ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
যাইহোক, সে তো মাসখানেক পরের ব্যাপার। তার আগে আসন্ন মহোৎসবের জন্য বাঙালির গোছগাছ সাজগোজ জোগাড়যন্তর—সেও কি কম! নতুন জামাকাপড়, নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং ইত্যাদি হাজার হাঙ্গামা, আত্মীয় পরিজনেদের সঙ্গে একযোগে চার দিন কাটানোর আগাম প্ল্যান প্রোগ্রাম ছকা, পুজোর দিনগুলোতে ঘরে-বাইরে পানভোজনের মেনু ঠিক করা বা অন্য আরও কত কিছু—সে এক বিস্তর ব্যাপার। এবং পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা ছাড়া (এটা তিন মাস আগে করতে হয়) বাদবাকিগুলো পুজোর আগের এই এক-দেড় মাস ধরেই যে চলে—এটা কে না জানেন? কিন্তু শোনা যাচ্ছে, এবার বাঙালির পুজোর প্রস্তুতিতেই নাকি ভাটার টান! দোকান বাজারে এখনও বেপাত্তা সেই জমজমাট ভিড় কেনাকাটা! এমনকী পাইকার সাধারণ জনেদের হরিশা হাট মঙলাহাটেও এবার সেই চাঙ্গা ভাবটা এখনও দেখা যাচ্ছে না। বিকিকিনি একেবারেই হচ্ছে না—এমন বলছেন না কেউই। কিন্তু সে বিকিকিনি নাকি এখনও বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম। পশরা সাজানো বা দামে ছাড়ের আয়োজনে ব্যবসায়ীরা কসুর করছেন না বটে, তবে তাতেও নাকি তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। যত মানুষ পুজোর নতুন জামাকাপড়ের সম্ভার দেখতে আসছেন বিক্রিবাটা নাকি সেই অনুপাতে হচ্ছে না! আমার এক বন্ধুর কাছে শুনলাম, উত্তর কলকাতার খান্না মোড়ে যে হরিশা হাট এই সময় কেনাকাটার ভিড়ে ডুবে যায়, শেষরাত থেকে দুপুর অবধি যার সামনের রাস্তায় গাড়ি চলাচল অসম্ভব হয়ে ওঠে, গত রবিবার সেই হাটের পাতলা ভিড় বেশ চোখে লেগেছে! হাটের সামনের রাস্তাতেও জ্যাম ছিল না! এক ব্যবসায়ী নাকি আক্ষেপ করে তাঁকে বলেছেন, মন্দা লেগে গেছে দাদা, এবার আমাদের অবস্থা কাহিল! মানে?
কিছুদিন ধরেই অবশ্য শোনা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বেই একটা মন্দার ভাব দেখা দিচ্ছে আর্থিক ক্ষেত্রে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই মন্দার ধাক্কা অল্পে অল্পে নিঃশব্দে এসে লাগছে জনজীবনের নানা স্তরে। গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাটের বিক্রি কমছে, শিল্পে বিনিয়োগে ভাটা চাকরিবাকরির সুযোগও সেভাবে বাড়ছে না, উল্টে হাজার হাজার মানুষ চাকরি খোয়াচ্ছেন, বড় বড় কোম্পানি মায় রেলের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানেও মন্দার চাপ বাড়ছে, নতুন কর্মসংস্থান যত হচ্ছে কর্মসংকোচন ছাঁটাই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলছে, ব্যাঙ্ক সেক্টরও বিশেষ সুবিধেজনক অবস্থায় নেই এবং কয়েকটা ব্যাঙ্ক জুড়ে ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা হচ্ছে আবার গতকালই জানলাম দেশে জিডিপি ৫-এ নেমে দাঁড়িয়ে নাকি সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে! আমি অর্থনীতির ছাত্রী নই। তবে এটুকু বুঝতে পারছি কোথাও একটা গোল হচ্ছে। তাছাড়া, বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের মতো ভারতেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও যে সব মিলিয়ে একটা সঙ্কটের ছায়া পড়েছে সংশ্লিষ্ট মহলের শীর্ষকর্তাদের অনেকেই সেটা অনুভব করছেন। ইতিমধ্যেই নীতি আয়োগের কর্তা রাজীব কুমার এ বিষয়ে চেতাবনি দিয়েছেন। তাঁর দাবি, নোটবন্দি জিএসটি দেউলিয়া বিধির পরিবর্তন ইত্যাদির জন্যই গত বছর চারেকে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, গত ৭০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন সঙ্কট আসেনি! তবে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এই তত্ত্ব মানছেন না। তাঁর মতে, একটি শক্তিশালী অর্থব্যবস্থার দিকে এগচ্ছে দেশ। জিএসটি সরলীকরণ, ভারী শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে সরকারের বিশেষ আর্থিক উদ্যোগ, বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ নীতিতে বাড়তি নমনীয়তা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে খুব শীঘ্রই অর্থনীতির হাল ফিরবে এবং গরিব মধ্যবিত্তের জীবন আরও সুঠাম সুন্দর হবে।
