উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫১-১৯৫২ সালে। ওই নির্বাচনে মানুষ ব্যালট পেপারে সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচনে তাঁদের মতামত জানিয়েছিলেন। নির্বাচন পরিচালনার অনভিজ্ঞতার কারণে সেবার ভোট গণনা তিনদিন পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের আগে পর্যন্ত ব্যালট পেপারের মাধ্যমেই ভোটগ্রহণ হয়েছে। ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার পর ভোট গণনা ছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে প্রথম নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে দ্রুত ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে একদিকে ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল, অন্যদিকে ভোটদানের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সংখ্যক ব্যালট পেপার গণনা করে ফল প্রকাশ করা নির্বাচন কমিশনের কাছে আক্ষরিক অর্থেই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল।
১৯৫২-এর নির্বাচনে যেখানে মাত্র ১৭ কোটি ভোটার ছিলেন সেখানে এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৯০ কোটি। প্রথম নির্বাচনে যেখানে কেবল ৪৪.৮৭ শতাংশ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন সেখানে এবারে ভোটদানের হার গড়ে ৬৪ শতাংশের মতো। ৮০-র দশকের পর ভোটার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যালট পেপার গণনাকে কেন্দ্র করে বিস্তর সমস্যা উঠে এসেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল—
(ক) প্রার্থীর প্রতীকে সঠিক স্থানে ছাপ না পড়াকে কেন্দ্র করে বিতর্ক, (খ) ব্যালট পেপার নষ্ট করে দেওয়া বিশেষ করে ছিঁড়ে দেওয়া, জল দিয়ে নষ্ট করার মতো অভিযোগ, (গ) প্রার্থী পিছু যে ব্যালট পেপারের বান্ডিল গণনা কেন্দ্রে বাঁধা হতো, তাতে জালিয়াতি করার মতো অভিযোগ উঠত। পাশাপাশি একটি লোকসভা নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল জানতে দু’দিন থেকে তিনদিন সময় পর্যন্ত লেগে যেত। এই দীর্ঘ গণনা প্রক্রিয়ায় ভোট কর্মীরা যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তেমনি ভোটপ্রার্থী ও তাঁর এজেন্টরাও এক সময় ক্লান্ত হয়ে বহু ক্ষেত্রেই গণনা থেকে উঠে আসতে বাধ্য হতেন, নতুবা প্রার্থীর এজেন্টদের ক্লান্তির সুযোগ নিয়ে ভোটের ফলকে প্রভাবিত করার ঘটনা বারবার লক্ষ করা গেছে। দু-তিনদিন ধরে ব্যালট পেপার গণনা পর্বে গণনা কেন্দ্রেই ব্যালট পেপার ছিনতাই থেকে শুরু করে ব্যালট পেপার নষ্ট করবার ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মুখে শোনা যেত। গণনা কেন্দ্রে নিরাপত্তা বিধান করাও ছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ গণনা পর্বে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর প্রভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকত, উঠত পরাজিত প্রার্থী এবং তাঁর এজেন্টদের উপর হামলা, ভয় দেখানোর মতো অভিযোগ।
১৯৫২-১৯৮৯ পর্যন্ত ব্যালট পেপার গণনা পর্বে মানুষ মূলত রেডিও সংবাদের মাধ্যমে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ফল জানত। ১৯৭৭ সাল থেকে কলকাতা দূরদর্শন ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্বাচনী সংবাদ পরিবেশন শুরু করে। সেই সময় ইডেনের ক্রিকেট খেলায় যেভাবে কাঠের বোর্ড ব্যবহার করে স্কোর দর্শকদের জানানো হতো, তেমনি দূরদর্শনের বোর্ডের নম্বর পরিবর্তন করে বিভিন্ন দলের ফলাফল দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হতো।
টি এন সেশন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর একের পর এক নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন। সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে তিনি ব্যালট পেপারের পরিবর্তে ১৯৯৯ সালে ইভিএম মেশিন অন্তর্ভুক্ত করেন। ইভিএম মেশিন অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে চলে আসা ব্যালট পেপার গণনার ক্লান্তিকর কর্মযজ্ঞের পরিসমাপ্তি ঘটে। ভোট গণনায় শুরু হয় নতুন এক যুগের। এক একটি লোকসভা বা বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নাগরিকদের জানানো সম্ভব হয় ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়। তবে সেই সঙ্গে বুথ ভিত্তিক ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দরুন নতুন করে সমস্যাও উঠে আসে। কোন দল কোন বুথে হেরেছে বা জিতেছে তার উপর ভিত্তি করে নতুন করে তৈরি হয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা জাতিগত দ্বন্দ্ব। ১৯৮৯ সালের নির্বাচন থেকে সারা দেশে ভোটগণনাকে লাইভ টেলিভিশন সম্প্রসারণ করে দূরদর্শন। ওই পর্যায়ে ব্যালট পেপারের মাধ্যমেই ভোট হয়েছিল এবং ব্যালট পেপার মিশ্রিত করে গণনা প্রক্রিয়া চলে। ফলে গণনার সময় আরও বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় তিন দিন ধরে দূরদর্শনের লাইভ সম্প্রসারণের মাঝে দর্শকদের মনোরঞ্জন-এর জন্য সিনেমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এ প্রজন্মের ভোটাররা অবগত না হলেও পঞ্চাশোর্ধ্ব সমস্ত ভোটারদের কাছে ১৯৮৯ সালের দীর্ঘ গণনাপর্বে দূরদর্শনে লাইভ সম্প্রসারণ এবং সিনেমা দেখার স্মৃতি অটুট হয়ে রয়েছে।
ইভিএম চলে আসার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএম নিয়ে সন্তুষ্টই ছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় ইভিএম মেশিনকে নিয়ে সন্দেহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে ইভিএম মেশিনকে বিকৃত করে ভোটের ফল প্রভাবিত করার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। কোনও কোনও দল দাবি জানাতে শুরু করে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণের পরিবর্তে পুরনো ব্যালট পেপার ফেরত আনতে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর অধিকাংশ অ-বিজেপি দলগুলি দাবি তোলে ইভিএম-এর পরিবর্তে ব্যালট পেপার দিয়ে ভোট করানোর বিষয়ে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন পুরনো ব্যালট পেপারে ফিরে যেতে নারাজ। এই অবস্থায় সমাধান সূত্র হিসেবে ইভিএম-এর সঙ্গে ভিভিপ্যাট যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভিভিপ্যাট যুক্ত হওয়ায় ভোটার যাকে ভোট দিয়েছেন, সেখানে ভোট পড়েছে কি না ভোটার সরাসরি তা চাক্ষুষ করতে পারেন। ভিভিপ্যাটে যে পাত্র থাকে ভোটদানের পর প্রদত্ত ভোটের একটি ছোট্ট স্লিপ সেখানে জমা হয়। বিরোধীদের দাবি ছিল ভিভিপ্যাটের সমস্ত স্লিপ ইভিএমের পাশাপাশি গণনা করে দেখতে হবে। এই দাবিতে প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট এবং পরবর্তী পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট লোকসভার অন্তর্গত প্রতিটি বিধানসভায় অন্তত পাঁচটি ভিভিপ্যাট নমুনা হিসাবে গণনা করে ভোটের ফলের সঙ্গে যাচাই করে দেখবার কথা বলেছিল। আর তার ফলেই তৈরি হয়েছে এবারের নির্বাচনে গণনাকে কেন্দ্র করে নতুন চ্যালেঞ্জ। ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি ভিভিপ্যাটের স্লিপ গণনাকে কেন্দ্র করে উঠে আসতে পারে নানা বিতর্ক।
