শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
সেই সম্ভাবনার প্রতি গেরুয়া বাহিনী কতটা সুবিচার করে, বাড়তি ভোটের অঙ্কটা ধরে রাখতে বা তাকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবিজেপি নেতৃত্ব কী পদক্ষেপ করেন বঙ্গজনতার দেখার ছিল সেটাই। কারণ, অঙ্কের হিসেবে যে ২২ শতাংশ বাড়তি সমর্থন লোকসভায় বিজেপির রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাকে একলপ্তে শাসক তৃণমূলের প্রায় সমকক্ষ করে তুলেছিল তা যে পদ্মদলের একান্ত নিজস্ব ছিল না সেটা সকলেই জানেন। এবং এটাও জানেন, এ রাজ্যের মমতা বিরোধী ভোট বাম-কংগ্রেস ছেড়ে পুঞ্জীভূত হয়েছিল বিজেপির ভোটবাক্সে আর সেটাই বাংলার বিরোধী শিবিরে নতুন শক্তি হিসেবে বিজেপিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। সেই অগ্রগামিতা ধরে রাখতে বিজেপির যে কর্মসূচিগুলো জনতার নজরে কেড়েছিল তার মধ্যে সন্দেহ নেই অন্যতম ছিল মূলত মুকুল রায়ের উদ্যোগে তৃণমূলের ‘পদ্ম অভিলাষী’দের ঘরে তোলা এবং সেই সুবাদে এলাকা থেকে পুরবোর্ড যেখানে যেমন মেলে ‘দখল’। বীরভূমের বিতর্কিত মণিরুলকে নিয়ে সংঘ পরিবারে অসন্তোষ সৃষ্টির আগে অব্দি এই কর্মসূচি বেশ জমেও উঠেছিল। এ যাচ্ছে, সে আসছে, আজ দিল্লি কাল কলকাতা—এই বোর্ড তৃণমূলের হাতছাড়া আবার কদিন পরে দলবদলুদের ঘরে ফেরায় বোর্ড আবার তৃণমূলের ঝান্ডাতলে এবং এই বদলাবদলি নিয়ে ভাটপাড়া-জগদ্দল সমেত গোটা নৈহাটি-বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের মতো কত জায়গায় কত ধুন্ধুমার, মারদাঙ্গা খুনখারাপি, পুলিস প্রশাসনে যাকে বলে একেবারে তাধৈ মাধৈ অবস্থা! আবার এই বদলাবদলির আর এক চূড়ান্ত নাটকীয় রূপ দেখা গিয়েছিল কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের গেরুয়া শিবিরে যোগদান এবং অনতিকাল পরেই মুখ ফেরানোকে কেন্দ্র করে! সেই নাটকে যবনিকাপাত এখনও পুরোপুরি ঘটেছে কি না আমরা জানি না, তবে দলবদলের হিড়িকটা যে কোনও কারণেই হোক এখন অনেকটাই স্তিমিত। তথ্যভিজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বা রন্তিদেব সেনগুপ্তের মতো শীর্ষ নেতাদের চেতাবনি বিশেষ ক্রিয়াশীল।
অন্যদিকে, দলের অগ্রগতি ও বিস্তার বজায় রাখতে জনমন জয়ে বিজেপি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আর যেটা করেছে সেটা ‘আন্দোলন’, বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধাঁচে জঙ্গি প্রতিবাদ সংগঠিত করার চেষ্টা। কিন্তু, সেটা তো খুব সহজ নয়। আগেই বলেছি, মুশকিলটা হল ধারাবাহিকতার অভাব। তাছাড়া, মমতার মতো প্রাণ বাজি রেখে লাগাতার অমন একরোখা আগুনে আন্দোলন করার ক্ষমতাসম্পন্ন নেতানেত্রী আজ কোথায়? নেতানেত্রী থাকলেও পরিবেশের সেই আনুকূল্যও কি মিলবে? বাম আমলের শেষ অধ্যায়ে সিপিএমের একাংশের অবিরাম উৎপাতে ক্যাডাররাজের অত্যাচার লাঞ্ছনায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম শহর নগর মহানগরে সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে যে অগ্নিময় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর-নেতাই ইত্যাদি নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে যে উত্তাল ঝড়ঝঞ্ঝা সৃষ্টি