একেবারে অবিবেচকের মতো কাজ হয়েছে। উচ্চপদস্থ আমলার দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা এই মন্তব্যের সঙ্গে গোটা রাজ্য একমত। দার্জিলিং থেকে দীঘা, সুন্দরবন থেকে জঙ্গলমহল সর্বত্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ মহিলা অফিসার, তাঁর চিকিৎসক স্বামী ও বিলেত ফেরত সন্তানের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের। দাবি উঠেছে শাস্তির। খুবই স্বাভাবিক। কারণ তাঁদের এহেন অবিবেচক কাজের জন্য নবান্ন থেকে গোটা কলকাতা শহর আতঙ্কে ভুগছে। শিক্ষিত মানুষজন যখন অবিবেচকের মতো কাজ করেন, তখন ক্ষোভের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে তাঁর প্রভাব খাটানোর বিষয়টি সামনে আসায়।
নিয়ম অনুযায়ী পদস্থ আমলার ‘বিলেত ফেরত’ পুত্রকে চিকিৎসা করানোর এবং আইসোলেশনে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তা তিনি মানেননি। উল্টে প্রভাব খাটিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন বাড়ি। তারপরেও যদি নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখতেন, তাহলেও এত জলঘোলা হতো না। কিন্তু, তা না করে ওই ‘বিলেত ফেরত’ তরুণ শপিং মলে ঘুরেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। টনক নড়েছে তখন, যখন তিনি জেনেছেন, ভারতে ফেরার আগে পার্টিতে অংশ নেওয়া তাঁর বান্ধবী করোনায় আক্রান্ত।
ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কারণ এই ভয়ঙ্কর খবরটি আসার আগেই ওই তরুণের মা নবান্নে গিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। সেই সমস্ত বৈঠকে আবার স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্য পুলিসের প্রধান সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরই অবিবেচক কাজের জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে সস্ত্রীক গৃহবন্দি হতে হয়েছে। অথচ কারোনা নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল ভীষণ জরুরি।
শিক্ষার রকমভেদ আছে। তবে দু’ধরনের শিক্ষা আমাদের জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পুঁথিগত শিক্ষা এবং অর্জিত শিক্ষা। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ওই উচ্চপদস্থ আমলার পরিবারের পুঁথিগত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু, তাঁদের কর্মকাণ্ডে অর্জিত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আরও একটা কথা, মান আর হুঁশের প্রকৃত সমন্বয়েই হয় মানুষ। এখানে হুঁশের অনুপস্থিতি ভয়ঙ্করভাবে প্রকট।
এক্ষেত্রে বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের এক গৃহবধূর সচেতনার কথা উল্লেখ করা খুবই জরুরি। কাটোয়া শহরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের স্টেডিয়াম পাড়ার এক বস্ত্র ব্যবসায়ী কার্শিয়াং বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি ফিরতেই তাঁর স্ত্রী জানিয়ে দেন, আগে করোনা হয়েছে কি না তা টেস্ট করাতে হবে, তারপর জায়গা হবে বাড়িতে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর নীচেরতলার গ্যারেজে স্বামীর রাতটুকু কাটানোর অনুমতি মেলে। পরের দিন সাত সকালে ওই বস্ত্র ব্যবসায়ী ছোটেন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষা করিয়ে করোনা হয়নি নিশ্চিত হওয়ার পর বাড়িতে জায়গা পান। তবে, ১৪দিন না হওয়ায় এখনও দোতলায় ওঠার অনুমতি পাননি। জায়গা হয়েছে সেই গ্যারেজেই। চিকিৎসকের নির্দেশমতো ১৪দিন আইসোলেশন দশার পর করোনার কোনও উপসর্গ ধরা না পড়লেই মিলবে দোতলায় যাওয়ার ছাড়পত্র। একেই বলে, অর্জিত শিক্ষা। যা বহু ক্ষেত্রেই পুঁথিগত শিক্ষাকে ছাপিয়ে যায় অনায়াসেই।
প্রশাসনের উচ্চপদে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনেকে অল্প বিস্তর প্রিভিলেজ পেয়ে এবং নিয়ে থাকেন। তার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা প্রভাবও খাটিয়ে থাকেন। কিন্তু, প্রভাব খাটানোর সময় একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, তাঁর খাটানো প্রভাব অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে কি না। যখনই কোনও প্রভাবশালী এই বিষয়টি ভুলে যান বা অস্বীকার করেন তখনই তিনি হয়ে ওঠেন সমালোচনা এবং শাস্তির যোগ্য।
নোভেল করোনার আতঙ্কে গোটা বিশ্ব কাঁপছে। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি ‘উচ্চশিক্ষিত’ পরিবারের অবিবেচক কাজের জন্য করোনা আক্রান্ত রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম উঠে এসেছে। বিপদ উপলব্ধি করে করোনা মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরাজ্যে মহামারী আইন ১৮৯৭ লাগু করেছেন। সেই আইনেই ওই পদস্থ আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন। সেই দাবি পূরণ না হলে ভবিষ্যতে প্রভাবশালীদের প্রভাব খাটানোর সীমা বারবার লঙ্ঘিত হবে, একথা হলফ করে বলা যায়।