ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
এই আক্ষেপ অবশ্য আমাদের নতুন নয়। প্রতি বছর এই ধরনের একাধিক সরকারি বেসরকারি সমীক্ষা চিত্র প্রকাশ পায়। সেখানেই প্রকট হয় আর্থিক ক্ষেত্রে বাংলার ও বাঙালির ক্রমান্বয় পিছু হঠার করুণ বাস্তব। তার মধ্যেও আমরা সান্ত্বনা খুঁজতাম বাংলার বা কলকাতার কিছু ঐতিহ্যকে আঁকড়ে। কিন্তু দ্রুত বদলে যেতে থাকা বিশ্ব অর্থনীতির ঝাপটায় বেসামাল আমরা সান্ত্বনার সম্বলটুকুকেও প্রোটেক্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের এই ব্যর্থতা যেন অপ্রতিরোধ্য! তার একটি ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের সর্বশেষ সংস্কার পদক্ষেপ।
ব্যাঙ্কিং সেক্টরের হাল দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে করুণ দশা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং সেক্টরের। সঙ্কটে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও। ক্রমশ যে-অতলে যাচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণের গ্রাহ্য নীতি কী এই সরকারের অন্তত জানা নেই। তবে, সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গত বছর ছয় যাবৎ কিছু পদক্ষেপ করেছে, তার ফল যা-ই হোক না কেন। তার মধ্যে একটি হল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনা। কিছু আয়তনে ছোট এবং অলাভজনক ব্যাঙ্ককে অপেক্ষাকৃত একটি বড় ব্যাঙ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তার ফলে, ছোট ব্যাঙ্কগুলির নাম ও অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছে। যাবতীয় শাখাসহ সেই ব্যাঙ্কগুলি সংযুক্ত বড় ব্যাঙ্কের পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে। এই সংস্কারকে বলা হচ্ছে সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়া। যেমন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (ইউবিআই) এবং ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স (ওবিসি) মিশে যাচ্ছে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের (পিএনবি) সঙ্গে। এর ফলে প্রথম দুটি ব্যাঙ্কের নাম অস্তিত্ব কিছুই থাকবে না। পুরোটারই নতুন পরিচয় হবে পিএনবি। একইভাবে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক মিশে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের সঙ্গে। এই পঙ্ক্তিতে আরও কয়েকটি ব্যাঙ্ক আছে। এই দফায় দশটি ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে চারটি ব্যাঙ্কে পরিণত হচ্ছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) সহযোগী ব্যাঙ্কগুলি এবং আরও একাধিক ছোট ব্যাঙ্কের সংযুক্তির পর ২০১৭ সালে সারা দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের আমলে সেই সংখ্যাটি আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে—১২। এর ফলে, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র কতটা প্রাণবায়ু পাবে কিংবা দেশের অর্থনীতির চেহারায় কী ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে তা বলবেন অর্থনীতির পণ্ডিতরা। এই নিবন্ধে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই।
আমাদের আক্ষেপ হল, সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে বাংলার গুরুত্ব আরও কমে গেল। একসময় রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরও (আরবিআই) হেড কোয়ার্টার্স কলকাতায় ছিল। ১৯৩৭ সালে সেটা মুম্বইতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। উপ মহাদেশের একটি অত্যন্ত প্রাচীন ব্যাঙ্ক হল ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা (১৮০৬)। সে আর নেই। ১৮০৯ সালে নাম পাল্টে এটাই হয়ে যায় ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল। ১৯২১ সালে ব্যাঙ্ক অফ বোম্বাই এবং ব্যাঙ্ক অফ মাদ্রাজ নামে দুটি প্রেসিডেন্সি ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ ঘটে যায় ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলের সঙ্গে। আর এইভাবেই গড়ে ওঠে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। স্বাধীন ভারতে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণের মাধ্যমে গড়ে ওঠে আজকের স্টেট ব্যাঙ্ক (এসবিআই)। দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর এখন মুম্বই। হারিয়ে গিয়েছে ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্ক, প্রবর্তক ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ বাঁকুড়া, মেট্রোপলিটন ব্যাঙ্ক, সাদার্ন ব্যাঙ্কসহ অনেক ব্যাঙ্ক, যেগুলি ছিল বাংলার একেবারে নিজস্ব।
অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাতীয় ক্ষেত্রে বাংলা তথা কলকাতার গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে কমছে। রাজধানী, সুপ্রিম কোর্ট আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কলকাতা থেকে। একে একে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অনেক বৃহৎ শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর। কোনোক্রমে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কলকাতায় আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—ইউবিআই, এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক ও ইউকো ব্যাঙ্ক। কলকাতার এই গৌরবটুকুও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। প্রথমোক্ত দুটি ব্যাঙ্কের মধ্যে ইউবিআই বাংলার একেবারে নিজস্ব ব্যাঙ্ক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে এটাই বাঙালির শিল্প এবং বাণিজ্যবুদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
এই প্রসঙ্গে ইউবিআই বৃত্তান্তে একবার চোখ রাখাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
সফল আইনজীবী ছিলেন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লার নরেন দত্ত। সত্যনিষ্ঠ পথে উপার্জনের ভাবনায় তিনি আইন পেশা ছেড়ে দেন। ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন। যাত্রা শুরু হল ৪০০০ টাকার মূলধন (পেড-আপ ক্যাপিটাল) নিয়ে। আমানত বা ডিপোজিট পাওয়া গেল ২৫০০ টাকা। এই পুরো টাকার মধ্যে দত্ত মশায়ের ব্যক্তিগত শেয়ার ছিল ১৫০০ টাকার। স্বাধীনতা সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র কুমিল্লার খ্যাতি ছিল ‘এ টাউন অফ ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ট্যাঙ্কস’ হিসেবে। কারণ, বাংলার আরও দুটি প্রথম সারির ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর ছিল এই শহর। ব্যাঙ্ক দুটি হল ইন্দুভূষণ দত্তের কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এবং অখিলচন্দ্র দত্তের পাইওনিয়ার ব্যাঙ্ক। কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে নরেন দত্ত প্রতিজ্ঞা করলেন, নিজে বঞ্চিত হলেও পুঁজি অক্ষুণ্ণ রেখে উচ্চমানের পরিচালনার জন্য মরিয়া থাকবেন। নিজেকে দেওয়া কথা নরেনবাবু তাঁর দীর্ঘ জীবনে কীভাবে রেখেছিলেন সে এক বিরলপ্রায় ইতিহাস। নরেনবাবুর মৃত্যু হয় ১৯৬২-তে। তার আগে তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র বটকৃষ্ণ দত্তকে, যিনি বি কে দত্ত নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
কলকাতা থেকে কমার্স গ্রাজুয়েট হয়ে কুমিল্লা ফিরে গিয়ে বটকৃষ্ণবাবু বাবার ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশি শুরু করেন। শিক্ষানবিশি সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার পর ২১ বর্ষীয় বটকৃষ্ণবাবু স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করলেন। এবং, সেটাও ব্যাঙ্ক ব্যবসা। নাম দিলেন দ্য নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক। হেড অফিস খোলা হল একটি ছোট গাড়ির গ্যারাজ ভাড়ায় নিয়ে। ব্যবসার দ্রুত প্রসারের কৌশল হিসেবে বটুবাবু মোবাইল ব্যাঙ্কিং চালু করলেন—ব্যাঙ্কই চলে যাবে সোজা কাস্টমারের কাছে! এই অভিনব উদ্যোগটি কেমন? সকাল ৮-১০টা পর্যন্ত ব্যাঙ্ক। তারপর ব্যাঙ্কের ঝাঁপ বন্ধ। ব্যাঙ্কের এমডি স্বয়ং দুজন কর্মচারীকে নিয়ে এরপর সাইকেলে চেপে হাজির হতেন জেলা কোর্ট চত্বরে। হিসেবের খাতা, চেকবই, নগদ টাকা সমেত। কাস্টমার তালিকায় থাকতেন চাষি থেকে জোতদার, কোর্টের উকিল, মোক্তার, কর্মচারী থেকে মামলার বাদি বিবাদি, এমনকী ধনী মুসলিম পরিবারের মহিলারাও। অতি দ্রুত জনপ্রিয় হল সেই উদ্যোগ। কোর্ট চত্বরে সাড়ে তিন টাকায় একটি পান গুমটি ভাড়ায় নিয়ে খোলা হল ব্যাঙ্কের প্রথম শাখা। কিন্তু সম্ভ্রান্ত নাগরিকরা ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নিলেন না। শেষমেশ মান রাখতে নরেনবাবু কোর্ট চত্বরে একটি টিনের চালার ঘর খাড়া করে দিলেন। সেখানেই উঠে এল দ্য নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্কের হেড অফিসসহ নতুন ব্রাঞ্চ।