শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
শুরু থেকেই ছিল বিপত্তি! গত ১৪ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে চন্দ্রযান ২-এর যাত্রা থমকে গিয়েছিল শেষ মুহূর্তে। ত্রুটি সামলে এক সপ্তাহ পরেই গত ২২ জুলাই বাহুবলী রকেটের ঘাড়ে চেপে রওনা দিয়েছিল ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান। তখনই ঠিক হয়েছিল যাত্রা পিছিয়ে গেলেও আগের নির্ধারিত দিনেই গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে চন্দ্রযান ২-কে। যাত্রা পিছিয়ে গেলেও পৌঁছনোর দিন একই রাখায় প্রশ্ন উঠেছিল, তাতে কোনও বিপত্তি হবে না তো! ইসরো আশ্বাস দিয়েছিল, এরজন্য গতি কিছুটা বাড়াতে হবে। পৃথিবীকে পাঁচ পাক ও চাঁদের চার পাশ পাঁচ পাক খাবে চন্দ্রযান ২। তার মাপজোকেও কিছু বদল অবশ্যই ঘটাতে হবে।
তবে কি একটু বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল ইসরো? নাকি এই তাড়াহুড়োর পিছনে ছিল রাজনৈতিক মহলের চাপ? এত বছরের পরিশ্রম বৃথা গেল? তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন সত্যি কি শেষ হয়ে গেল? কোথায় বিক্রম? কেন সে ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুমের কম্যান্ডের উত্তর দিল না? কোথায় গাফিলতি হল? সেই প্রশ্নই এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। কাকতালীয় ঘটনা বলতে পারেন, ৭ সেপ্টেম্বর ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের। সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার দিনেই এমন একটা সাফল্য আসতে চলেছে— প্রধানমন্ত্রী তা নিয়ে খুবই উৎসাহিত ছিলেন দিনভর। এক ঝাঁক ট্যুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই অভিযান ভারতের মেধা এবং নিষ্ঠার প্রমাণ। এই সাফল্য দেশের মানুষের উপকারে আসবে। আবার কোনও ট্যুইটে দেশবাসীকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে বলেছেন। কখনও জানিয়েছেন, তাঁর বেঙ্গালুরুতে আসার কথা। সারা দেশ থেকে কুইজের মাধ্যমে বেছে নেওয়া যে ৬০ পড়ুয়া বেঙ্গালুরুতে তাঁর সঙ্গে বসে অবতরণ দেখবে, ট্যুইট করেছেন তাদের নিয়েও। সাফল্যের তালিকায় চন্দ্র বিজয়কে জুড়ে নেওয়ার পক্ষে এমন ভালো দিন আর কী হতে পারত শাসক শিবিরের কাছে! কিন্তু হল না। নামার আগে হারিয়ে গেল বিক্রম। ইতিহাসকে আর ছোঁয়া যায়নি। সাফল্যের উচ্ছ্বাসও নিমেষে ম্লান। কিন্তু ভারতবাসী সমালোচনার পথে হাঁটেনি। ইসরোর ৪৮ দিনের সফল পথ যাত্রাকেই বাহবা দিচ্ছে। কেউ কেউ স্যালুট জানিয়েছে ইসরোকে। হিরোর মর্যাদা দিয়েছে কে শিভনকে। হিরোই বটে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’।
এত কম খরচে ভারতের চন্দ্রাভিযান কর্মসূচিতে রীতিমতো বিস্মিত গোটা দুনিয়া। গোটা প্রকল্পে খরচ ৯৭৮ কোটি টাকা,যা হলিউডের ছবি অ্যাভেঞ্জার্স: অ্যান্ড গেম–এর বাজেটের চেয়ে কম। বলেছিলেন রুশ মহাকাশচারী জেরিলিনেনগার। বলেছিলেন, ‘অভিযানের খরচ যত কম হবে, তত বেশিবার অভিযান করা যাবে। আর অভিযান থেকে যত বেশি আমরা শিখব, তত বেশি মানুষের জ্ঞানের জগৎ প্রসারিত হবে। তাই ইসরোর কাছে সকলের শেখা উচিত।’ ইসরো এত দিন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সর্বাধুনিক মিসাইল বানানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করত। মিসাইল বানাত। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সেগুলির উৎক্ষেপণ করত। কাগজে ছবি বেরত। কিন্তু সেই প্রযুক্তিটা কী, দেশের নিরাপত্তার কারণেই ইসরো সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকত। স্বাভাবিকভাবেই এখনও থাকে। কারণ, প্রযুক্তিটা সকলকে বলে দিলে তো শত্রু দেশও তা বানিয়ে ফেলবে! তাই গোপনীয়তা বজায় রাখতেই হতো, এখনও হয়। যেহেতু সেগুলি হয় প্রতিরক্ষা গবেষণা উন্নয়নসংস্থা (ডিআরডিও) বা কেন্দ্রীয় পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের (ডিএই) তত্ত্বাবধানে। চন্দ্রযান-২ সেই আড়ালটা ভেঙে দিয়েছে। চন্দ্রযান-২ কিন্তু ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুন হিরোর জন্ম দিয়েছে।