হয়েছিল— এখন তেমন ইস্যুই বা কোথায়? বলছি না যে রাজ্যের শাসকদলের প্রতি মানুষের অসন্তোষ নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাম শহরের পরিষেবা পরিকাঠামো অর্থাৎ রাস্তাঘাট পানীয় জল স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ঘরে ঘরে কন্যাশ্রী স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি হাজারো সরকারি সহায়তা প্রকল্প যেভাবে পৌঁছে দিয়েছেন তাতে বাংলার মানুষের অনেক ক্ষোভ অসন্তোষই চাপা পড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, কট্টর মমতা বিরোধীদের কথা অবশ্যই আলাদা। তাঁরা হয়তো এখনও মমতা কী কী পারেননি, শিল্পায়ন-কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কতটা কী করল মুখ্যমন্ত্রী মমতার রাজ্য, মমতার দলের কারা সারদা-নারদায় অদূর ভবিষ্যতে ধরা পড়বেন—তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কল্পনা-জল্পনায় মশগুল। এবং এঁদেরই একটা বড় অংশ যে গত লোকসভা ভোটে বিজেপিকে ঢেলে দিয়েছে তাতেও বা সন্দেহ কী? কিন্তু গোল বেধেছে এবার। অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ঢেউ পশ্চিমবঙ্গে ওঠার উপক্রম হতেই মমতার অভক্তিবাদী দলে কোথায় যেন একটা শিরসিরানি গুনগুন করতে শুরু করেছে! এবার কী হবে? আমার পরিচিত এক চরম অভক্তিবাদী সেদিন কথায় কথায় বলছিলেন, মোদিজির আর সব তো ঠিকই আছে। তালাক বন্ধ কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা বন্ধ চাঁদে অভিযান—সব। কিন্তু এনআরসিটা কী হবে বোঝা যাচ্ছে না!
কেন বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অমিত শাহ তো স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, শরণার্থীরা নাগরিক। সমস্যা অনুপ্রবেশকারী নিয়ে। এনআরসি করে অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করলে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখলে ক্ষতি কোথায়! উত্তর এল তৎক্ষণাৎ—অসমে দেখছেন, এগারো লক্ষের ওপর হিন্দু বাঙালি আটকে গেছে। ওখানে তো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বজরং দলের মতো সংঘ পরিবারের প্রভাবশালী দুটি শাখা থেকেই প্রতিবাদ উঠেছে। তাহলে...! কথা ফুরোয় না তাঁর, ভারী হয়ে ওঠে মুখ। কপালে ভাঁজ গাঢ় হয়, তাহলে! আর এখান থেকেই সঙ্গতকারণে সমাজ-রাজনীতিতে সেই সংশয়ের উদ্ভব হচ্ছে, বাংলায় এনআরসি বিজেপির স্বপ্নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো! একথা আজ কারও অজানা নয়, বিজেপি ২০২১ সালের ভোট জিতে এ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে চায়। সেটাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোবাঞ্ছা এবং রাজ্য নেতৃত্বের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সফল করতে যাঁদের সমর্থন না অত্যাবশ্যক সেই মমতা বিরোধী মহলের মানুষজনের মনে যদি এহেন সংশয়ের উদয় হয় তবে যে কাজটি কঠিনতর হয়ে পড়বে— তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
এর মধ্যে আবার প্রায় পরপর দু-দুটি বোমা ফাটিয়ে দিলেন অমিতজি। এক, এক দেশ এক ভাষা বলে হিন্দিকে সর্বভারতীয় প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেন এবং দুই, ওই একই কারণে বহুদলীয় গণতন্ত্রের এই মহান ভারতে একদলীয় শাসনের নিদান দিলেন! দুটি নিয়েই আসমুদ্রহিমাচল ভারতে আলোড়ন পড়ে গেছে সন্দেহ নেই। হিন্দির একাধিপত্য কায়েমের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে বিগত শতকের ষাটের দশকে দেশ জুড়ে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে প্রবল হিংসা ও প্রাণহানির যে বিরাট ঘটনা ঘটেছিল, অমিত শাহের মন্তব্যের পর অনেকের মনেই তার স্মৃতি উসকে উঠেছে, এ নিয়ে বিতর্কে আলোচনাতেও তার মর্মান্তিক ছায়া পড়ছে। অন্যদিকে একদলীয় ‘গণতন্ত্র’ ব্যাপারেও ঝড় উঠতে চলেছে দেশের রাজনৈতিকমহলে। এনআরসির পাশাপাশি এই দুই নতুন ইস্যুতে সারা দেশে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। বাংলাও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। একদিকে এনআরসি নিয়ে অসমের মানুষের শঙ্কা-ক্ষোভ অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষার ওপর হিন্দির আগ্রাসন চিন্তা এবং একদলীয় শাসন কায়েম সম্ভাবনার উৎকণ্ঠা—সব মিলিয়ে বাঙালির বিজেপি সমর্থনের স্বতঃস্ফূর্ততা নিশ্চিতভাবেই কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। কট্টর মমতা বিরোধীদের মনেও জেগেছে দোলাচল—মোদিজি না মমতা কে অপেক্ষাকৃত শ্রেয়, কার কাছে অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত বাঙালির ভবিষ্যৎ? কদিন আগে বিকেলে সিঁথি থেকে শ্যামবাজার এনআরসির বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং ‘প্রাণ থাকতে বাংলায় এনআরসি হতে দেব না’ বলে ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ইস্যুতে সাধারণজনের বাড়তি আস্থা অর্জন করেছেন, এমনকী তাঁদেরও যাঁরা মনে করেন অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে এ রাজ্যেও এনআরসি করা উচিত। অসমের উদাহরণে তাঁদের বুকে যে ভয় জমেছে। পথেঘাটে কথায় আলোচনায় সে ভয় উঠে আসছে। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে মোবাইলে ইলেকশন কমিশনের অ্যাপ ডাউনলোড করে ডি-ভোটার হওয়ার কোপ থেকে বাঁচাতে চাওয়ার মধ্যেও সেই উদ্বেগ টের পাওয়া যাচ্ছে। না হলে অঙ্কের অমন নামজাদা অধ্যাপক কেন বলবেন, সে কি! এখনও করেননি! এখুনি ইলেকশন কমিশনের ভোটার হেল্পলাইন অ্যাপ ডাউনলোড করে তথ্য দিন। না হলে কিন্তু ডি-ভোটার করে দেবে। তখন ঝক্কি সামলাতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
এনআরসি নিয়ে বাংলার মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া এই শঙ্কা এই উদ্বেগের মোকাবিলা বিজেপিকে করতেই হবে। এবং করতে হবে ভোট ময়দানে নামার আগেই। সঙ্গে দোসর হিসেবে হিন্দির সর্বাত্মক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বার্তা নিয়ে শাসক তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেসের কড়া প্রতিক্রিয়া ও বাংলার জনমনে তার প্রভাবও সামলাতে হবে। এই তিন গুরুতর ‘সমস্যা’ তায় মুখ্যমন্ত্রী মমতার মতো অসাধারণ কৌশলী, অমিত প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সামলে বিজেপির বঙ্গনেতৃত্ব ২০২১ জয়ের লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত কতদূর এগতে পারেন এখন সেটাই দেখার। তাই না?