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা। ভারতেও তা আছড়ে পড়ল। নবগঠিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর চিন্তামন দেশমুখ গ্রাহকস্বার্থরক্ষার যুক্তিতে ছোট ছোট ব্যাঙ্কগুলিকে কোনও একটি বড় ছাতার তলায় সংযুক্ত হতে পরামর্শ দিলেন। বটুবাবুর তা মনে ধরল। ১৯৪৬ সালে কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন এবং দ্য নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক একসঙ্গে মিশে গেল। সংযুক্ত কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের ডেপুটি এমডি নির্বাচিত হলেন বি কে দত্ত। দাঙ্গা, দেশভাগের ঘটনা বাঙালির ব্যাঙ্কগুলিকে পঙ্গু করে দিচ্ছিল। তবু যেসব ছোট ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরামর্শ গ্রাহ্য করেনি তাদের অনেকে বেশ ভুগেছিল। যেমন ১৯৫০-এ ধসে গিয়েছিল নাথ ব্যাঙ্ক একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাঙ্ক। একরাশ উদ্বেগ নিয়ে দ্রুত কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন আরবিআই ডেপুটি গভর্নর মিস্টার মেখরি। বাঙালি ব্যাঙ্কগুলির চারজন নামী কর্তাকে একটি বৈঠকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বঙ্গদেশের ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচাবার পথ কী বলুন। উপস্থিত বাঙালি ব্যাঙ্কারদের মধ্যে বয়োকনিষ্ঠ ছিলেন বি কে দত্ত। তবু তাঁর প্রস্তাব মেনে সবাই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেন যে কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন, কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং হুগলি ব্যাঙ্ক সংযুক্ত হয়ে যাবে।
বাঙালির চারটি নামী ব্যাঙ্কের অ্যামালগামেশনের মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছিল ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। মাত্র ১২ কোটি টাকার পুঁজি আর ২৭ কোটি টাকার আমানত নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইউবিআই। পরে একাধিক দফায় এই ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল কটক ব্যাঙ্ক, তেজপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্ক, হিন্দুস্থান মার্কেনটাইল ব্যাঙ্ক এবং নারাং ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ১৯৬৯ সালে দেশের প্রধান আরও ১৩টি ব্যাঙ্কের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রায়ত্ত’ হিসেবে ঘোষিত হয় ইউবিআই। দেশের অগ্রণী ব্যাঙ্কেরই তকমা পেয়েছিল ব্যাঙ্কটি। যদিও সেই কৌলীন্য দীর্ঘ দিন ধরে রাখতে পারেনি। রুগ্ন হয়ে পড়ছিল। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে বাঙালির এই ব্যাঙ্ক সম্প্রতি লাভের মুখও দেখতে শুরু করেছিল। তার মধ্যে ফের রূপান্তরের পরীক্ষায় বসছে বাঙালির বাণিজ্য-ভাগ্য। জানি না, এর ফল বাংলার বা দেশের পক্ষে কতটা ভালো হবে।
বাঙালির ব্যবসা বুদ্ধি নেই। এই অপবাদ বার বার দেওয়া হলেও ইতিহাস কিন্তু অন্য সাক্ষ্য দেয়। উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এই কলকাতায় সাহেবদের বাণিজ্যেরও শরিক ছিলেন বাঙালিরা। ইংরেজরা নিজেদের ভুলে সেইসব ব্যবসায় একে একে লালবাতি জ্বালিয়েছিল। ১৮২০-২৩ সালের ভিতর জলে গিয়েছিল প্রায় ২ কোটি পাউন্ড! দেউলিয়া ইংরেজ ব্যবসায়ীরা চুপিসারে ভারত থেকে ভেগে যায়। আর সাহেবদের দেনার দায়ে জেল খেটে মরেন কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী। তখন ব্যবসার ঝুঁকি ছেড়ে ধনী বাঙালিদের একাংশ জমিদারি কিনে সুখী হওয়ার সহজ পথ নিয়েছিলেন। কিন্তু আজ বাঙালি কোন পথে যাবে? আজকের পরস্থিতির পুরো দায় কি বাঙালির? এর উত্তর বাঙালির জানা নেই। মোদি সরকারের অর্থনীতির পণ্ডিতরা বাতলে দেবেন দয়া করে?