সে না হয় হবে। কিন্তু, আসন্ন পুজোয় তার সুফল কতটা মিলবে? আদৌ মিলবে? ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষের হাতে টাকা নেই। থাকলেও ভবিষ্যৎ ভাবনায় খরচ করতে দ্বিধা করছেন। মূল সমস্যাটা সেখানেই। এতেই বিক্রি কমছে। পুজোর মুখে মার খাচ্ছেন ছোট-বড়-মাঝারি সব ব্যবসায়ী। বিক্রিবাটায় আর্থিক মন্দার ছায়াটাই যেন একটু একটু করে ঘনীভূত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এই পুজোর ব্যবসা সম্বল করে যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দোকানি ব্যবসায়ীরা সারা বছর চলেন তাঁদের সমস্যা আরও বেশি। মহাজনের কাছ থেকে পুজোর বিক্রিবাটার জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও তাঁরা প্রচুর মাল তুলেছেন। সেই মাল প্রত্যাশামতো বিক্রি না হলে তাঁদের কী হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে এই বঙ্গের মহাপুজোর ঐতিহ্য বলছে, ঝড়ঝঞ্ঝা বন্যা খরা কোনও বিপর্যয়ই কোনওদিন বাঙালির এই বাৎসরিক উৎসবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। না কেনাকাটায়, না আড়ম্বর রোশনাইতে। দেশ-বিশ্বের আর্থিক মন্দার যে আভাস আমাদের চারপাশে উড়ছে তা নজির গড়ে এবার বাঙালির সংবৎসরের আনন্দ পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে—এমনটা অতি বড় নেতিবাদীও মনে করছেন না। বরং, তাঁদের কারও কারও মতে, নতুন জামাকাপড় খানাপিনায় মহাপুজোর মহাআনন্দ চেটেপুটে নেওয়ার জন্য বাঙালিজনেদের অধিকাংশ কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকেও শেষপর্যন্ত উপেক্ষা করে যাবে।
সেটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের উৎসবপ্রিয় আমুদে বাঙালি এত সহজে রণে ভঙ্গ দেবেন তা হতেই পারে না। চাঁদা বা বিজ্ঞাপনের আয়ে টান পড়ায় হয়তো কোথাও কোথাও সামান্য ব্যয়সংকোচ হবে, ছিটেফোঁটা কাটছাঁট হবে আয়োজন উদ্যোগে—কিন্তু দিনের শেষে উৎসবের আমেজে আনন্দে কোথাও কারও ভাগে কিছুমাত্র কম পড়বে না—এই বিশ্বাসে এখনও অটল পশ্চিমবঙ্গের আবালবৃদ্ধবনিতা। এবার এই সমস্যার কথা ভেবেই মনে হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের পুজো কমিটিগুলোর সরকারি অনুদান দশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার করে দিয়েছেন। মহিলা পরিচালিত পুজো পাবে আরও পাঁচ হাজার বেশি—তিরিশ হাজার।
কিন্তু মুশকিলটা অন্যত্র। টাকা না থাকায় পুজোর কেনাকাটায় ব্যাঘাত ঘটছে—সে ঘাটতি হয়তো শেষঅবধি অনেকটাই মিটে যাবে। পুজো কমিটির আয়ের ঘাটতি সরকারি অনুদানে খানিকটা হলেও ভরে যাবে। মা দুর্গার পুজো উৎসবের আনন্দভোগেও মানুষের অসুবিধে হবে না। কিন্তু যে কেনাকাটা দৈনন্দিন জীবনে বাধ্যতামূলক তাকে তো আর না কিনে থাকা যাবে না! মানুষ সব মানতে পারেন কিন্তু পেটের জ্বালা? তার দায় তো মেটাতেই হয়, তাই না? আর সেখানেই তো শুনছি আগুনের হলকা লাফিয়ে বাড়ছে। আলু এক লাফে পনেরো বিশ, পেঁয়াজ ৫০/৬০, লঙ্কা ১০০/১৫০, আদা-রসুন সেসবও নাকি ২০০/২৫০! এছাড়া বাদবাকি সব্জি ফলের দামও হু হু করে বাড়ছে। মাছ-মাংসের তো কথাই নেই! তার চেয়ে বড় কথা, এবার পুজোর সময় নাকি যাবতীয় শাকসব্জি মাছ থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সবকিছুর দাম আরও বাড়বে, আকাশ ছোঁবে। ব্যবসায়ীদের অভিমত তেমনই! তা যদি হয় তবে সন্দেহ নেই কাঁটা ফুটবে উৎসবের পথে। অস্বস্তি অসুবিধে বাড়বে বাংলার গরিব মধ্যবিত্তের ঘরে। কিন্তু, বাঙালি তাতেও কি দমবে, উৎসব থেকে সরে থাকবে!? অসম্ভব। মহামায়ার মহোৎসব থেকে বাঙালিকে দূরে রাখতে পারে এমন শক্তি এখনও এই ভূমণ্ডলের নেই। মন্দা তো কোন ছার!