শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
কিন্তু কীভাবে? তিনি বলেছেন, সংযুক্তির ফলে ব্যাঙ্কের মূলধনের অভাব হবে না । নতুন শিল্প তৈরিতে ঋণ যাতে অনেক পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া যায় তার ব্যাবস্থা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, ঝুঁকিটা ভালোভাবে নেওয়া যাবে।
লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, অর্থমন্ত্রী একবারও বলেননি ব্যাঙ্কগুলোকে সংযুক্ত করে জনগণের আর্থিক ক্ষমতা বাড়াতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্কিমে প্রচুর ঋণদান বাড়ানো হবে। তিনি আরও বলেননি, গ্রামে শহরে সমাজের সর্বস্তরে আর্থিক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হবে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের উদ্দেশ্য। এও বলেননি, সংযুক্তির মধ্য দিয়ে আম জনতার আর্থিক সক্ষমতা ও আর্থিক সুবিধা প্রসারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে মূলত দুটি কারণ উল্লেখ করে এই সংযুক্তিকে খুব যুক্তিগ্রাহ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রথমত বলা হচ্ছে, এর ফলে ব্যাঙ্কগুলোতে পুঁজির ঘাটতি হবে না। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও দ্রুত ও নিশ্চিতভাবে ঋণ দান করা যাবে। তাতে মূলধন ও ঝুঁকির আনুপাতিক হিসেবটা অনেক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এই কথা শোনা গেছে অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিবের মুখে। সংযুক্তিকরণ প্রসঙ্গে, এমনকী, এসবিআই-এর চেয়ারম্যানকেও এমন কথা বলতে শোনা গেছে।
জানা গেছে, আরও দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ঋণদানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই ঋণ দেওয়া হবে বাণিজ্য ক্ষেত্রে এবং শিল্প বিকাশে বাজার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে। কীভাবে? সম্পন্নদের জন্য গৃহঋণ, গাড়ি কেনার ঋণ (কার লোন) এবং নানাবিধ ভোগ্যপণ্য কেনাকাটার জন্য ঋণ। ভোগ্যপণ্য শিল্পের অনুকূলে দেওয়া হবে পার্সোনাল লোন বা ব্যক্তিগত ঋণ। এইভাবে ধীরে ধীরে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে সম্পন্ন, উচ্চবিত্ত ও নানা স্তরের উদ্যোগপতিদের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে।
আসলে, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে নানাভাবে বেসরকারি প্রকল্পে এবং টার্গেট বাজারের কাস্টমারকে অর্থের জোগান দিতে এই ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ করা হচ্ছে। নইলে এর প্রয়োজন কতটা ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। সরকারি ব্যাঙ্কগুলি কিছুদিন আগেও অনাদায়ী ঋণ ও পুঁজির স্বল্পতায় যথেষ্ট ধুঁকছিল। তাদের মূলধনের বিপুল অভাব ছিল। বরং তখনই এটা করা অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য ছিল। ইউপিএ-র দ্বিতীয় পর্যায়ে তৎকালীন সরকারও ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের পথে এই একই কারণে হেঁটেছে। অভিজ্ঞতা বলে, তাতে কিন্তু খুব বেশি লাভ হয়নি। তবুও কেন সেই পরীক্ষিত ব্যর্থ পথটি অনুসরণ?