১৯৬৯ থেকে ২০১৯। ৫০ বছর ধরে বিজ্ঞানের নানা উপহার সারা বিশ্বের সামনে হাজির করে চলেছে ইসরো। শুরুতে সর্বাধিক ৪০ কেজি ওজনের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছিল ইসরো। সেখান থেকে আজ চন্দ্রযান ২ চাঁদের কক্ষপথে উড়ে গিয়েছিল ৪ হাজার কেজি ওজন নিয়ে। এই ৫০বছরের পথে অনেক চড়াই-উতরাই হয়েছে। বারবার হোঁচট খেয়েছে ইসরো। কিন্তু কখনও দমে যায়নি। বরং বারবারই নতুন করে ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে আরও বড় আকারে সাফল্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছে ইসরো। কে না জানে, বিশ্বের সামনে ইসরো এতটাই সফল যে, আমেরিকা, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, ইতালি, জার্মানি, জাপানও তাদের স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য আজ ইসরোর উপর ভরসা করে। ভারতের চন্দ্র-অভিযান প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ আমেরিকার। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে সে দেশের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসাও। জানিয়ে দিয়েছে, ইসরোর সঙ্গে যৌথভাবে সৌরজগৎ অন্বেষণের কাজ করতে চায় তারা। কারণ, ইসরোর অভিযান নাসার কাছে প্রেরণা জুগিয়েছে। ট্যুইটারে ইসরোকে ট্যাগ করে নাসা লিখেছে,‘মহাকাশটা কঠিন জায়গা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখতে ইসরোর চন্দ্রযান-২ অভিযান প্রশংসনীয়। একে অভিনন্দন জানাই। এই প্রেরণাদায়ক অভিযানের পর ভবিষ্যতে একসঙ্গে সৌরজগতের অন্বেষণ করতে আমরা উদ্বুদ্ধ।’ আমেরিকা জানিয়েছে, চন্দ্রযান-২ অভিযান ভারতের একটি বিরাট পদক্ষেপ। যা ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে রসদ জোগাবে।
আসলে ব্যর্থতার মধ্যেই রয়েছে আগামীর সাফল্যের সন্ধান। মনে করছে আসমুদ্র হিমাচল। ‘নাসা’র মতো গর্ব করার একটা সংস্থা আমার দেশেই রয়েছে। আগামী দিনে মৌল বিজ্ঞানের গবেষণায় যদি ইসরো বেশি বেশি করে হাত মেলায় দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাতে, তাতে নতুন প্রজন্মের লাভ যথেষ্টই। বিজ্ঞানে সাফল্য যেমন আছে, তেমনি আছে হতাশা। আর হতাশা আছে বলেই তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হয়েও চাঁদের মাটি ছোঁয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছে ভারত। জানা গিয়েছে, অরবিটারে থাকা ৮টা যন্ত্র এখনও ঠিকঠাক কাজ করে যাচ্ছে। আগামীদিনে আমরা যদি চাঁদে ঘাঁটি গাড়তে চাই, তা হলে জলের খোঁজ জরুরি। চাঁদে যে জল আছে, চন্দ্রযান-১ আমাদের আগেই সে খবর দিয়েছে। এখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কতটা জল আছে, মাটি থেকে কতটা নীচে, সেই জল বার করতে কতটা ঝামেলা হতে পারে— সব বলে দেবে অরবিটারে থাকা যন্ত্র। এই অরবিটারেই আছে দু’টো অত্যন্ত শক্তিশালী হাই-রেজলিউশন ক্যামেরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এর আগে কখনও পা পড়েনি। ওই অঞ্চলের মানচিত্র এনে দেবে এই দু’টি ক্যামেরা। এখানেই ভারতের চন্দ্রযান ২–এর অভিযানের সাফল্য। দ্বিতীয় চন্দ্রযানের অরবিটার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রচুর মূল্যবান তথ্য মেলার সম্ভাবনা। অবশ্যই এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সেই সাফল্য ৯৫ শতাংশ, না পুরোটাই ব্যর্থ, সে বিতর্ক থাকবেই। তা বলে এ নিয়ে বেশিদিন বসে থাকলে হতাশা আসতে বাধ্য।
