ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
শহর-গ্রাম-মফস্বলের বর্জ্যের সিংহভাগই এখন এই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের দখলে। এবং তা পরিমাণে এতটাই বেশি যে সেটা বর্জ্যের সামগ্রিক চরিত্রটাই বদলে দিচ্ছে। আমাদের চলতি সাফাই ব্যবস্থা ও নিকাশি পদ্ধতি কোনকিছুর সঙ্গেই না মিশতে চাওয়া ও দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়া এই ধরণের বর্জ্যগুলির সমস্যার মোকাবিলা করতে পারছে না। কারণ আমাদের প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশিরভাগই হল পলিব্যাগ ও পান-গুটখা, বিড়ি, পান মশলা এবং খাবার দাবারের মাল্টিলেয়ারড পাউচ। এই সামগ্রীগুলির বেশিরভাগই পলিএথিলিন বা লো ডেনসিটি পলিএথিলিন। এগুলি মূলত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকেই আসে। আমাদের দেশের প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬৬ শতাংশই এসব জিনিস। এই বর্জ্যের সমস্যা থেকে বাঁচার কোন উপায় এখনও আমরা বার করতে পারিনি। অনেক রাজ্য প্লাস্টিক বন্ধ করার ফরমান দিয়েছে কিন্তু তবুও বহাল তবিয়তে রয়েছে ক্যারিব্যাগ, তাই সমস্যাও রয়েছে।
এমনিতেই আমাদের দেশের বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা জড় হওয়া জঞ্জালের পরিমাণের তুলনায় দুর্বল। নাগরিক বদভ্যাস তা আরও ব্যাপকতর করে তুলেছে। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। কয়েকবছর আগে রাজ্যের অনেক পুর এলাকাতেই রাস্তায় জঞ্জাল না ফেলা এবং প্লাস্টিক বর্জ্যগুলিকে আলাদা করার জন্য পরিবার পিছু দুটো করে বাকেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কোন কাজে লাগেনি। কেউ তাতে রাখছেন চাল, কেউ রাখছেন জল, কেউবা ময়লা জামাকাপড়। ড্রেন, পুকুর, নিকাশি পাইপ, জলের নালা, মাঠ ময়দান সবকিছুতে দখল কায়েম করার পর একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে ভূগর্ভে। নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি। নিজেদের অসচেতনতার বলি হচ্ছি আমরা নিজেরাই।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই অবস্থার মোকাবিলার ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ তৈরি করেছে। তা কীভাবে কার্যকর করা যায় তা নিয়ে বেশ কয়েকটা বৈঠকও হয়ে গেছে কিন্তু কোন সমাধান সূত্র মেলেনি। গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষ ও শিল্প এই গোত্রের প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, ট্রেনে রাস্তায় পাড়ার বাজারে নানা সাইজের পাতলা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগে বিক্রি হচ্ছে সবজি ফল ফুল মাছ পুরি তেলেভাজা। পাড়ার মুদির দোকান থেকে জিনিস আনতে সেই ক্যারিব্যাগই ভরসা। মদের ঠেক থেকে ফুটপাথের হোটেল সর্বত্র প্লাস্টিকের বোতল গেলাস প্লেটের রমরমা। কাজেই সমাজের সবস্তরের মানুষদের এধরণের প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার বন্ধ করার কর্মসূচির আওতায় না আনলে এই সমস্যা মিটবে না। আবার সব দায়িত্ব কিন্তু এগুলো যারা বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছেন তাদের নয়, ইন্ডাস্ট্রি এবং সরকারকে বিকল্প প্যাকেজিং এর ব্যবস্থা করার কথা ভাবতেই হবে।
এই সমস্যা শুধু আমাদের দেশের নয়, গোটা বিশ্বের। সারা বিশ্বের ৪৭ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই মূলত মাল্টিলেয়ারড পাউচ। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের সমস্যা সবচেয়ে বেশি আমাদের এই এশিয়াতে। এমনিতেই সব প্লাস্টিক বর্জ্যগুলির মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়। ১২ শতাংশ প্লাস্টিক জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং ৭৯ শতাংশ মাটিতে মেশে। সেগুলি পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা, সংশোধন করা বা নতুন চেহারা দেওয়া কোনটাই এখানে তেমনভাবে হয়না। হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় এতই কম যে সেটার ওপর নির্ভর করে কোন পরিকল্পনা করা যায় না।
