ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ রাজনীতিতে জন্ম নেওয়া এই প্রবাদ আজও একইভাবে খেটে যায়। বরং ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। গ্রামোন্নয়নের কোটি কোটি টাকা পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের মাধ্যমে খরচ হয়। তাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে মধুভাণ্ড। সেই মধুভাণ্ডের নাগাল পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় বেড়ে ওঠা মাস্তান বাহিনী। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদহ সহ অধিকাংশ জেলায় বহু চোর, ডাকাত সরাসরি পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ঢুকে গিয়েছে। ক্ষমতা দখল মানেই কোটি কোটি টাকা খরচের লাইসেন্স হাতে পেয়ে যাওয়া। প্রত্যেকটি পঞ্চায়েতেই বছরে গড়ে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার কাজ হয়। দুষ্কৃতীদের একটা বড় অংশ ঠিকাদারি ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের একটা লাভ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি বেশ কম। টাকা রোজগারের জন্য তাদের আর কষ্ট করে রাতে বের হতে হয় না। বাম জামানায় বাঁকুড়া, হুগলি ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সংযোগস্থলে আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি ডাকাত বাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকার ভোট নিয়ন্ত্রণ করত। রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর তাদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছিল। এখন তাদের অনেকেই জাতীয় পতাকার উপর দিকে থাকা রংয়ের দিকেই ঝুঁকতে শুরু করেছে। বলাবাহুল্য, ক্ষমতা দখলের জন্য প্রায় সব দলই মাস্তানদের মদত দেয়। কেউ ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচে, কেউ নাচে ঘোমটা ছাড়াই। তবে, সব সময়ই অ্যাডভান্টেজে শাসক দল। কংগ্রেস জমানায় পঞ্চায়েত থাকলেও নির্বাচন হতো না। মূলত শাসক দলের পছন্দের গণ্যমান্যরা পঞ্চায়েতের কর্তা হতেন। তখন অবশ্য এখনকার মতো পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এত উন্নয়নের কাজও হতো না। পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল মূলত প্রতিবেশীদের মধ্যে গণ্ডগোলের মীমাংসা করা, আর রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে প্রধান অতিথি হওয়া।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত গঠন হয়েছিল। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মোড়কে গ্রামে গ্রামে মধ্যবিত্তদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারই ছিল সিপিএমের আসল উদ্দেশ্য। সিপিএম পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অত্যন্ত কৌশলে দলের সংগঠন বৃদ্ধির কাছে লাগাতে পেরেছিল। তখন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে আহামরি উন্নয়ন কিছু না হলেও বিরোধীদের দুরমুশের কাজটা হতো নিখুঁতভাবে। ’৭৮ সাল থেকে ’৯৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যের অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং সমস্ত জেলা পরিষদ ছিল সিপিএম তথা বামফ্রন্টের দখলে। রায়তি জমিতে লাল ঝান্ডা পুঁতে দিয়ে খাস ঘোষণা, কথায় কথায় খেতমজুর বয়কট, পুকুরে বিষ ঢেলে ভাতে মারা, সামাজিক বয়কটের অস্ত্রে বিরোধীদের মেরুদণ্ড তখন লাউডগার চেয়েও পলকা।
তবে বাম জমানায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটজয়ের শুরুয়াতটা হয়েছিল ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে। আশির দশকের প্রথমদিকে সম্ভবত দমদমের মতিঝিল কলেজে এসএফআই প্রথম বিনা ‘বাধা’য় ছাত্র সংসদ দখল করেছিল। তারপর কলেজে কলেজে শুরু হয়েছিল ‘জোর যার মুলুক তার’ থিওরি। এসএফআইয়ের সেই সব নেতা যখন সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত হলেন তখন তাঁরাই চালু করলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত দখল। ‘নো রিক্স, ফুল গেন’ থিওরি বেশ মনে ধরেছিল রাজ্য নেতাদেরও। তাই কেউ প্রতিবাদ করেননি, উল্টে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছেন।
’৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পরই প্রথম সিপিএম কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। উপদ্রুত এলাকায় বোমা, গুলির লড়াই তো ছিলই। তবে, সেবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিপিএমের ঝুলি থেকে বেরিয়েছিল ব্রহ্মাস্ত্র ‘সাদা থান’। কমরেডদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘সাদা থান’-এর থিওরি। কারণ কথায় কথায় ‘সাঁইবাড়ি বানিয়ে ছাড়ব’ হুমকিটা বস্তাপচা হয়ে গিয়েছিল। বিরোধীরা সেভাবে খাচ্ছিল না। তবে, ‘সাদা থান’-এর হুমকিতে বিরোধী পরিবারের অন্দরমহলে বয়ে গিয়েছিল সন্ত্রাসের হিমেল স্রোত। অকাল বৈধব্যের আশঙ্কায় বাড়ির মহিলারাই তাঁদের স্বামীকে সিপিএম বিরোধিতা থেকে বিরত রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাতেন। তাতেই একের পর এক পঞ্চায়েত বিনা লড়াইয়ে সিপিএমের ঝুলিতে গিয়ে জমা হতো।
হাজার হাজার আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতলেও সিপিএম নেতারা কিন্তু হরিনাম জপার মতো মুখে বলতেন, ‘নির্বাচন গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসব’। নির্বাচন আমরাও চাই। কিন্তু, বিরোধীরা না প্রার্থী দিলে আমরা কী করব?
২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও একই সুর শোনা গিয়েছে অধিকাংশ জেলার তৃণমূলের নেতাদের গলায়। তৃণমূলের বহু নেতাকেই বলতে শোনা গিয়েছে, এত উন্নয়ন হয়েছে যে বিরোধীরা প্রার্থী পাচ্ছে না। তাই নাকি তাঁরা একের পর এক পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, এমনকী জেলা পরিষদ বিনা ভোটে জিতেছেন।
আসলে, সব শাসকের ভাষা, ভাবনা ও সুর একই হয়। তবে, এব্যাপারে বিজেপির ভাষা এবং সুর কিঞ্চিৎ কড়া এবং চড়া। ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতা দখলের পর সে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে শতকরা ৮৫ ভাগ আসনেই বিনা ভোটে জয়ী হয়ে গেল। অবশ্য তা নিয়ে ত্রিপুরার কোনও ‘বিপ্লবী’ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়াননি। আসলে বিনা ভোটে জেতাটা একটা ভয়ঙ্কর নেশা। মাদকের নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর। নেশায় বাধা দিলে তাণ্ডব অনিবার্য। এই নেশার কবলে পড়লে ণত্ব-ষত্ব জ্ঞানও লোপ পায়।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী মানে, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। অর্থাৎ মানেটা এই রকম, তিনি এতটাই কাজের ও এত গুণের অধিকারী যে সকলেই তাঁর নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব কি সে কথা বলে?
খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরাজ্যে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন তাঁদের বেশিরভাগই এলাকায় সব চেয়ে বেশি অপছন্দের মানুষ। বরং বলা ভালো, ভোট হলে হেরে যাবে বুঝেই সন্ত্রাস করে পঞ্চায়েত কব্জা করেছেন। আর সেটা করতে গিয়েই শাসক দল যুগে যুগে নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছে।
এরাজ্যে সিপিএম যেহেতু রাজনৈতিক চর্চার বহু যোজন দূরে অবস্থান করছে, তাই ‘খাঁড়ার ঘা’ দেওয়ার চেয়ে বর্তমান শাসক দলের কাজের নমুনা উত্থাপনই প্রাসঙ্গিক। ২০১৮ সালে বাঁকুড়া জেলায় ২৫০৫টি গ্রাম সভার আসনের মধ্যে ১৫৯৩টি আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। এর মধ্যে বিষ্ণুপুর মহকুমার কোনও আসনেই ভোট হয়নি। সমস্ত আসনই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে। কিন্তু, লোকসভা ভোটে এই বিষ্ণপুরেই তৃণমূল গোহারা হারল। হারল বাঁকুড়াও।
বাঁকুড়া জেলার ওন্দার রামসাগর বিজেপির দীর্ঘদিনের শক্ত ঘাঁটি। ২০১৩ সালেও রামসাগর পঞ্চায়েতটি বিজেপি জিতেছিল। কিন্তু, এবার সেই পঞ্চায়েতের ২০টি আসনের মধ্যে ১৮টিই তৃণমূল বিনা ভোটে ছিনিয়ে নিল। মাত্র দু’টিতে ভোট হল। সেই দু’টি আসনেই জিতল বিজেপি। এলাকার মানুষ প্রমাণ করে দিলেন, বিরোধীদের প্রার্থী দিতে না পারার দাবিটা কতটা অন্তঃসারশূন্য।
এখানে একটা কথা না বললে বোধহয় সত্যের অপলাপ হবে, বিগত আট বছরে গ্রাম বাংলায় রাস্তাঘাট, পানীয় জল, আলো সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বস্তরে পরিষেবা দেওয়ার অনন্য নজির তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ যদি ঠিকঠাক ভোট দিতে পারত, তাহলে হয়তো অধিকাংশ জায়গায় শাসক দলই জয়ী হতো। কারণ তখনও বিরোধীদের সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু, পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডের নাগাল পেতে শাসক দলের মাদার ও যুবর আত্মঘাতী লড়াই এরাজ্যে বিজেপিকে পায়ের তলায় মাটি দিয়েছে। লাঠির দাপটে তৃণমূলের যোগ্যদের প্রার্থী হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে। বঞ্চিতরা নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়ালে তাঁদের জয় নিশ্চিত বুঝেই লেঠেল বাহিনী দাঁড়াতে দেয়নি। তৃণমূলের সেই সেই বঞ্চিতরাই লোকসভা ভোটে তলে তলে বিজেপিকে সমর্থন করেছে। তার জেরেই বহু জায়গায় বিজেপির পায়ের তলার মাটি এখন পাথরের মতো শক্ত।
বিনা ভোটে জয়লাভ মানে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল। পঞ্চায়েত যখন থেকে মধুভাণ্ড, তখন থেকেই শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে মরিয়া। অথচ এই বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল শাসক দলকে শক্তিশালী করে না, বরং ভিতর থেকে ফোঁপরা করে দেয়। বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েতে বাসা বাঁধে দুর্নীতি। দলের মধ্যে যাতে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস না পায়, তার জন্য কুখ্যাত কয়লা মাফিয়াকে নিয়ে মনোনয়ন জমা দেয় নেতা। চোখের সামনে অন্যায়, দুর্নীতি দেখেও মানুষ ভয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।
তাই বিরোধীদের প্রার্থী না পাওয়ার অজুহাত দিয়ে পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার প্রহসন অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। তার জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হোক। মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরসভার কাজ যেভাবে প্রশাসক করেন, একইভাবে কোথাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার পরিস্থিতি হলে সেখানকার উন্নয়নের দায়িত্ব বিডিওকে দেওয়ার আইন হোক। এই নিয়ম চালু করলেই কেউ বিনা ভোটে জেতার কথা ভাববেও না। সব রাজনৈতিক নেতাই গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু, গণতন্ত্র শুধু মুখের বুলি নয়, গণতন্ত্র এক মহান ভাবনা। গণতন্ত্র ধর্মের মতোই পবিত্র। তাকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আর সেই কর্তব্য পালনের প্রথম পদক্ষেপ হবে বিনা ভোটে পঞ্চায়েত দখলের রাস্তা বন্ধ করা।