বিক্রমের খোঁজ চালানোর পাশাপাশি এবার তাই চন্দ্রযানের তৃতীয় অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসরো। চেয়ারম্যান কে শিবন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন চন্দ্রযান-৩ মিশনের জন্য আলাদা টিম কাজ শুরু দিয়েছে। তবে এরপরের অভিযানটি হবে জাপানের সহযোগিতায়। নিয়ম মতো সব এগলে আরও এক ল্যান্ডারকে নিয়ে ২০২৪ সালে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই ফিরে যাবে ইসরো। শুধু চন্দ্রযান-৩ নয়,প্রস্তুতি শুরু হয়েছে সৌর মিশন ‘আদিত্য এল-১’,‘শুক্রযান-১’, ‘গগনযান’, ‘মঙ্গলযান-২’ ও চাঁদে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র বানানো নিয়েও। জাপানের এয়ারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি বা জাক্সার সঙ্গে যৌথভাবে চন্দ্রযান-৩ অভিযান করবে ভারত। সেই সময় চাঁদের মাটি খুঁড়ে পৃথিবীতে এনে গবেষণা করার কথা রয়েছে। জাক্সার উপগ্রহ বিশ্লেষক যান হায়াবুসা-২ গত জুলাই মাসেই দ্বিতীয়বারের জন্য ঝুঁকিবহুল একটি উপগ্রহে গিয়ে নেমেছে। কোনও বিপদসঙ্কুল জায়গায় ঝুঁকি নিয়ে নামতে তারা কতটা সফল তা প্রমাণ করে দিয়েছে। ২০২৪-এর যৌথ মিশন অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ঠিক রয়েছে রকেট আর রোভার তৈরি ও তাকে প্রেরণের দায়িত্ব থাকবে জাপানের উপর। আর ল্যান্ডার পাঠাবে ভারত। রোভারটি চাঁদে ড্রিল করে মাটি-পাথর তুলে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। বিশ্বে এই প্রথম দুই দেশ যৌথভাবে চাঁদে মানববিহীন যান পাঠিয়ে সেখানকার মাটি নিয়ে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেছে। ২০৩০ সালে একটি মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। আর তা রয়েছে সেই চাঁদেই। এই অভিযান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা মহাকাশ বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালামের স্বপ্ন। তাঁর যুক্তি ছিল, চাঁদে ল্যাবরেটরি, মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র বানাতে খরচ কম পড়বে। ইসরোর হাতে অনেক কাজ। অনেক।
ইতিমধ্যে ইসরো জানিয়েছে, এক বছর কাজ করার কথা থাকলেও অরবিটারটি সাত বছর ধরে কাজ করতে পারবে। কারণ, সফল ও উন্নত উৎক্ষেপণের ফলে অরবিটারের জ্বালানি কম খরচ হয়েছে এবং কর্মক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে। বিক্রমের কী অবস্থা, তা জানতে ইসরোর ভরসা ওই অরবিটার। সেটা কী কম সাফল্য? ইসরোর কয়েক হাজার বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়ার তো বটেই, এত জটিলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রায় শিখর ছোঁয়া জীবনের ক্ষেত্রেও একটা বড় শিক্ষা। কিন্তু তারও চেয়ে মূল্যবান কথা এই যে, এই প্রজন্মের ভারতীয়রা একটা অন্ধকার অতীত পিছনে ফেলে মহাকাশ অভিযানের পথে এগিয়ে গেলেন। আর একটা সাফল্যের পিছনে থাকে অজস্র ব্যর্থতা! বিজ্ঞানের ইতিহাসই তো ইসরোর সম্বল। যে ইতিহাসে রয়েছে ১৯৭৯ সালে ভারতের প্রথম উপগ্রহ প্রেরণের ব্যর্থতা।
কালামের জেদেই ভেঙে পড়েছিল ইসরোর রোহিনী। না, তারপরেও এ পি জে আব্দুল কালামকে সে দিন ‘ফায়ার’ করেননি ইসরোর তদানীন্তন চেয়ারম্যান সতীশ ধাওয়ান! বলেননি, ‘দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল কালামকে’! তার এক বছরের মধ্যেই ধরা দিয়েছিল সাফল্য। ধাওয়ানের নির্দেশে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেই কালাম-ই। তাঁর কথায়, ‘ওই দিন আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ পাঠ পেয়েছিলাম। ব্যর্থতা এলে তার দায় সংস্থার প্রধানের। কিন্তু,সাফল্য পেলে তা দলের সকলের। এটা কোনও পুঁথি পড়ে আমাকে শিখতে হয়নি। এটা অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত।’ ব্যর্থতার সময় গোটা দেশ যখন ক্ষিপ্ত তখন সতীশ ধাওয়ান আড়াল করে রেখেছিলেন তাঁর বিজ্ঞানীদের। সাফল্যের পর সবাই যখন ফুলের মালা নিয়ে বরণ করতে প্রস্তুত তিনি তখন সামনে এগিয়ে দিয়েছেন অভিনন্দনের আসল দাবিদারকে। বিক্রম সারাভাইয়ের হাতে জন্মের পর থেকে ইসরো এই ভাবেই চলে এসেছে। এখনও চলছে। অভিনন্দন ইসরোর বিজ্ঞানীদের। থমকে যাবেন না। আপনাদের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। সাফল্যের খোঁজে আগামীর ভারত।