শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
সেই ইগোর আঘাত থেকে চীনের দিক থেকে ধেয়ে এসেছে তিনটি প্রতিক্রিয়া: (১) চীন মনে করছে এই পরিবর্তনের ফলে তার ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছে, বিশেষত সংখ্যাগুরু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সন্নিবিষ্ট লাদাখ-কে ভারত নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করায় চীনের কাছে মনে হয়েছে ভারতের এই চাল তিব্বত ইস্যুকে ইন্ধন জোগাবে। অথচ খুঁটিয়ে দেখলে আমরা দেখব ভারত স্বাধীনতার পর থেকে তিব্বত নিয়ে যতটা ভেবেছে, তার বিন্দুমাত্র চিন্তাও সে লাদাখ-নীতি প্রণয়নে ব্যয় করেনি। যদি তাই হতো তাহলে পূর্ব লাদাখের বিস্তৃত ক্ষেত্র, এমনকী যা কৈলাসের মানস সরোবর পর্যন্ত সম্প্রসারিত, তাকে নিয়ে এখনকার মতো ভারতকে নতুন করে চিন্তা করতে হতো না। (২) ভারত-পাক বিবাদে চীন খানিকটা বড়দার মতো উভয়পক্ষকে সংযত হতে বলেছে। (৩) এখানেও না থেমে চীন ভারতের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও নালিশ ঠুকেছে।
অবশ্য এসব কিছুকে উপচে ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে আরও তিনটি কড়া আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। প্রথমেই বলা যেতে পারে ইরানের কথা। ইরানের কথা আসতেই ভারতের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। আবার ভারত বরাবরই তার অপরিশোধিত তেল আমদানির সিংহভাগই ইরানের থেকে করে আসছে। এই ভারত-ইরান বাণিজ্যিক বোঝাপড়া এতটাই উভয় পক্ষের বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, ভারতীয় মুদ্রায় তেলের দাম নিতে ইরান রাজি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানকে বাইপাস করে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর ভারতীয় নকশার বড় সহায় ইরানের চাবাহার বন্দর-শহর। তাছাড়া গত জুলাই মাসে হরমুজ স্ট্রেটে ইরান যখন একটি ব্রিটিশ তৈল জাহাজকে আটক করে, যা নিয়ে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা ইরান কর্তৃক মার্কিন নজরদারি ড্রোনকে গুলি করে ভূপতিত করার বিতর্কে নতুন ইন্ধন জোগায়, সেই অবস্থাতেও ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রিয়াধ নয়জন ভারতীয় নাবিককে মুক্তি দিয়েছিল। এহেন ইরানের কাছে যেটা প্রত্যাশিত ছিল না, সেই অনভিপ্রেত বার্তাই ধেয়ে আসে যখন ভারত ৩৭০ ধারা লোপ করে। খোমেইনির ইরান ভারতের পদক্ষেপে উষ্মা ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেনি।
দ্বিতীয়ত, ভারতের পদক্ষেপকে সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছে এরদোগানের তুর্কিকে। তুর্কি কেবল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনন্য স্থান অধিকার করেই নয়, বরং ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও তার বিশেষ প্রভাব রয়েছে।
তৃতীয়ত, ভারতের দিক থেকে বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে যখন মার্কিন বিদেশনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, তখন খানিকটা ইমরানের পাকিস্তানকে তোয়াজ করতেই ট্রাম্প কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। ভারতের দিক থেকে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটে ট্রাম্পের ২৩ জুলাইয়ের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয় মোদির কথাতেই তিনি এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। ফলে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে হঠাৎ এতটাই পারদ চড়তে শুরু করেছিল যে, কেবল সামরিক আঁট-দরাজে আর কাজ হচ্ছিল না। সংবিধান সংশোধনের রাজনৈতিক ভাবনার সূত্রপাত সেখান থেকেই।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেটা উচিত ছিল তা হল ভারতের নমনীয় শক্তির ব্যবহার তথা কূটনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে এই পদক্ষেপের সমর্থনে পোক্ত জমি তৈরি করা। ৩৭০ ধারার মতো এত বড় মাপের পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্ব মুহূর্তে ভারত আমেরিকা, রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিগুলিকে অবহিত করলেও ভারতের উচিত ছিল আরও গুছিয়ে ‘হোমওয়ার্ক’ করা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম এই অসময়ে ভারতের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসেবে অবতীর্ণ হলেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। দোভাল যখন কাশ্মীরে, তখন জয়শঙ্কর কূটনৈতিক দৌত্যের জোয়াল কাঁধে নিয়ে হাজির চীনে। তাতেও যে চিঁড়ে ভেজেনি, তার প্রমাণ মিলল যখন রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক—চীনের এমন প্রস্তাবে বেশ বিব্রতভাবেই, যদিও মুখে হাসি নিয়ে, কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত ঋজুতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করলেন ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন।
বস্তুত একটা সময় মনে হয়েছিল সরকার কতটা এই নার্ভের উপর চাপ নিতে প্রস্তুত? কারণ কাশ্মীরকে ঘিরে কেবল উপত্যকার রাজনীতিই যে আবর্তিত হয়েছে—এমনটা নয়, বরং গত সাত দশকে কাশ্মীর নীতি যেভাবে কেন্দ্র-রাজ্য পারস্পরিক দোষারোপের ও রাজনীতির পাশা খেলার একটা মুখ্য ঘুঁটি হয়ে উঠেছিল, তাতে করে কাশ্মীরবাসীর উন্নয়ন তো দূর অস্ত, বরং ‘দশচক্রে ভগবান ভূতের’ মতো অবস্থা হয়েছিল। পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল তা বোঝা গিয়েছিল পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনা কনভয়ের উপর জঙ্গি-হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছিল, ততই আমরা দেখছিলাম কাশ্মীরের যে ভাবাবেগ তাকে কাজে লাগিয়ে সেখানে ইসলামিক ক্যালিফেট গড়ে তোলার ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের মোক্ষম চালের মাধ্যমে যখন ৩৭০ ধারা রদ হল, তখন অচিরে বোঝাই গিয়েছিল যে সঙ্কট কাটিয়ে অচিরে উপত্যকায় নতুন সূর্যোদয় হবে। কিন্তু বাহ্যিক পরিস্থিতিকে খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য মনে হয় না এতটা জোরালো পরিকল্পিত আয়োজন আমাদের ছিল। এর কারণ:
প্রথমত, আমরা বারবার আমেরিকাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে এক আসনে বসানো চলে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতের এই পদক্ষেপের ঠিক পরে পরেই পাকিস্তানের তরফে একাধিক পদক্ষেপ করা হয়, যার মধ্যে ভারতের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ককে বাতিল করা থেকে ভারতীয় কনভয়ের বহিষ্কার, সমঝোতা এক্সপ্রেস, বাস-সার্ভিস বাতিলের মতো একতরফা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হিড়িক আমরা লক্ষ করি। এখানেও না থেমে পাকিস্তান তার ঘনীভূত অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে ভারতের বিরুদ্ধে পুনরায় জঙ্গি আক্রমণের হুমকি দিতে থাকে। কাশ্মীরের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাব সীমান্তে কর্তারপুর করিডরকে খালিস্তানি জঙ্গিদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করার চরম হুঁশিয়ারিও দিতে থাকে।
তৃতীয়ত, পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠলে শেষ অবধি আসরে নামতে দেখা গেল প্রবীণ রাজনাথ সিংকে। মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েই তিনি কূটনৈতিক ভঙ্গিমায় এমন বার্তাও দিলেন যে, ভারত প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার স্ব-ঘোষিত 'No First use doctrine' থেকে সরে আসতে পারে।
চতুর্থত, উপমহাদেশের রাজনীতিতে কাশ্মীর ইস্যুর মহিমা মালুম হল যখন আমরা দেখলাম ভারতের এ-স্যাট উৎক্ষেপণ ও চন্দ্রযান-২ অভিযান পাবলিক ডোমেনে আলোচনার মধ্যে যে বৌদ্ধিক ঝোঁক সম্প্রতি নিয়ে এসেছিল, তার রং পুরো পাল্টে গেল। পুনরায় আমরা যেন একটা নিরাপত্তা সঙ্কটের মধ্যে বাস করছি এমন হবসীয় বাতাবরণ প্রকাণ্ড পর্দার মতো আমাদের অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা, আঞ্চলিক সহযোগিতা যা বাণিজ্যিক ভ্যালু চেনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত—এইসব বিষয়গুলোকে মুহূর্তে যেন অন্তরালে ঠেলে দিল। বলা বেশ কঠিন ভারতীয় কূটনীতি সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশে কতটা আলোর দিশা দেখাতে পারবে।
লেখক অধিকর্তা, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়