শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
কিন্তু, উপায় কী? আমাদের রাজ্যে এমনটাই বহুদিন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুজোর মুখে কিছু না কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন মিছিল অবস্থান এবং তা হটাতে পুলিসি অভিযান ঘিরে উত্তেজনা, ধস্তাধস্তি ইত্যাদি হয়েই থাকে। আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত দেখা গিয়েছে পুজো এলেই পেট্রল ডিজেল কি রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, লরি-বাসের ভাড়া বাড়ানোর দাবি, ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ইত্যাদির মতো ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। তার তালে তাল মিলিয়ে পুজোর এক আধমাস আগে থেকে শুরু হয়ে গেল পরিবহণ ধর্মঘট। তার জেরে হাইওয়েতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বা পচনশীল সব্জিপাতি বোঝাই লরি, তার ছবি উঠে আসতে লাগল কাগজে মিডিয়ায়! শহর মহানগরেও এক দু’দিন বাস-ট্যাক্সি বন্ধ হয়ে গেল! ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখল কাজ! ওদিকে পরিবহণ ধর্মঘটের অছিলায় নিত্যদিনের বাজারে আগুন লাগিয়ে দিল ফড়ে দালালরা, শাক-সব্জি মাছ থেকে যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয়ের দাম রাতারাতি আকাশ ছুঁল! আর পুজোর মুখে দুশ্চিন্তার মেঘ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল গরিব মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া বাঙালির ঘরে ঘরে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর এই ছবিতে খানিকটা বদল এসেছে। এখন আর আগের ওইসব ইস্যুতে আন্দোলন বড় একটা দেখা যায় না। হয়তো ভাড়াটাড়া বা পুজোর আগে অতিরিক্ত প্রাপ্তি নিয়ে পরিবহণ মহলে আর তেমন ক্ষোভ নেই। হয়তো আজও নানান কিছু নিয়ে বিশেষত রাজনৈতিক বিরোধিতার সূত্রে যাঁরা সরকারের উপর ‘ক্ষুব্ধ’ তাঁরা এতটাই সংখ্যালঘু যে তাঁদের আন্দোলন আজ আর জনতামহলে তেমন প্রাসঙ্গিকতা পায় না! পুজোর বাজারও খুব একটা লাগামছাড়া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাছাড়া, সরকারি গাড়িতে সব্জি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি চালু হতে বহু মানুষ ন্যায্য দামে সব পাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে চাপ কিছুটা হলেও কমেছে। পুজো উৎসব ধর্মঘটে সরকারি গাড়ির জিনিসপত্রের দাম তো আর বাড়ে না। তবে, এবারও এই পুজোর মুখে কদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকছে—ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। সন্দেহ নেই, এই ব্যাঙ্ক বন্ধে রাজ্যের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী অনেকেরই অনেক রকমের অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু কী আর করা! রাজ্য সরকার তো এই ধর্মঘট ঠেকাতে পারে না। কারণ, গোটাটা কেন্দ্রীয় সরকার ও ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ব্যাপার।
কিন্তু, তার চেয়েও যেটা নিয়ে আজ এই আসন্ন উৎসবের প্রাক্কালে মানুষ বেশি ভাবিত তা হল রাজ্যের বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি’র সিইএসসি অভিযানকে কেন্দ্র করে গত বুধবার ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটল মধ্য কলকাতায়। সেদিন বিজেপি’র যুব মোর্চার এই আন্দোলন ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি থেকে জলকামান সবই ব্যবহার করতে হল পুলিসকে। বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী কমবেশি জখম হলেন। আবার আন্দোলনের ইটবৃষ্টিতে আহত হলেন জনাকয়েক পুলিসকর্মী অফিসার! এর কয়েকদিন আগে প্রায় একই জায়গায় বিজেপি’র প্রায় একইরকম আন্দোলনে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। তারপর আবার গত শুক্রবার ফের একবার রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়ণ করতে গিয়ে গুরুতর উত্তেজনার সৃষ্টি হল হাওড়ায়! তবে এবার গেরুয়া নয়, লালপার্টি! বাম ছাত্রযুবদের সিঙ্গুর থেকে নবান্ন অভিযানকে কেন্দ্র করে আবার ধুন্ধুমার!