২০০৯ সালে হিমাচল প্রদেশ থেকে শুরু হয়েছিল প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বন্ধ করার অভিযান। এ বছরের গোড়ায় দেশের ২৯টি রাজ্য এবং ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ক্যারিব্যাগ বন্ধ করার জন্য আইন তৈরি করেছে। রাজধানীতে তো দু’বছর আগে থেকেই শুধু প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগই নয়, প্লাস্টিকের কাপ, প্লেট সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। খুব সামান্য হলেও আগের তুলনায় কমেছে মানুষের প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রবণতা। প্রস্তুতকর্তাদের ওপর ব্যবহারের পর এগুলো সংগ্রহ করা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার দায়ও চাপানো হচ্ছে। কিন্তু এত কিছু করার পরও প্রায় ‘আত্মার’ মতোই অজর-অমর-অক্ষয় এসইউপি সামগ্রীগুলিকে নিয়ে আমাদের সমস্যা মেটেনি।
তার একটা বড় কারণ হল আমাদের জনসংখ্যা। এমনিতে মাথাপিছু হিসেবে আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার খুব একটা বেশি নয়, বছরে মাত্র ১১ কিলো। আমেরিকাসহ বহু উন্নত দেশের তুলনায় তা অনেক কম। কিন্তু বাদ সেধেছে জনসংখ্যা। এই ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৯৪০টন। ওজনে যা এশিয়ার ৯০০০ হাতির ওজনের সমান। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব এবং মানুষের সচেতনতার অভাব সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে। দেশের শহরতলিতে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ১৫ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য।
দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা যায়না। সেগুলি পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার সমস্যাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল ধাপা ও শহরের অন্যান্য জায়গা থেকে পুরসভা ছাড়াও যারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন তারা পাতলা ক্যারিব্যাগ ও পাউচ সংগ্রহ করার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখান না। কারণ এর বিক্রয় মূল্য কম তাছাড়া পাতলা পাউচ ও ক্যারিব্যাগগুলি হাওয়াতে চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে যায় বলে এগুলি সংগ্রহ করাটাও একটা সমস্যা। দেশে সব থেকে বেশি প্লাস্টিক জমে দিল্লি ও কলকাতায়। দুটো শহরেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার রোখার সত্যিই একটা বড় সমস্যা। এগুলোকে চালু রাখার জন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মহলও সমান সক্রিয়। কারণ প্যাকেজিংয়ের খরচ কম, মুনাফাও বেশি।
কাজেই রণে বনে জলে জঙ্গলে সর্বত্র বিরাজ করছে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। সস্তা নির্ভরযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প প্যাকেজিং ছাড়া এর থেকে মুক্তির কোন পথ নেই। এগুলির বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ মোটেই সচেতন নন। আইন করে এর ব্যবহার বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অন্য রাজ্যের কথা জানি না, বাংলায় কিন্তু সাবেক আমলের সেই চটের থলি পাতলা ক্যারিব্যাগের একটা চমৎকার বিকল্প হতে পারে। চটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়লে বাংলার চটকলগুলোও চাঙ্গা হবে। আমরা ভাবতে পারি পুরনো আমলে যাতে করে মিষ্টির দোকান থেকে কচুরি, শিঙাড়া, মিষ্টি কিনে আনার জন্য শালপাতার ঠোঙা কিংবা মাটির ভাঁড়ের ব্যবহার আবার বেশি করে চালু করার কথা। দুটোই প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে একটু অন্যরকমভাবে ভাবলেই সমাধান মিলবে। এই ভাবনাটা আমাদের পরিবেশের দূষণ মুক্তি এবং নিজেদের স্বাস্থ্যের কারণেই খুব জরুরি, নইলে প্লাস্টিকের স্তূপে ডুবে যাব আমরা। তুচ্ছ ভেবে যে প্লাস্টিকগুলিকে হাওয়ার উড়িয়ে দিয়েছি সেটাই এখন আমাদের শ্বাসরোধ করতে আসছে। শুধু ক্যারিব্যাগ বন্ধ করার কথা বললে কোনও কাজ হবে না। বলতে হবে পরিবেশবান্ধব নির্ভরযোগ্য বিকল্পের কথা, দেখতে হবে তার দাম যেন মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকে। না-হলে তা ব্যবহারে কেউ উৎসাহী হবেন না। পাট, মাটির পাত্র ও ভাঁড়, শালপাতা, কলাপাতা, কচুরিপানার মত প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর পরিবেশবান্ধব বিকল্প প্যাকেজিংয়ের কথা না-ভাবলে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে লড়াই নেহাত কথার কথাই থেকে যাবে।