বিগত দুই দশক যেমন করে ভোটের ফল গণনার মধ্য বেলাতে আমরা পেয়ে অভ্যস্ত ছিলাম এবার কিন্তু সরকারিভাবে চূড়ান্ত ভোটের ফল জানতে কোথাও মধ্যরাত কোথাও বা পরের দিন চলে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। সকাল ৮টায় গণনার শুরুতেই পোস্টাল ব্যালট দিয়ে গণনা শুরু হয়। পোস্টাল ব্যালট এর মধ্যে আবার সার্ভিস ব্যালট পেপারে যাঁরা ভোট দেন তাঁদের ব্যালটের বৈধতা বিচার করে গণনা করা সময়-সাধ্য কাজ। মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত ভোটাররা সার্ভিস ব্যালট পেপারে ভোট দেন। ভোটার তালিকায় নাম সংশোধন পর্বেই কর্মরত ব্যক্তিকে জানিয়ে দিতে হয় তিনি সার্ভিস ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটদান করবেন। সেই অনুযায়ী তিনি যে এলাকায় কর্মরত সেই ইউনিট অফিসে অন লাইন-এ ব্যালট পেপার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যা নিজস্ব পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে খুলতে হয়। কমিশনের পাঠানো QR Code খামে যুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের নির্বাচন আধিকারিকের কাছে পাঠানো হয়। সঙ্গে ডিক্লারেশন ফর্ম ১৩ (ক) পাঠানো বাধ্যতামূলক। গণনা পর্বে QR Code যাচাই করে ব্যালট পেপার বৈধ ঘোষণা করে গণনা করতে যথেষ্ট সময় লাগার কথা। পাশাপাশি ভোটে কর্মরত ভোট কর্মীদের ব্যালট পেপার গণনাও চলবে। এই পর্বের কাজ শুরু হবার পর ইভিএম গণনা পর্ব আরম্ভ হওয়ার কথা। লোকসভার অন্তর্গত প্রতিটি বিধানসভার জন্য ন্যূনতম ১৪টি টেবিলে গণনা হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ কোনও বিধানসভায় ২৮০টি বুথ থাকলে ২০ রাউন্ড-এ ইভিএম মেশিনের ভোট গণনা সম্পূর্ণ হওয়ার কথা।
এরপরেই শুরু হবে নির্বাচন কমিশনের নতুন চ্যালেঞ্জ ভিভিপ্যাটের গণনা। ভিভিপ্যাটের নমুনা চয়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন ওই কেন্দ্রের নির্বাচন আধিকারিক। বিধানসভা পিছু পাঁচটি ভিভিপ্যাট এক সঙ্গে গণনা হবে না। একটির পর আরেকটি ভিভিপ্যাটের গণনার জন্য চূড়ান্ত ফল প্রকাশে এবার অতিরিক্ত সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মহল। ভিভিপ্যাট গণনার জন্য আলাদা কাউন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। স্লিপগুলো যাতে স্পষ্ট করে দেখা যায় তার জন্য স্বচ্ছ ধারক রাখা হবে এবং ভিভিপ্যাট গণনার কাউন্টারটি বাইরে থেকে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা যাতে প্রত্যক্ষ করতে পারে সেই সুযোগও থাকছে। কিন্তু একটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, ইভিএমের কাউন্টিং শেষ হতেই জানা যাবে (অন্তত আন অফিসিয়ালি) কোন প্রার্থী জয়ী হলেন বা কোন প্রার্থী হারলেন। এই অবস্থাতে ইভিএম গণনার পর দীর্ঘ সময় ধরে ভিভিপ্যাটে স্লিপ গণনাতে কিছু কিছু বিষয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। যেমন—
(ক) ভিভিপ্যাটের স্লিপ এতই ছোট মুখে পুরে দিয়ে নষ্ট করে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না,
(খ) ইভিএম-এ পরাজিত প্রার্থীর তরফ থেকে ভিভিপ্যাট গণনার সময় অতিরিক্ত বাধাদান-এর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে আমাদের মতো তীব্র রাজনৈতিক লড়াই-এর রাজ্যে তো নয়ই, (গ) সংশ্লিষ্ট বুথের ইভিএম-এ প্রাপ্ত ভোট এবং নমুনা ভিভিপ্যাটের প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে যদি সামান্যতম পার্থক্যও দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে গণনা প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। তবে ভিভিপ্যাটের গণনায় পাওয়া ফলাফল কেবলমাত্র ওই সংশ্লিষ্ট বুথের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে ধরা হবে। এবং ভিভিপ্যাটের গণনা থেকে পাওয়া তথ্যই চূড়ান্ত ফল বলে ওই সংশ্লিষ্ট বুথের ক্ষেত্রে গণ্য হবে। অর্থাৎ ভিভিপ্যাটের গণনায় অসঙ্গতি ধরা পড়লেও সমগ্র ফলাফলের উপর কিন্তু কোনও প্রভাব পড়বে না।
নির্বাচন কমিশনের কাছে ভিভিপ্যাট গণনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পরবর্তী পর্যায়ে বিরোধীদের দাবি মতো যদি পঞ্চাশ শতাংশ বুথে ভিভিপ্যাট গণনার দাবি মেনে নেওয়া হয়, তবে আমাদের পুরানো ব্যালট পেপার গণনার যুগেই ফিরে যেতে হবে।
লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক