ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
উত্তরপ্রদেশের খুর্জার এক গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা ৫৩ বছরের রামশংকর সিং নিচুগলায় বললেন, মেরুদণ্ডে একটা গোলমতো কি যেন হয়েছে। খুব ব্যথা করে। রাতে ফিরে ঘুমাতে পারি না যন্ত্রণায়। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। আর বলেছেন, দাঁড়ানো বন্ধ করতে হবে। ম্লান হেসে রামশংকর সিং বলেছিলেন, কোনওটাই তো হল না। কেন? জানা গেল আটমাস আগে এই স্টোর চারজন সিকিউরিটি গার্ডকে সরিয়ে দিয়েছে। আর তার পরিবর্তে রামশংকর সিং-এর মতো কয়েকজনের আর ছুটি নেই। সপ্তাহে সাতদিনই ডিউটি। তাই মেরুদণ্ডের পরীক্ষা করবেন কখন। সাতদিন ১২ ঘণ্টা একমাস। ১২ হাজার টাকা। রামশংকর সিং-এর তাই একটাই অপেক্ষা লাঞ্চ ব্রেক। ৩০ মিনিটের। খাওয়ার অপেক্ষা? না। বসার। টি ব্রেক। ১৫ মিনিট।
একটু বসার অপেক্ষা। ১২ ঘণ্টার মধ্যে ১১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় বলুন? অন্য কোথাও যাচ্ছেন না কেন? রামশংকর সিং সিসিটিভির দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে বললেন, সব ছাঁটাই হচ্ছে জানেন তো। সর্বত্র। ছেলে রয়পুরে কনস্ট্রাকশনের কাজ করত। কিন্তু সে তো সেই নোটবন্দির পর থেকে আর কাজ নেই তেমন। তাই ছেলে গ্রামে ফিরে কোনওমতে চাষ করে। গ্রামে কাজ নেই। এই চাকরিটা দরকার বড়। তাই মেরুদণ্ডের ব্যথার কথাও বলিনি। রামশংকর সিং-এর প্রিয় মুদ্রাদোষ ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকানো। কখন দুপুর দুটো বাজবে। লাঞ্চ। একটু বসবেন। ওই যে অপেক্ষা করছেন ভারতের রামশংকর সিংরা। সামান্য চাহিদা নিয়ে। বসার।
মুম্বইয়ের মাহিমে ৪০০ স্কোয়ার ফিট ঘরে ৩৫ জন জরিশিল্পীর মধ্যে সারাদিন খুব বন্ধুত্ব। সন্ধ্যার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। তখন প্রতিযোগী পরস্পরের। কে আগে রাতের খাওয়া সেরে আসতে পারবে। আর এসেই শুয়ে পড়বে কয়েকটি বিশেষ জায়গায়। ৪০০ স্কোয়ার ফুট ঘরে তিনটি ফ্যান। ৩৫ জনের প্রত্যেকেই চায় ফ্যানের নীচে শুতে। আর তা নিয়েই বাদানুবাদ, তর্কাতর্কি আর মতান্তর।
একটা রুটিন করে দিয়েছেন মালিক। সোম থেকে রবি। প্রত্যেকের নামের তালিকা করা হয়েছে যে কে কবে ফ্যানের নীচে। রোটেশন করে। যেখানে ১২ ঘণ্টা ধরে শাড়িতে মেটালিক থ্রেড, প্লাস্টিকের ফুল, পাতা লাগাতে হয় ছোট ছোট নিডল দিয়ে। মুম্বইয়ের জরি শিল্পের নিয়ম হল ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ৬ ঘণ্টার জন্য জরিশিল্পীরা পায় ২২৫ টাকা। পরবর্তী ৪ ঘণ্টার জন্য ২২৫ টাকা। আর একেবারে শেষে ২ ঘণ্টার জন্য ১০০ টাকা। একে বলে নাফরি। মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয়। নিজেদের খরচ চালাতে ব্যয় হয় ৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা আসে বিহারে, ঝাড়খণ্ডে, পশ্চিমবঙ্গে, উত্তরপ্রদেশে, দিল্লিতে। অর্থাৎ পরিবারের কাছে ৪৫০ টাকা নেওয়া সয় ১২ টা মিলের জন্য।
