথে কেনেডিকে হত্যা করা হয়, তা এখনও চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। পর্যটকরা আধুনিক আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে শ্রদ্ধা জানাতে এই সড়কপথে দাঁড়ান। পাশের যে বাড়ি থেকে গুলি করা হয়েছে বলে বলা হয়, সে ভবনটিও এখনও অক্ষত আছে কালের সাক্ষী হয়ে।