মোদি সরকার মনে করে, ২৬/১১ মুম্বই হামলার জন্য দায়ী কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি। আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ) সংশোধনী সংসদে পাশ হয়েছে মাসাধিককাল আগে। সংশোধনী বিলটি পেশ করামাত্র কংগ্রেস এবং তার সহযোগী একাধিক দল বিলটির বিরোধিতা করেছিল। তাদের বক্তব্য, এই আইন ভয়ঙ্কর। ভারতটাকে পুলিস-রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলার মতলব দেখেছেন তাঁরা এর মধ্যে। বিলের উপর বিতর্কে অংশ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অভিযোগ করেন, ভারতের মাটিতে বৃহত্তম ওই জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী কংগ্রেসের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি। তাঁর দাবি, কংগ্রেস পোটা (প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট) প্রত্যাহার না-করলে ২৬/১১ ঘটত না। তিনি বলেন, সন্ত্রাসদমন আইনের অপব্যবহার রুখতেই তাঁদের সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনল। এই সংশোধিত আইনের বিশেষত্ব হল—এই আইনে কোনও গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও উপযুক্ত ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। তদন্তে দোষী চিহ্নিত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে এখন থেকে আর ডিরেক্টর জেনারেলের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক থাকবে না, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) অফিসার নিজের বিবেচনাতেই সেটা করতে পারবেন। উল্লেখ করা দরকার, ইউএপিএ সংশোধনী আইনের আগে এনআইএ সংশোধনী পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। এনআইএ-র পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। এনআইএ অফিসারদের ক্ষমতা এখন প্রায় পুলিসের মতোই এবং দেশব্যাপী। এমনকী বহির্ভারতে সংঘটিত অপরাধের তদন্তের ক্ষমতাও প্রাপ্ত হল এনআইএ। সংশোধিত কঠোরতর ইউএপিএ-র বিরোধীদের শুনিয়ে অমিত শাহ দাবি করেছেন, এ নতুন কিছু নয়—রাষ্ট্রসঙ্ঘ, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, এমনকী পাকিস্তানসহ অনেক জায়গাতেই এই আইন বলবৎ রয়েছে।
কঠোরতর ইউএপিএ হাতে পাওয়ার পর যা প্রত্যাশিত ছিল সেটাই ঘটল—মোদি সরকার বুধবার চার কুখ্যাত অপরাধীকে জঙ্গি (ইনডিভিজুয়াল টেররিস্ট) ঘোষণা করেছে। তারা হল জয়েশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহার, লস্কর-ই-তোইবার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান হাফিজ সইদ, মুম্বই হামলার মাস্টার মাইন্ড জাকিউর রহমান লাকভি এবং মুম্বইয়ের অন্ধকার জগতের বাদশা বা ডন দাউদ ইব্রাহিম। ইউএপিএ কঠোরতর করার যুক্তি দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন, পুরনো আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও অনেক কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠনকে দমানো যায়নি। পুরনো সংগঠনের মাস্টার মাইন্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের নামটি দ্রুত বদলে ফেলে। তার পুরনো কার্যকলাপ নতুন পরিচয়েই চলতে থাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল লস্কর-ই-তোইবা এবং হাফিজ সইদের দিকে। কেন্দ্রের তরফে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের ব্যক্তিবিশেষকেও এবার সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গি ঘোষণা করা যাবে সংশোধিত ইউএপিএ-তে। কেন্দ্রের তরফে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে এই কুখ্যাত চার অপরাধীর ভারতের সঙ্গে শত্রুতার কীর্তি কাহিনীও সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। যা থেকে পরিষ্কার এই লোকগুলির অপরাধ মামুলি নয়, প্রকৃতিগতভাবেই তারা নৃশংস, তারা মানবতার শত্রু, মানবজাতির কলঙ্ক। স্বভাবতই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সংশোধিত ইউএপিএ অনুসারে এদের এবং এদের মতো আরও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে সরকার সক্ষম হবে। সরকার সেটা করতে পারলে দেশবাসী সরকারকে ধন্য ধন্য করবে। আশা করা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে সচরাচর যে-ধরনের ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে সেগুলিতে লাগাম পড়বে। দেশে অনাবশ্যক অশান্তি বিশৃঙ্খলা কমবে। দেশের সার্বিক বিকাশের অন্যতম শর্ত এই সুস্থিতি।
একইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে—এই আইনে যেন একজনও নিরপরাধ নির্দোষ ভারতবাসীকে কলঙ্কিত করা না-হয়, নিরপরাধ নির্দোষ কেউ যেন শাস্তি না-পান। আইনটির গুরুত্ব যেহেতু গভীর তাই এটি যে-কোনও প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার আগে তার সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলিও বিবেচনায় রাখতে হবে। শুধুমাত্র সরকারের বিরোধী বলে, সরকারের অন্যায়ের সমালোচক বলে কাউকে যেন দেশরক্ষার দোহাই দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া না-হয়। তাহলে এই আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি নষ্ট হয়ে যাবে।