এখন মজার কথা হল, দুর্বল ব্যাঙ্কগুলির প্রায় সকলেই যখন তাদের সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে এককভাবেই চলতে সক্ষম তারা এবং নিজের ঋণদানের ক্ষমতা বিস্তৃত করতে সক্ষম বলে তারা বিবেচিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় বেশ বড় মাপের সরকারি ব্যাঙ্ক তৈরি করার জন্য ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি করার দরকারটা হল কেন? সেটা আমাদের জানা দরকার।
গত বছরের তুলনায় ভারতের অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ কমে গেছে। ঠিক এই সময়েই কয়লা উত্তোলন, ডিজিটাল মিডিয়া ও একক ব্র্যান্ডের খুচরো পণ্যের কেনাবেচায় ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি লগ্নিতে অনুমতি দিয়ে সরকার ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। আরও এরকম নতুন নতুন পদক্ষেপ সফল করতে সংযুক্তির মাধ্যমে সরকারি ব্যাঙ্ককে সক্ষম করে তোলা হল।
এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকার চাইছে বেসরকারি শিল্পোদ্যোগীদের জন্য ব্যাঙ্কের দরজা পুনরায় হাট করে দিতে। আটকে থাকা নানা সরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পে ঋণ দেওয়া এতে সহজ হবে। এইসব উদ্দেশ্যেই বাজেটে রাখা হয়েছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। সেই টাকায় ব্যাঙ্কে পুঁজি জোগানের কথা বলা হয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার পর সে পথ আরও সুগম হল।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল: সংযুক্তিকরণের ফলে কি ব্যাঙ্কের পরিষেবা, প্রোডাক্টিভিটি, লাভ ও হিসেবের স্বচ্ছতা বাড়বে? জুলাই মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন গভর্নর শক্তিকান্ত দাস কিন্তু এটাই চেয়েছিলেন। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উন্নতি ও সংস্কার সাধন নিয়ে ২০১৪ সালে তৈরি কমিটিও একই সুপারিশ করেছিল। এই সংযুক্তির পর কি সেগুলি কার্যকর করা যাবে? ব্যাঙ্কের অর্থ দেশবাসীর উন্নতিতে কাজে লাগাতে কি ব্যবহার করা হচ্ছে? নাকি নতুন কোনোভাবে নতুন নীতিতে ঋণদানের কথা ভাবছে সরকার? তা যদি না-হয়, তাহলে তো আবার কিছু নতুন নীরব মোদি বা বিজয় মালিয়া তৈরি হবে! মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের সরকারি ব্যাঙ্কব্যবস্থাটি। এমন আশঙ্কা বোধহয় অমূলক নয়।
তাই ঘটা করে সংযুক্তি করা হচ্ছে, কিন্তু সংযুক্ত তহবিল থেকে কীসের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়া হবে, তার ব্যাপারে কোনও ঘোষিত মানদণ্ড প্রকাশ্যে না-এলে বিপদের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো মুশকিল হতে পারে বইকি। এই ব্যাপারে কোনও জনকল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত এখনও পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াতে একশো দিনের কাজে মূলধন বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। শহুরে বেকারত্ব কমাতে ‘মুদ্রা লোন’ স্কিমে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ আছে। সেটা নিয়ে আশ্চর্যরকমভাবেই এই সরকার নীরব। শুধু কর্পোরেট লগ্নি বাড়াতে এবং সম্পন্ন ও উচ্চবিত্তের হাতে নগদ জোগান বাড়িয়ে আর্থিক স্টিমুলাস তৈরি করতেই ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের পথ নেওয়া হচ্ছে বলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সুদের হার রাতারাতি কমিয়ে আরও বেশি ঋণ দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে। রপ্তানি বাড়াতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প চাঙ্গা করতে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে এবং আটকে থাকা সরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোকে পুনরায় চালু করতেই ব্যবহার করা হবে সংযুক্ত তাহবিল। আইএলএফএস-এর মতো নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থা গুটিয়ে যাওয়ায় যে বিপুল একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেই জায়গাটা পূরণ করতেও সরকার এবার ব্যবস্থা নিতে পারে।
এতদ্সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে: সংযুক্তিকরণের পর নতুন ব্যাঙ্কের মূলধন অনেক বাড়লেও সেই ব্যাঙ্কটি সঠিকভাবে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে কি? অর্থনীতির প্রয়োজন মিটিয়ে আরও বেশি মুনাফা তৈরি করতে পারবে কি? তার কোনও গ্যারান্টি কোথায়? এর সবথেকে বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)। এটাই ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক। বিরাট তার পরিকাঠামো এবং বল। তবুও ইতিপূর্বে বেশ কিছু সহযোগী ব্যাঙ্ককে তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েও স্টেট ব্যাঙ্ক কিন্তু উপরের প্রত্যাশাগুলি পূরণ করতে পারেনি। হাজার হাজার গ্রামে ও শহর এলাকায় অবস্থান সত্ত্বেও নীতিগত ও প্রযুক্তিগত কারণে এই সাফল্য তার অধরা রয়ে গেছে। আর্থিক প্রোডাক্ট ও নানা স্কিমে সঞ্চয়আকর্ষণ ও ঋণদানে যে-ধরনের মৌলিক উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ দরকার ছিল তার অভাবেই এসবিআই পারেনি। তাই অনেক কম পুঁজি নিয়েও বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কের মূলধন ও ঋণের উৎপাদনশীলতা ও মুনাফার হার অনেক বেশি।
ক্রেতা পরিষেবা বাড়াতে না পারলে কেবলমাত্র ব্যাঙ্কিং সংযুক্তি দিয়ে ব্যাঙ্কের মুনাফা বাড়ে না। সমস্যাটা এখানেই। মূলত যে-সমস্ত সমস্যায় ছোট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ভুগছিল তা হল ক্রমশ মুনাফা করবার ক্ষমতা কমে যাওয়া, লগ্নি থেকে রিটার্ন কমে আসা এবং অনাদায়ের আশঙ্কায় ভোগা সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকা। সংযুক্তির পর যদি এই বিষয়গুলি সঠিকভাবে নজর না-দেওয়া হয় তাহলে আবার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য যেটা করতে হবে সেটা হল রোজ এই সমস্ত ব্যাঙ্কের পারফরম্যান্সের উপরে নজর দেওয়া, নইলে ব্যাঙ্কগুলিকে শুধুমাত্র সংযুক্তি ঘটিয়ে দিলেই তাদের আসল সমস্যা দূর হবে না।
আজকের দুনিয়ায় নিওলিবারেল অর্থনীতিতে ব্যাঙ্কিংকার্যাবলি দু’ভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে। একটি চাহিদা তৈরি করার ক্ষেত্রে, আর-একটি জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে। এই দু’জায়গায় সঠিক ভূমিকা নিয়ে ঋণদান, পুঁজিনির্মাণ, সঞ্চয়গঠন ও ঋণআদায় কার্যক্রমের মধ্যে ভারসাম্য রেখে জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসতে হয় ব্যাঙ্ককে। অর্থনীতির মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রয়োজন না-মেটানো গেলে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ অর্থহীন হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, দুর্বল, ঋণআদায়ে অনুপযুক্ত, অনুৎপাদক সম্পদে (এনপিএ) ভারাক্রান্ত ব্যাঙ্ককে একটি সবল সক্রিয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করে দিলে সাধারণত কোনও লাভ হওয়ার কথা নয়। সক্রিয় ব্যবস্থাটিকে তখন অনেকখানি উৎপাদনশীলতা হারাতে হয় অক্ষম ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য। মাথাভারী ও দুর্বল ব্যাঙ্ক টেনে নিয়ে যাওয়ার পিছনে কোনও অর্থনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে না।
তার থেকে অনেক ভালো হল দুর্বল ব্যাঙ্ক বন্ধ করে দিয়ে তার সকল কর্মী, সম্পদ এবং সম্ভাব্য কুঋণ বাতিল করে ব্যালান্স যা-কিছু আছে সেগুলো সবল ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে দেওয়া। অনেকে মনে করেন, এইভাবে হিসেবের খাতায় দুটি ব্যাঙ্কের মিলিত অস্তিত্বে সরকারি সিলমোহর দিয়ে একনামে চালালেই বোধ হয় ঘটে যাবে সংযুক্তিকরণ। আসলে এই উদ্যোগ তখনই সার্থক হবে যখন দুর্বলকে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে সবল ব্যাঙ্কের ক্ষমতাও আরও বাড়তে থাকে, দুর্বলের নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে। আশা করি, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার কর্মকর্তারা এ বিষয়টি মনে রেখে সংযুক্তিকে সফল করে তোলার চেষ্টা করবেন। আজকের পরিস্থিতিতে উচিত হবে, ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি নর্ম অনুযায়ী প্রতিটি অ্যাঙ্কর ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে অবিলম্বে ক্রেডিট ফ্লো বাড়ানো। এর মানে শুধু ঋণ দেওয়া নয়। অর্থাৎ নতুন ঋণ কীভাবে কতটা আরও প্রোডাক্টিভ হতে পারে তার জন্য নতুন প্যাকেজের কথা ভাবা। উৎপাদন রপ্তানি ও কৃষিক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে ব্যাঙ্কের ঋণ বাড়াতে হবে। তবেই সংযুক্তিকরণ সার্থক হবে।