গত সাড়ে তিন বছরে এই মজুরি বহু ওয়ার্কশপে এক পয়সাও বাড়েনি। আর অন্যদিকে নাফরি কমে যাচ্ছে। কারণ অর্ডার নেই। জিএসটির কারণে সুরাত, দিল্লি, দেরাদুন, হায়দরাবাদ, আমেদাবাদ, কেরল, ভোপাল, বিলাসপুর সর্বত্র বাজার মন্দা হওয়ায় মুম্বইয়ের প্রতিটি ওয়ার্কশপে কমে যাচ্ছে অর্ডার। আর তাই এখন আর একজনকে ১২ ঘণ্টা ডিউটি দেওয়া যাচ্ছে না। হয়তো ৬ ঘণ্টা ডিউটি পাচ্ছে। অন্য কেউ পাচ্ছে বাকি ৬ ঘণ্টা। এক ধাক্কায় আয় কমেছে। কিন্তু জানা যাচ্ছে বিহার আর উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি জেলা থেকে যাওয়া কর্মীরা উভয়সঙ্কটে। কারণ আয় অর্ধেক হয়ে গেলেও তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরেও আসতে পারছেন না। কারণ গ্রামে ১০০ দিনের কাজ করলেও নাকি সেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
সীতাপুর জেলায় গ্রামের পর গ্রামে গ্রামবাসীর কাছে ফোন এসেছিল এখনই আধার নম্বর মোবাইলে লিংক করো, তা না হলে সিম বন্ধ হয়ে যাবে। দেডোরিয়া গ্রামের প্রমোদ কুমার গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরে মোবাইল শপে সেকথা বললে, দোকানি একটা কালো মেশিনে প্রমোদ কুমারের আঙুল রাখতে বলে দুবার পুশ করেন এবং বলেন যাও, হয়ে গেল। প্রমোদকুমার ফিরে এলেন। চারমাস ধরে তিনটে পুকুর কাটার কাজ করেছেন। মোট প্রাপ্তি ৪২০০ টাকা। ব্যাঙ্কে সেই টাকা আর আসে না। ৬০ টাকা খরচ করে টেম্পোতে চেপে যেতে হয়েছিল শহরের দপ্তরে। সেখানে কম্পিউটার দেখে বলা হল তোমার টাকা তো ব্যাঙ্ক ট্র্যান্সফার হয়েছে। এই তো দেখাচ্ছে! প্রমোদকুমার মহা বিপদে পড়লেন।
টাকা কোথায় গেল? একের পর এক গ্রামবাসীর টাকা উধাও। তারা সকলে মিলে সেই অফিসে আবার গেলেন। তারা এবার ভালো করে কম্পিউটার চেক করে বললেন, তোমাদের আগে যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল সেটা তো চেঞ্জ হয়েছে। এখানে নতুন এক অ্যাকাউন্ট দেখাচ্ছে। ওখানেই গেছে টাকা। প্রমোদকুমাররা জানেই না কোথায় নতুন অ্যাকাউন্ট! এক সহৃদয় ব্যাঙ্ককর্মী আবিষ্কার করলেন মোবাইল সার্ভিস প্রভাইডার কোম্পানি পেমেন্ট ব্যাঙ্ক চালু করেছে। ওই যে ফোনে আধার নম্বর চাওয়া হল এবং প্রমোদকুমাররা গিয়ে লিংক করিয়ে এলেন, আসলে ওই আধার নম্বরের মাধ্যমে তাঁদের অজ্ঞাতেই তাঁদের নামে পেমেন্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালু হয়ে গিয়ে সেই অ্যাকাউন্টই শো করতে শুরু করেছে সরকারি দপ্তরে। আর সব টাকা সেখানে যাচ্ছে।
