খালি হাতে মানুষের মল সংগ্রহ এবং তা মাথায় করে বহনের প্রথা নিষিদ্ধ করতে ভারতে আইন তৈরি হয়েছে ১৯৯৩ সালে। তবু সিকি শতক পরেও কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না যে, প্রথাটি নির্মূল হয়ে গিয়েছে। সব রাজ্যে এমন কিছু সম্প্রদায় আছে বংশপরম্পরায় যাদের একমাত্র পেশা উচ্চ ও মধ্য বর্ণের মল এবং তাদের বাড়ির যাবতীয় ময়লা সাফ করা। যে-বয়সে একটি সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েও স্কুলে পড়তে যায়, সেই বয়সে ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের হাত ধরে বেরয় নোংরা সাফ করার কাজে। তারা ধরেই নেয় এটাই তাদের কাজ। বড় হয়ে এটাই তাদের করতে হবে। অন্যকোনও পেশায় যাওয়ার সুযোগ কিংবা অধিকার তাদের নেই। অন্য পেশায় হয়তো তাদের মানায়ও না—এমন সংশয় এদের মনে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। রকমারি পোশাকি প্রচার অভিযান হওয়ার পরেও তাদের এই দুর্বলতা সংশয় ভয় দূর করা যায়নি। বাড়ি বাড়ি যত ময়লা জমে সাফাইকর্মীরা রোজ সকালে সেগুলি সংগ্রহ করেন। পুরসভার গাড়িতে করে ঠেলে নিয়ে জড়ো করেন একটি বড় ভ্যাটে। সেখান থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বড় কোনও ময়লাখোলায়। যেমন কলকাতায় ধাপা। ‘ভদ্রলোকরা’ যে ময়লা দেখে বিশেষ দূরত্ব তৈরি করেন এবং নাকে মুখে রুমাল চাপা দেন, সাফাইকর্মীদের সেই ময়লা সাফ করতে হয় হাতে করে, এবং নির্বিকার চিত্তে। এজন্য তাঁদের সামান্য গ্লাভস কিংবা মাস্ক দেওয়া হয় না। আরও পরিতাপের বিষয় হল, সেফটিক ট্যাঙ্ক এবং ম্যানহোল সাফ করতে অনেক সময়ই তাঁদের ওইগুলির গভীরে নেমে যেতে হয়। একথা কারও অজানা নয় যে, তরল বা সেমি সলিড ময়লা-জমা ওই ট্যাঙ্ক এবং ম্যানহোলের ভিতরে একাধিক বিষাক্ত গ্যাস জমা থাকে। তবুও সাফাইকর্মীদের জন্য বিশেষ পোশাক, মাস্ক কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হয় না। ফলে যে-কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে—সাফাইকর্মীরা গুরুতর অসুস্থ হতে পারেন, এমনকী তাঁদের প্রাণহানিও ঘটতে পারে। বলা বাহুল্য, সবচেয়ে কঠিন এবং বিপজ্জনক কাজটি যাঁরা করেন তাঁদের মজুরি অনেক শ্রমিকের চেয়ে কম। নারী, পুরুষ এবং শিশু ভেদে মজুরির বৈষম্যও মারাত্মক। এদের চাকরির স্থায়িত্ব খুব জায়গায়। বেশিরভাগই ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। এমনকী রেলের মতো বৃহত্তম নিয়োগ সংস্থাতেও সাফাইকর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা কী আছে—তা নিয়ে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। দেশজুড়ে দূরপাল্লার ট্রেনের নীচে যত কাঁচা ময়লা জমা হয় সব তাঁদের হাতে করেই সাফ করতে হয়। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে চালু করেছেন ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান। টিভিতে, কাগজে দেখা যায়, তিনি কোনও কোনও বিশেষ দিনে ঝাড়ু হাতে সাফাই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁকে অনুকরণ করে প্রচারের আলোয় আসেন আরও অনেক নেতা-মন্ত্রী। ব্যাপারটি দেখতে এবং ভাবতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু সাফাইয়ের কাজটি যাঁদের কঠিন হাতে করতে হয় তাঁদের ভাগ্য কিন্তু এভাবে বদলে যায়নি। তাঁরা এখনও অনেকাংশে নিদারুণ বাস্তবেই পড়ে রয়েছেন। অর্থাৎ ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর কোণে কোণে রয়েই গিয়েছে মারাত্মক অস্বচ্ছতা।
খবরে প্রকাশ, দেশের শীর্ষ আদালত সাফাইকর্মীদের এই দুর্ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও মানুষকে মৃত্যুর জন্য গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো হয় না। শুনানি চলাকালে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে সংশ্লিষ্ট ডিভিশন বেঞ্চ জানতে চায়, ‘‘ম্যানহোল সাফাইয়ে নিযুক্ত কর্মীদের মাস্ক ও অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া হয় না কেন?’’ ডিভিশন বেঞ্চ তারপর মন্তব্য করে, ‘‘পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় না।’’ সর্বোচ্চ আদালত এও জানিয়েছে, ম্যানহোলের ভিতরে জমা বিষাক্ত গ্যাসের কবলে পড়ে প্রতি মাসে অন্তত চার-পাঁচজন সাফাইকর্মীর মৃত্যু হয়। সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করেছে যে স্বাধীনতার সাত দশক পার করে এসেও ভারতে জাতপাত প্রথা এবং অস্পৃশ্যতা রয়ে গিয়েছে। সংবিধানের অঙ্গীকার মতো সকলে সমানাধিকার পায় না। সাফাইকর্মীদের যেভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয় সেটাকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেছে শীর্ষ আদালত।
আদালতের ভর্ৎসনা অবশ্য এই প্রথম নয়। অতীতে বহু নিম্ন ও উচ্চ আদালত, এমনকী শীর্ষ আদালতও একাধিকবার এই প্রশ্নে কঠোর মন্তব্য করেছে এবং উল্লেখযোগ্য নির্দেশ দিয়েছে। তার পরেও চিত্রটা হতাশাজনক। দেশের প্রশাসন, দেশ পরিচালনার ব্যবস্থা আর কবে মানবিক হবে?