আসল কথা হল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পরিচালন ব্যবস্থায় গুণমান বাড়াতে হবে। অর্থমন্ত্রীও অবশ্য তার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে শুধু ঋণ দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়, ঋণদানকে ঝুঁকিহীন করে তোলাটাই কিন্তু আসল কাজ। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পুঁজি খাটানোর উদ্দেশ্যকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে তোলা দরকার। তবেই ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হবে। নইলে সংযুক্ত হওয়ার পর আরও বেশি করে নতুন ঋণ দেওয়ার নামে আরও বেশি লুট চলবে।
কীভাবে সংযুক্তিকরণ থেকে সরকার সুফল আদায় করবেন সেটা নির্ভর করবে ব্যাঙ্কের তহবিল পরিচালনার উদ্দেশ্যের উপর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালান তাঁর ‘ফিউচার অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার অর্থনৈতিক ব্যর্থতার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও বিপন্ন করে তোলে (ফিউচার অফ ইন্ডিয়া, পেঙ্গুইন, পৃষ্ঠা ১২)। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রেও এই কথাটি মনে রাখা বিশেষভাবে জরুরি।
সরকার যদি মনে করে, তার ইচ্ছেমতো ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্কের তহবিল ব্যবহার করবে তাহলে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না এবং এদেশটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যে। এই বিষয়টি নিয়ে আর-এক প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সরকারের বিরোধ চরম জায়গায় পৌঁছেছিল। সেই সময় থেকেই এ দেশের ব্যাঙ্কিংব্যবস্থার মধ্যে যে ঘুণ ধরেছে সে-কথা বার বার বোঝাতে চাইছিলেন। নিজের রিপোর্টে রাজন পরিষ্কার লিখেছিলেন, দুষ্টচক্রের পুঁজিবাদ গ্রাস করছে ভারতের অর্থনীতিকে। রাজনৈতিক প্রভাবে বা অন্য সূত্রে প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য কর্পোরেটকে দিয়ে শিল্পায়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ পাইয়ে দেওয়ার যে-বন্দোবস্ত চালু রয়েছে অবিলম্বে তা বন্ধ না-হলে দেশের ব্যাঙ্কিংব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। সমস্ত ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ) বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণ এটাই।
ব্যাঙ্ক-সংযুক্তির উদ্দেশ্য যদি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়ানো হয় (ব্যাঙ্কের এবং জনগণের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা বাদ দিয়ে) তাহলে একথাও বলে রাখা ভালো—এই সংযুক্তিকরণের পরেও সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক এবং সামগ্রিকভাবে ব্যাঙ্কব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া তাই জরুরি। নিজস্ব সম্পদের উপরে ব্যাঙ্কের আয়বৃদ্ধির বিষয়টিও ভাবা দরকার। শক্তিশালী ব্যাঙ্ক হলে তবেই শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। এই সংযুক্তিকরণ থেকে যাতে ব্যাঙ্ক আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে তার জন্য প্রয়োজন ইকনোমিজ অফ স্কেলের সুবিধা নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ কমানো, আয় বাড়ানো, কর্মচারীদের সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং গ্রাহক পরিষেবা বাড়াতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা। এছাড়া ভারতীয় ব্যাঙ্কিংব্যবস্থার পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো বস্তুত অসম্ভব।
শেষে একটি কথা বলা প্রয়োজন। এই সংযুক্তিকরণের ফলে যে-সমস্ত দুর্বল ব্যাঙ্ককে মিশিয়ে দেওয়া হল, তাদের গ্রাহক পরিষেবা ও ব্যাঙ্কের নিজের প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মের মিলকরণ নিয়ে সরকারকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। নইলে অর্থনীতিতে আর-একটি বড় ঝড় আসতে পারে। সেটা হয়তো নোট বাতিল বা তড়িঘড়ি জিএসটি লাগুর মতো ভয়ঙ্কর হবে না, তবুও বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আর্থিক লেনদেন ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তার বহুকৌণিক প্রতিঘাতে দেশের হালফিল অর্থনৈতিক সমস্যাটি হ্রাসের পরিবর্তে বেড়ে যেতে পারে, তীব্রতর হতে পারে আর্থিক বৃদ্ধির হার হ্রাসের প্রবণতাটিও। তাই এই বিষয়ে এখনই যথার্থ পদক্ষেপ জরুরি।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত