শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
অন্যরাও প্রতিক্রিয়া জানায় এবং করণীয় কিছু থাকলে করে। মনের ভাব কোনও একটি লিপির মাধ্যমে প্রকাশ হলে তাকে লিপিবদ্ধ করা বা লেখা বলে। যে ভাষায় মানুষ প্রথম ‘মা’ ডাকে এবং সন্তানকে ডেকে নরম বুকে তুলে নিয়ে উষ্ণতার ভাগ দেয় মা—সেটাই হল মানুষের মাতৃভাষা। মনের যেসব ভাবের কথা বলা হল সেগুলি একমাত্র মাতৃভাষাতেই ঠিকমতো ব্যক্ত করা সম্ভব।
কিন্তু ভাষা তো অসংখ্য! তাদের সঙ্গে কি আমরা কথা বলব না, তাদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান আমাদের আটকে থাকবে? না। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলব। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ও হবে। অন্যদের সঙ্গে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা সবই হবে। কিন্তু অন্য ভাষায় অন্যের সঙ্গে যখন আমার কথা হবে তখন সেটাকে বলব অনুবাদ বা ট্রান্সলেশন। এবং, সেও যখন আমার ভাষায় তার মনের ভাব প্রকাশ করবে সেটাকেও অনুবাদ হিসেবে ধরতে হবে। যোগাযোগ গড়ে তোলা এবং বৃদ্ধির জন্য অনুবাদের গুরুত্ব বিরাট নিঃসন্দেহে। কিন্তু অনুবাদের কিছু সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হয়। অনুবাদে কখনোই মূল ভাষার স্বাদ অনুভূতি আবেগ প্রভৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। দুই ভাষার মানুষ অনুবাদে কাছাকাছি যেতে পারে কিন্তু একাত্ম হয়ে যেতে পারে না। একাত্মতার অনুভূতিটি মাতৃভাষার একান্ত। শিক্ষিত সমাজ কথাবার্তায় এবং লেখাপত্রে অনুবাদের সাহায্য নিয়েও তাই মাতৃভাষার কাছে ফিরে আসে এক অজানা টানে। যারা মাতৃভাষা ভিন্ন আর কোনও ভাষার দুয়ার মাড়ায়নি তাদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। প্রতিটি ভাষা এইভাবে পৃথক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব সাহিত্য গড়ে উঠেছে। মানুষের ব্যক্তি এবং সমষ্টিগত পরিচয় নির্ধারণে মাতৃভাষার তুলনা নেই। মাতৃভাষা-পরিচয়ের ক্ষমতা ধর্মীয় পরিচয়কেও ছাপিয়ে। তার বড় প্রমাণ বাংলা ভাষা। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল—হিন্দুস্থান (ভারত) ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির নেপথ্যে ছিল মুসলিম জাতিসত্তার পৃথক স্বীকৃতি দাবি। কিন্তু, ধর্মের বন্ধন কতটা পলকা তা বোঝা গিয়েছিল মাত্র পাঁচ বছরের ভিতর। বাহান্নর (১৯৫২) বাংলা ভাষা আন্দোলন উর্দুওয়ালাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার বুকে বাংলাভাষী বীর সন্তানরা বুকের রক্ত দিতে পিছপা হয়নি। অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মানচিত্র সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির নেপথ্যে ছিল মাতৃভাষার প্রতি অগণিত বাংলাভাষীর সীমাহীন আবেগ ও ভালোবাসা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে নেমে অসমের শিলচরেও বুকের রক্ত দিয়েছে বাংলাভাষীরা। এই ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ার নয়। বরং মাতৃভাষার জন্য আত্মবলিদানের স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে। মাতৃভাষা নিয়ে এরকমই আবেগ আমরা লক্ষ করি দক্ষিণ ভারতেও। বিশেষত, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের মানুষের মাতৃভাষাপ্রীতি শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।
ভারত বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। ভারতের কোণে কোণে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। বহু ভাষা আর বহু ধর্মই এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নির্মাণের উপাদান। অখণ্ড ভারতের মন্ত্র হল এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। বৈচিত্র্য কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ হলে এই অখণ্ডতার সামনে প্রশ্নচিহ্ন খাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বইকি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ধর্ম ও ভাষা তাই কতটা স্পর্শকাতর। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দি দিবস’ পালন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘‘সারা ভারতের জন্য একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন। আর সেটা হল হিন্দি।’’ বিশ্বের দরবারে ভারতের ভাষাগত পরিচয় তুলে ধরতে এটা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। দেশবাসীর কাছে অমিত শাহের আহ্বান, ‘‘আপনারা মাতৃভাষায় কথা বলুন, পাশাপাশি হিন্দিও শিখুন।’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে অনেকে আরএসএসের কলকাঠির গন্ধ পাচ্ছে। তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক থেকে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। প্রতিবাদ চলছে পশ্চিমবঙ্গসহ আরও কিছু প্রদেশ থেকেও। এই বিরুদ্ধ স্বরকে কোনোভাবেই অসংগত বলা যাবে না। এই প্রতিবাদকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। কারণ, ভারতের মতো দেশে হিন্দি কিংবা অন্যকোনও একটি ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাত কাম্য নয়। তাতে অন্য ভাষা এবং সংস্কৃতিগুলির মধ্যে বৈষম্য বঞ্চনা ও বিপন্নতার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুরটি অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে এই অবাঞ্ছিত আশঙ্কা সমূলে বিনাশ করা দরকার।