এই উপমহাদেশে জাতি হিসেবে বাঙালি নিজেকে বিশিষ্ট বলে দাবি করে থাকে। মনীষী গোপালকৃষ্ণ গোখলের উক্তির প্রতিধ্বনি আমাদের অনেকের কথায়—‘‘বাঙালি আজ যা ভাবে ভারত ভাবে তা কাল।’’ অর্থাৎ আমরা বোঝাতে চাই—চিন্তা চেতনার জগতে বাঙালিই হল সবচেয়ে অগ্রণী। বহুকাল যাবৎ বাংলাই সারা ভারতকে পথ দেখিয়ে চলেছে। এই আত্মশ্লাঘা একেবারে অবান্তর বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ ধর্ম, দর্শন থেকে বিজ্ঞান, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা, রাজনীতি, সাহসী অভিযান, এমনকী ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ক্ষেত্রেও বাঙালি বার বার তার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রেখেছে। মনীষা, প্রতিভার বিকাশে বঙ্গদেশ বাস্তবিকই এক আশ্চর্য মাটি। তবে, বাংলার এই ঈর্ষণীয় শ্রীবৃদ্ধি কিন্তু কোনও গাছের ফল নয়। এর পিছনে রয়েছে কয়েকজন প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের অপরিমেয় অবদান। রাজা রামমোহন রায় নিঃসন্দেহে এই উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক মানুষ। ভারতবর্ষ বরাবর বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী। তবু, এই দেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী দুঃখ দুর্দশা। এর রহস্য যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন রামমোহন—ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা, ব্যর্থতা। প্রথম আলোকপ্রাপ্ত মানুষটি এই গোড়ার গলদ দূর করার জন্য ধর্মীয়-সামাজিক ক্ষেত্রের সংস্কারে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ করেছিলেন। মানবাধিকার, রাজনীতি, জনপ্রশাসন এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদানের কথা চিরস্মরণীয়।
রামমোহনের ৪৮ বছর পর, ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে এই বঙ্গদেশে জন্ম নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যেন যুগের প্রয়োজনেই আর-এক যুগপুরুষের আসা। অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে রামমোহন একা মশাল হাতে যে পথ দেখালেন, সেই পথে জাতিকে আরও অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুভার নীরবে কাঁধে নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগরই বাংলা লিপির সংস্কার করে সেটিকে যুক্তিবহ এবং সকলের পক্ষে গ্রহণের উপযোগী করে তোলেন। বাংলা গদ্য সাবালক হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। জাতির হয়ে বিদ্যাসাগরের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিদ্যাসাগরকেই তিনি ‘বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী’র স্বীকৃতি দিয়ে গিয়েছেন। সামান্য অক্ষরজ্ঞান বা হাতেখড়ি থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্য জগতে আমাদের সার্থক উত্তরণ—বিদ্যাসাগরকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। রামমোহন যে মাটি তৈরি করেছিলেন সেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক আবাদ বলতে যা বোঝায় সেটাই করেছিলেন বিদ্যাসাগর। ওই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর আবির্ভাব নাহলে রামমোহনের প্রয়াণের অল্পকাল মধ্যেই এদেশ যথাপূর্ব অন্ধকারে ফিরে যেতে পারত। বিদ্যাসাগর একটি বিরাট সর্বনাশের হাত থেকে বাঙালিকে জাতিকে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর আবাদের সুমিষ্ট শস্য ফলপাকড়েই আমরা এখনও হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছি। আমাদের বার বার স্মরণ করা দরকার, এই কাজগুলির কোনোটিই সহজভাবে করার সুযোগ তিনি পাননি। সবচেয়ে বেশি বাধা পেয়েছিলেন নারীশিক্ষার প্রসারে এবং বিধবাবিবাহের প্রবর্তন করতে নেমে। দেশ পরাধীন ছিল বটে, সবচেয়ে বেশি বাধা পেয়েছিলেন দেশের মানুষের কাছ থেকে। শেষমেশ সব কাজেই সফল হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কিন্তু কোন জাদুতে? নবজাগরণের এই পুরোধা-পুরুষ সম্পর্কে কবি মধুসূদন দত্ত যে মূল্যায়ন করেছেন, তার মধ্যেই নিহিত এর উত্তর। বিদ্যাসাগরের মধ্যে সমসাময়িক মধুকবি দেখেছিলেন—প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।
বিদ্যাসাগর নামটি বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। এবছর তাঁর জন্মের দুশো বছর। রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঙালির ঋণ বিরাট আর রবীন্দ্রনাথের বিরাট ঋণ বিদ্যাসাগরের কাছে। আমাদের নিত্য যাপনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ঋণস্বীকার থাকে। এটাই স্বাভাবিক এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু, আমরা শুধুই যেন পর্বত শিখরের বন্দনা করে চলেছি আর বিদ্যাসাগর কেমন যেন পর্বতের নীচের নুড়ির মতো এক বিস্মৃতপ্রায় চরিত্র হয়ে উঠছেন! এই সংস্কৃতি কাম্য নয়। তাই এই পুণ্যমুহূর্তে রাজ্য সরকার একক উদ্যোগে বাংলাজুড়ে বিদ্যাসাগরস্মরণের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা এককথায় মহতী। রাজ্যে সর্বমোট ৮৩ হাজারের বেশি স্কুল রয়েছে। দ্বিশতবর্ষ উদযাপনে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে স্কুলগুলির উপর। এজন্য ২০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। দেশে বিদেশে যেখানে যত বাঙালি আছেন তাঁদের সকলেরই উচিত বিদ্যাসাগরকে যথাযথভাবে স্মরণ করা।