শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
সামাজিকভাবে ‘গৃহীত’ হওয়ার চেয়েও অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চান তাঁদের সাংসারিক শাখা, প্রশাখা, বিশেষত নাতি, নাতনিদের খবর পেতে এবং খবর দিতে। এক কোরিয়ান ঠাকুর্দা থাকেন ব্রাজিলে। দুই নাতি থাকে নিউইয়র্কে। নাতনি থাকে সাউথ কোরিয়ায়। দাদুর একা একা সময় কাটত না। ছবি এঁকে তিন নাতি-নাতনিকে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেন। যা শুধু নিজের প্রিয়জনদের জন্যে এঁকেছেন, তাই-ই-ক্রমশ ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শকের প্রশংসা পেয়েছে।
এ ভাবেই পূর্বপ্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের সাধ্যমতো কিছু বিতরণ করতে পারেন। সে গল্প হোক, গান হোক, ছবি হোক, উপদেশ, শুভকামনা, সবই তাঁদের হৃদয় থেকে উৎসারিত। ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞান মুহূর্তেই তা পৌঁছে দেয়।
ভ্রমণপিপাসু এক পঞ্চাশোর্ধ্ব দম্পতি গত দশ বছর ধরে সারা আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো ইত্যাদি গাড়ি চালিয়ে বেড়িয়েছেন। ইদানীং যাচ্ছেন ইউরোপের নানা দেশে। এঁদের ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক। এঁরা কখনও চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে তারপর অবসর নিয়ে দেশ ভ্রমণ আর তার সঙ্গে ‘জিপসি নেসটার’ নামে ব্লগ পাঠিয়ে যাচ্ছেন। ব্লগের মাধ্যমে পৃথিবীর ৩৬ হাজার ভ্রমণপিপাসুর কাছে পৌঁছে গেছেন। ‘জিপসি নেসটার’ অর্থাৎ ডেভিড আর ভেরোনিকা জেমস নামে প্রৌঢ় দম্পতির ছবি আর ভ্রমণবৃত্তান্ত দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই দেশ/বিদেশে বেরিয়ে পড়ছেন। ভ্রমণ তাঁদের একসূত্রে বেঁধেছে।
প্রৌঢ় শ্রমজীবী এক ছোট কন্ট্র্যাকটরও যে কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে লক্ষ লক্ষ লোককে অনুপ্রাণিত করতে পারেন, এসেনশিয়াল ক্র্যাফটসম্যান (ইউটিউব)-এর দর্শকরা তা জানেন। বাষট্টি বছরের স্কট ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর চল্লিশ বছরের কন্সট্রাকশন ব্যবসা। বছর তিনেক আগে নিজের দোকানে কাঠের কাজ করছিলেন। ছেলে তার ভিডিও তুলে ইউটিউব-এ দিয়েছিল। তারপর তাঁর পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ কর্মের আরও কিছু ভিডিও ওইভাবে দিয়েছিল। এর আশাতীত প্রতিক্রিয়া হল। ক্রমশ ৩২ মিলিয়ন লোক ইউটিউবের মাধ্যমে তাঁর করাত চালিয়ে গাছ কাটা থেকে শুরু করে কাঠ ও লোহার তৈরি জিনিস-এর কর্মপদ্ধতি দেখেন। ওই পেশার জন্যে শিক্ষা নেন। এক সামান্য কন্ট্র্যাকটরের জীবনে এই স্বীকৃতির মূল্য অনেক।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক রূপ, যৌবন, কর্মক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, শেষ হয়ে যাওয়ার দুর্ভাবনায় যে মিড লাইফ ক্রাইসিস-এর উপসর্গ দেখা দিতে পারে সেই সমস্যার সমাধানের জন্যেও সোশ্যাল মিডিয়ার আশ্রয় নেওয়া যায়। ‘কালেকটিভ কনসাসনেস, অর্থাৎ সম্মিলিত সচেতনতার শামিল হয়ে কিছু মানবিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায়। যুক্তি, প্রতিযুক্তি, সমাধানের চিন্তা থেকে পরোক্ষভাবে ও সোশ্যাল অ্যাকটিভিজম-এ অংশ নেওয়া যায়। এ জাতীয় বেশ কয়েকটি ইনস্টাগ্রাম-এ অনেক চিন্তাশীল মানুষ যুক্ত আছেন।
আমেরিকায় সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার কথা এ লেখায় অপ্রাসঙ্গিক। প্রচার ও আত্মপ্রচারের প্রয়োজনে জনসাধারণের মধ্যে এর ভূমিকা ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। সমালোচনা করে বলা হয় ‘ফেসবুক’ অ্যাকাউন্ট কারও মধ্যে আত্মপ্রেম, আত্মপ্রসাদ বাড়াতে সাহায্য করে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই নেগেটিভ দিকটির পরিবর্তে প্রৌঢ় বয়স্কদের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। এঁদের মধ্যে সাহিত্যস্পৃহা আর কৌতুকবোধ যেমন আছে, সেরকম আছে সঙ্গীতপ্রীতি। কেউ ‘ব্লগ’-এ সাহিত্যচর্চা করছেন। পত্র, পত্রিকায় লেখা ছাপা না হোক, দেশ/ দেশান্তরে ফেসবুকে পাঠক পাওয়া যাচ্ছে। রসিক বুড়োর দল সকাল বিকেল ‘জোকস’ বিতরণ করছেন। এই বয়সে রসে বশে থাকার জন্যেই তো এমন উৎসাহ।
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও প্রফেশন্যাল জগতের সঙ্গে যোগসূত্র রাখতে সাহায্য করে লিংকডিন। কেউ কর্মজীবনে অবসর নিয়ে থাকুন বা নাই থাকুন, প্রফেশন্যাল লোকজনদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।
মধ্যবয়সে বিভিন্ন বিনোদন, পত্রপত্রিকা ও বইপড়া, সিনেমা দেখা, গানবাজনা শোনা, এমনকী ধর্মকথা শোনার জন্যেও অনলাইন-এর সহায়তা পাওয়া যায়। এখানে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালিদের প্রায় সকলেরই একটা সাপ্তাহিক রুটিন আছে। নিত্যদিন পশ্চিমবঙ্গের খবর পড়ার পরে কোনও কিছু একটা দেখা বা শোনা হল। আজ দুটো বাংলা সিনেমা, তো কাল প্রচুর গান শোনা। পরশু রাতে নিউইয়র্কের রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজির বেদান্ত ব্যাখ্যা (ইউটিউব)। বাকি কিছুটা সময় ফেসবুক, ই-মেইল। দেশ-দেশান্তরে আত্মীয়, বন্ধুদের খবর দেওয়া-নেওয়া। শুধু মনে একটা দুঃখ। এঁদের অধিকাংশেরই দাদু, ঠাকুমা, এমনকী বাবা-মা বেঁচে থাকতেও ঘরে ঘরে স্মার্ট ফোন ছিল না, ফেস্টাইম ছিল না...।
সব শেষে প্রশ্ন আসছে, প্রৌঢ় বয়সে বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা কি ভালো? মানুষ কি ঘরকুনো হয়ে পড়ছে না? পাশের প্রতিবেশীকে এড়িয়ে দূরের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, প্রয়োজনীয় পারিবারিক ও সামাজিক দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করছে?
ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরা বয়স্ক মানুষের অতিরিক্ত অন-লাইন প্রীতি একেবারেই সমর্থন করছেন না। তাঁদের সম্মিলিত অভিমত মস্তিষ্ক চর্চার প্রয়োজনে লাগাতর বসে থাকা শরীর-স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ইন্টারনেটে বসে থাকার নেশা শরীরে আলস্য সৃষ্টি করে। চোখের ক্লান্তি ছাড়াও রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকার প্রবণতা থেকে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। এ বিষয়ে এঁদের কিছু উপদেশ আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সংযুক্ত থাকতে হলে শুধু নিজের কথা শোনানো নয়, অন্যদের কথা জানতে হবে। এ আদান-প্রদানের পথ। তবে সকলের সব কিছু দেখে, শুনে যে বিশ্বাস করতে হবে। তাও কিন্তু নয়। মত বিরোধ, অতিরিক্ত মন্তব্যপ্রকাশ এড়িয়ে চলা উচিত। নিজের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখা দরকার। কারণ ফেসবুকে বেশি ব্যক্তিগত খবর দিলে এমনকী কবে কোথায় যাওয়া বা থাকা হবে, সে খবর দেওয়া সম্পর্কেও সতর্ক থাকা দরকার। কারণ স্ক্যামার বা অপরাধীরা সুযোগের সন্ধানে থাকে। কোনও ভাবে ওই পোস্টিং থেকেই ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর, ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ইত্যাদি পেয়ে যেতে পারে। ‘সার্ভে ডেটা’ বিক্রির ব্যবসা এই অপরাধীদের প্রধান কাজ। গত বছরেও ১৬.৭ মিলিয়ন লোকের এভাবে আইডেনটিটি চুরি গেছে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, সোশ্যাল সিকিউরিটির ভাতা, সর্বত্র এদের করালগ্রাসের ফলে মানুষের আর্থিক বিপর্যয় ঘটছে।
এ সমস্ত কারণে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তবে সোশ্যাল মিডিয়া যে যুগান্তর এনেছে, অন্তর্জালের সেই বন্ধনে বাঁধা পড়ে প্রৌঢ় জীবনে একাকিত্ব দূর হচ্ছে প্রযুক্তির এও এক অবদান।