কিন্তু সেই ব্যাঙ্কের তো কোনও অবয়ব নেই। সবটাই অনলাইন। সেই মোবাইল কোম্পানির আউটলেটে গেলে তারা বলল,এখন ২১০০ টাকা দেওয়া যাবে। বাকি টাকা একমাস পর। প্রমোদকুমার তাই নিলেন। এবং একমাস পর গিয়ে তাঁকে দেওয়া হল ২০৫০ টাকা। ৫০ টাকা তখনও রয়ে গেল। গ্রাম থেকে প্রত্যেকবার এখানে আসতে তাঁর খরচ ৬০ থেকে ৭০ টাকা। খাওয়া আলাদা। সারাদিনের ধাক্কা। আর পরের মাসে যখন আনতে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে বলা হল ওই ৫০ টাকা তো তোলা যাবে না! কেন? কারণ ১০০ টাকার কমে টাকা উইথড্র হয় না। সুতরাং ওই ৫০ টাকা পেতে প্রমোদকুমারদের আবার ১০০ দিনের কাজ করতে হবে। সেই টাকা আবার জমা পড়তে হবে। কবে পাওয়া যাবে ঠিক নেই। সীতাপুর জেলার বহু গ্রামেব বাসিন্দারা তাই ১০০ দিনের কাজে আর অ্যাপ্লাই করছে না। কারণ টাকা পাওয়ার ঠিক নেই।
সাধারণত এইসব গ্রামের মানুষের একাংশ চলে যান মুম্বইয়ে কাজের খোঁজে। যেমন জরিশিল্প। অথবা দিল্লি নয়ডা গুরুগ্রাম। কনস্ট্রাকশন সাইটে। আর অন্যরা গ্রামেই কৃষি বা ১০০ দিনের কাজে থেকে যান। এখন উভয় সঙ্কট। গ্রামে ১০০ দিনের কাজে টাকার নিশ্চয়তা নেই। কৃষিতে লাভ নেই। আবার শহরের রিয়াল এস্টেট স্তব্ধ। মুম্বইয়ের জরি শিল্প সঙ্কটে। সুরাতের টেক্সটাইল মিলে কাজ নেই। গোটা দেশের সমান্তরাল ইকনমি আসলে চালায় মাইগ্রেটেড লেবাররা। ওড়িশা দলে দলে যায় গুজরাত। বাংলা যায় গোটা দেশেই। আজও ভদোদরা গেলে দেখা যাবে সেখানে গণেশ চতুর্থীর প্রতিমা নির্মাণের কারিগর হিসাবে সবথেকে বড় চাহিদা যাঁকে ঘিরে, তাঁর নাম তপন মণ্ডল। আর সবথেকে বড় ধাক্কা এই আর্থিক মন্দায় খেয়েছে এই মাইগ্রেটেড লেবাররাই।
এই কাহিনীগুলি উল্লেখের কারণ হল জিডিপি বৃদ্ধির হার বিগত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়ে কত পার্সেন্ট হল অথবা ম্যানুফাকচারিং রেট ১ শতাংশের নীচে নেমে গেল এগুলো অবশ্যই সাংঘাতিক উদ্বেগজনক। কিন্তু নেহাত এসব দিয়ে অর্থনীতির সঙ্কট যে কতটা গভীরে তা বোঝা যাবে না। আর্থিক মন্দার অন্যতম প্রধান কারণ একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতি প্রায় ডুবে যাচ্ছে ভারতে, আবার অন্যদিকে শহরাঞ্চলে কাজের সুযোগ কমছে। আর এই দুটির জন্যই দায়ী দুটি অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত। নোটবাতিল এবং সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত জিএসটি। ২০১৮ সালে তামিলনাড়ু সরকার বিধানসভায় বিবৃতি দিয়ে বলেছে ওই রাজ্যে নোটবাতিলের ফলে ৫০ হাজার ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ৬ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন।