পুলিস অভিযানের গতিরোধ করতেই হাওড়া ময়দান এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নিল! মল্লিক ফটকের কাছে আন্দোলনকারীদের গতিরোধ করতেই প্রবল উত্তেজনা, লাঠি থেকে জলকামান—সবই চলল। আহত হলেন অনেকেই। আহতদের কাউকে কাউকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হল! এবং রাজনৈতিক উত্তাপে উত্তপ্ত হল মল্লিক ফটক ও তার সংশ্লিষ্ট এলাকা। বেশ কিছুক্ষণের জন্য বিপর্যস্ত হল জনজীবন।
এইসব আন্দোলন নিয়ে রাজনৈতিক তরজায় আমরা আপাতত যাচ্ছি না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আন্দোলন করার অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু, কথা হল—রাজনীতির এই আন্দোলন উত্তাপ কি পুজোর আমেজ জমে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র আধিপত্যের এই বাংলায় বিরোধীদের যদি দাগ কাটতে বা ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কি নিদেনপক্ষে রাজনৈতিক অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে হয়—আন্দোলন ভিন্ন গতি নেই এবং সে আন্দোলনে ভালোমতো ঝাঁজ না থাকলেও যে চলবে না—এটা রাজ্যের বিরোধী দলগুলো ভালোমতোই বুঝে গেছে। সুতরাং তাঁদের আন্দোলন প্রতিবাদে কিছু জঙ্গিপনা থাকবে এটা ধরেই নেওয়া যায়। এ সপ্তাহে তেমন আন্দোলন একাধিকবার আমরা দেখলাম। কথা সেটা নিয়ে নয়, কথা হল সময় নিয়ে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ছুঁতে হয়, যদি গণদেবতার মহলে আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব সদিচ্ছা ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে হয় তবে টাইমটা মানে আন্দোলনের সময় নির্ধারণটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাঙালির সবচেয়ে বড় পুজো এবং বছরের সবচেয়ে বড় উৎসবের আয়োজন সময়ে আন্দোলন করলে সাধারণ মানুষ কতটা খুশি হন—তা নিয়ে তাঁদের রীতিমতো সংশয় আছে।
এটা ঠিক যে, পুজোর মুখে আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নামলে হয়তো সহজে অধিক সংখ্যক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, কারণ, বাজার দোকানে কেনাকাটার জন্য অন্য সময়ের চেয়ে পথেঘাটে লোকের সমাগম তখন বেশি থাকে। কিন্তু, মিছিল, মিটিংয়ে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে পথ অচল হয়ে পড়লে ভিড় বাসে গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকলে গণ্ডগোলের জন্য দোকান-বাজার হঠাৎ বন্ধ হয়ে উৎসবের আমেজের তাল কাটলে আম পাবলিক যে তা খুব প্রসন্ন মনে নেন না, তা বলাই বাহুল্য। সেক্ষেত্রে ইস্যুর বাস্তব গুরুত্ব যতই থাক তা নিয়ে আন্দোলন করে পুজোর মুখে পাবলিকের মন কতটা ছোঁয়া যায় তা নিয়েও যথেষ্ট ধন্দ আছে। বিশেষ করে যখন মানুষ চারপাশের হরেক সমস্যা নিয়ে দিনরাত এমনিতেই জেরবার, পুজোর কটা দিন একটু হাঁপ ছাড়তে উদ্গ্রীব এবং তার জন্য একটু আনন্দফুর্তি খানাপিনা বেড়ানো ইত্যাদির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তখন রাজনৈতিক আন্দোলন ঘিরে ঝামেলা যদি তাঁদের বোঝার ওপর শাকের আঁটি মনে হয় তবে সেটা নিশ্চয়ই খুব ভালো বার্তা বয়ে আনবে না—তাই না?
কিন্তু, মানুষের এই অসুবিধের দিকটা রাজনৈতিক শিবিরে কোনওকালেই বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। আজও যে তেমন পাচ্ছে না সেটা কলকাতা-হাওড়ার সাম্প্রতিক আন্দোলনের ছবিগুলোই বলে দিচ্ছে। আমরা একবারও বলছি না যে আন্দোলন অসঙ্গত। রাজনৈতিক দল তাদের নীতিবিচার মতো প্রতিবাদ আন্দোলন করবেই। এনআরসি’র প্রতিবাদে বা কিছুদিন আগে পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে ও জল অপচয় রোধ করতে তো স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পথে নেমেছিলেন। কিন্তু, তাতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি পাবলিকের। এনআরসিতে সিঁথি থেকে শ্যামবাজার বা পরিবেশ মিছিলে দক্ষিণ কলকাতায় কিছুক্ষণ যান-নিয়ন্ত্রণে মানুষের হয়তো সামান্য দেরি হয়েছে গন্তব্যে যেতে, তবে তাঁদের মনে আর যাইহোক ভয়, শঙ্কা জাগেনি। কিন্তু, বিরোধী আন্দোলন মানেই যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মুখোমুখি—শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। পুজোর বাজার উৎসবের আমেজের পক্ষে যা কেবল বেমানানই নয়, একপ্রকার বিঘ্ন স্বরূপ—এ আমাদের কথা নয়, বলছেন পথচলতি মানুষ। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।
এদিকে আর এক শনিবার পেরলেই মহালয়া—দেবীপক্ষের সূচনা। বাতাসে এর মধ্যেই হালকা হিমেল টান লেগেছে। শহর মহানগর থেকে গ্রামগ্রামান্ত প্যান্ডেল আলোসাজে দেবী বরণের মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে। কুমোরটুলি সমেত গোটা রাজ্যের পটুয়া পাড়াগুলোতে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। মধ্যে মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই, তবে তার মাঝেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে শরতের টুকরো টুকরো সাদা মেঘের নীল আকাশ। মানুষের মুখে-চোখেও ঝিলিক দিচ্ছে মা দুর্গার মহাপুজোর আনন্দ আবেশ। এমন উৎসবের আমেজে কি আন্দোলন ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট রক্তপাত মানায়—আপনারাই বলুন।