তাহলে গোটা দেশের চিত্রটা কেমন? নোটবাতিল আর জিএসটি সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল এই প্রচারে অনড় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এই দুটির যে কোনও বিরুদ্ধমতকেই অসত্য বলে পাল্টা আক্রমণ করে এসেছে বরাবর। কিন্তু তাহলে এখন কেন দফায় দফায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে শুধুই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য হাজারো আর্থিক প্যাকেজ দিতে হচ্ছে? কেনই বা জিএসটির রেট বারংবার পরিবর্তন করে,পূর্বঘোষিত তাবৎ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে? সুতরাং সরকারও পরোক্ষে স্বীকার করছে ওই সিদ্ধান্তগুলি ভুল ছিল। ডঃ মনমোহন সিং অথবা নরেন্দ্র মোদি—কোনও প্রধানমন্ত্রীই তো কখনও চাইবেন না যে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ হোক! তিনি তো চাইবেন যাতে অর্থনীতির উন্নতি হয়, কর্মসংস্থান বেড়ে যায়। যাতে তিনি মানুষের সমর্থন পান। আবার ভোটে জেতেন। এটা তো স্বাভাবিক।
তাহলে তাঁরা কারা, যাঁরা এসব সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে বলেছিল মোদি সরকারকে? তাঁরা কী উপকার করেছে এই সরকারের? নাকি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে শুধু দেশকে নয়, সরকারকেও বিপাকে ফেলেছে। তাঁদেরও কিন্তু চিহ্নিত করা দরকার। তাঁদের কী উদ্দেশ্য ছিল? এসবকে ছাপিয়ে যে প্রশ্নটা আরও বড় আকারে সামনে আসছে সেটি হল তাহলে এরপর কী? দুনিয়া জুড়ে অর্থনীতির সঙ্কট চলছে অনেকদিন হল। আমেরিকা, রাশিয়াতেও আর্থিক মন্দা। কিন্তু তাদের সুবিধা আছে। অস্ত্রবিক্রির ব্যবসা। অসংখ্য কর্পোরেট। আর তেল। এই তিনটি কর্পোরেশন ওই দুই দেশকে বাঁচিয়ে দেয়। যখনই আর্থিক মন্দা আসে তখনই এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়। আর আমেরিকা রাশিয়াদের অস্ত্রবিক্রির চুক্তি বেড়ে যায়। ব্যালান্স হয়ে যায় তাদের। কিন্তু ভারত কী করবে?
লক্ষ করা যাচ্ছে সবরকম প্যাকেজ, সবরকম উদার অর্থনীতির সুযোগ ঘোষণা করা সত্ত্বেও অর্থনীতির বেহাল দশা থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। কর্মীছাঁটাই হয়ে চলেছে, ক্রয়ক্ষমতা কমার ফলে পণ্য বিক্রি কমছে। মুদ্রার নিম্নমুখী প্রবণতা বিপজ্জনক। এ থেকে একটি প্রশ্ন বিশ্বজুড়ে তৈরি হচ্ছে। তাহলে কি অবশেষে ক্যাপিটালিজমের পথ এখানেই শেষ? নতুন কিছু উদ্ভাবনের আর ক্ষমতা নেই পুঁজিবাদের? প্রমাণিত হচ্ছে ক্যাপিটালিজম ব্যর্থ? সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা তো আগেই ব্যর্থ। ক্যাপিটালিজম ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে ডেমোক্রেসিও ক্রমেই কমছে। বাড়ছে ধনীদরিদ্র বৈষম্য। তাহলে কোনদিকে যাচ্ছে নতুন পৃথিবী? এরপর কী?