উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
মোদি সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ অন্তে তার ত্রুটি-বিচ্যুতির ভিত্তিতে আমরা একটি লম্বা ‘চার্জশিট’ তৈরি করে ফেলতে পারি। আমার মতে, ওই তালিকার শীর্ষে থাকবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি। অব্যবস্থার কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: (১)ম্যাক্রো-ইকনমিক্স সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞতা এবং যেটা জানা নেই তা শিখে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অনীহা; (২) সরকারের পলিসি পরিবর্তনে ব্যবসা-বাণিজ্য, লগ্নিকারী এবং উপভোক্তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেই বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর অক্ষমতা; এবং (৩) অর্থনীতিবিদদের প্রতি সরকারের অবজ্ঞা এবং আমলাদের উপর মাত্রাতিরিক্ত আস্থা।
একটি অন্যরকম খেলা
ভারতশাসন করা আর একটি রাজ্য সরকার পরিচালনা করা একেবারে অন্যরকম একটি ব্যাপার। একজন মুখ্যমন্ত্রীকে মুদ্রার বিনিময় হার, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি, মানিটারি পলিসি অথবা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্কের পরিবর্তন (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ও শুল্ক যুদ্ধ অথবা ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা) নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় না। একজন মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতার সঙ্গে তাঁর রাজ্যের অর্থনৈতিক দিকগুলি সামলে নিতে পারেন যদি রাজ্যের রাজস্ব আদায়টা ঠিকমতো হয়, খরচের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ রাখেন, কেন্দ্রের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনুদান পেয়ে যান এবং ভালোমতন বেসরকারি লগ্নি আকর্ষণ করতে পারেন। মজবুত গণভিত্তি আছে এইরকম অনেক মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা না-থাকা সত্ত্বেও প্রশংসিত হয়েছেন, রাজ্যের অর্থনীতিটা চাঙ্গা রেখে দেওয়ার কারণে।
ভারতের অর্থনীতি সামলে দেওয়াটা হল একেবারে অন্যরকম একটি খেলা। সফল মুখ্যমন্ত্রীরাও অর্থমন্ত্রী পদে গিয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা’ হয়েছেন। অন্যদিকে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়াই ড. মনমোহন সিং একজন অতুলনীয় অর্থমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁর ছিল ম্যাক্রো-ইকনমিক্সে পণ্ডিত্য এবং প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিরন্তর হৃদ্য যোগাযোগ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই যে উদারিকরণ অথবা যেসব আর্থিক সংস্কার সম্ভব হয়েছে এ-দেশে, ড. মনমোহন সিং ছাড়া এসব সম্ভব ছিল না।
ভুলের পর ভুল
অর্থনীতির মতো একটা বিরাট জিনিস সামলাবার ভারটা অনভিজ্ঞ এবং স্বৈরাচারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে তার ফল মিলতেও দেরি হয় না। ডিমনিটাইজেশন বা বিমুদ্রাকরণ হল এই ঘটনার একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ। সামান্য আন্ডার গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী কোনও অর্থনীতিবিদও একজন প্রধানমন্ত্রীকে দেশের চালু মুদ্রার ৮৬ শতাংশকেই ‘বেআইনি নোট’ ঘোষণা করে দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন না, তবু এটাই হয়েছে এই আমলে।
যেহেতু অরুণ জেটলি প্রকাশ্যে কোনোদিন এই ঘটনার দায় স্বীকার করেননি, তাই সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়ের পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর উপর বর্তায়। কৃতিত্বের সঙ্গেই এই ঘটনার দায়িত্ব মোদিজি স্বীকার করেছেন, কিন্তু তিনি মানেননি যে ডিমনিটাইজেশন অর্থনীতিকে বেলাইন করে দিয়েছে, ছোট ও মাঝারি (এমএসএমই) শিল্প ধ্বংস করেছে, চাকরি খেয়েছে এবং কৃষিক্ষেত্রের সঙ্কটটাকে তীব্রতর করেছে।
বিমুদ্রাকরণের অনুসরণে আরও অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক চরিত্রকে গুরুত্ব না-দিয়ে বাজেট রচনা করা হয়েছে; জিএসটি নির্ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত অদক্ষতার সঙ্গে এবং তারপর এটার রূপায়ণ ঘটেছে তড়িঘড়ি; অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) বিষয়টি আনাড়ির মতো সালটানো হয়েছে; রাজস্ব সংগ্রহের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে সেটা পূরণ করার জন্য যা করা হয়েছে তা তো বেআইনি ব্যাপার এবং স্বৈরশক্তির প্রয়োগ মাত্র; এবং পরিকাঠামোগত অর্থনৈতিক সমস্যায় সমানে আমলাতান্ত্রিক জোড়াতাপ্পির সমাধান সন্ধান করা হয়েছে।
খারিজ রিপোর্ট কার্ড
অর্থমন্ত্রকের অধীন ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট পাঁচটি অর্থবর্ষ শেষে একটি রিপোর্ট কার্ড প্রস্তুত করেছে। সহায়ক হিসেবে, ২০১৬-১৭ সালে যে বিমুদ্রাকরণ করা হল তার পরবর্তী বছরগুলির তথ্য ওই রিপোর্টে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হল। ওই রিপোর্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হেডলাইনগুলি নিম্নরূপ:
(এক) অর্থবর্ষ ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯-এর প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধি নেমে গিয়েছে ৮.২ শতাংশ থেকে ৭.২ শতাংশে, সেখান থেকে ৭.০ শতাংশে। তার মানে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৬.৫ শতাংশে।
(দুই) মোট আর্থিক ঘাটতি (গ্রস ফিনান্সিয়াল ডেফিসিট) ছিল জিডিপির ৩.৫, ৩.৫ এবং ৩.৪ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালের সংখ্যাটি ওইরকম হওয়ার কারণ হিসেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে কর আদায়ের হার সংশোধিত হিসেবের (রিভাইজড এস্টিমেট) থেকে ১১ শতাংশ কম হয়েছিল।
(তিন) মূলধনী ব্যয় থমকে ছিল: ২০১৮-১৯ সালের জিডিপির ১.৭ শতাংশ, এটাই ছিল ২০১৫-১৬ সালে।
(চার) জিডিপি ডিফ্লেটর, যেটা কিনা ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির দ্যোতক, সেটা ৩.১ শতাংশ থেকে ৪.২ শতাংশে চড়ে গিয়েছিল।
(পাঁচ) কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতির (সিএডি) পরিমাণটা জিডিপির .৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ১.৯ শতাংশ, সেখান থেকে ২.৬ শতাংশ।
(ছয়) বেসরকারি উপভোগ ব্যয় এবং সরকারি উপভোগ ব্যয় দুটিই থমকে গিয়েছিল।
(সাত) স্থায়ী বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮.২ শতাংশ থেকে ২৮.৯ শতাংশের মধ্যে থমকে ছিল—যেটা ২০১১-১২ অর্থবর্ষে অর্জিত ৩৪.৩ শতাংশের অনেক নীচে।
(আট) কৃষিক্ষেত্রে দুর্দশার ছবিটা প্রতিফলিত হয়েছে জিভিএ (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড) বৃদ্ধির হারের স্পষ্ট হ্রাসের ভেতর—৬.৩ থেকে ৫.০, তার থেকে ২.৭ শতাংশ।
(নয়) শিল্পক্ষেত্রে জিভিএ বৃদ্ধি নিশ্চল; পরিষেবা ক্ষেত্রে জিভিএ বৃদ্ধির হার নিম্নগামী—৮.৪ থেকে ৮.১, তার থেকে ৭.৪ শতাংশ।
(দশ) ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে পোর্টফোলিয়ো ইনভেস্টমেন্টের নিট ফ্লো ছিল নেতিবাচক।
বিজেপির দম্ভ ঘুচে গিয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে আমাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাটাই ফলে গেল! উপরন্তু, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিসের (সিএসও—যেটাকে ইতিমধ্যেই অনেক অর্থনীতিবিদ সন্দেহের চোখে দেখছেন) পক্ষ থেকে যে বৃদ্ধির হার ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস (এনএসএসও) ইতিমধ্যেই গত ৪৫ বছরের ভিতরে সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের রিপোর্ট দিয়েছে। তারাই ফাঁস করে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের যে এমসিএ-২১ ডেটা বেস সিএসও ব্যবহার করেছে তাতে বিরাট গলদ ছিল। এটা প্রতিপন্ন হল যে এমসিএ-২১ ডেটা বেসের অন্তর্ভুক্ত ৩৬ শতাংশ কোম্পানি নিষ্ক্রিয় অথবা সেগুলির কোনও হদিশই নেই!
অনেক বছর ভারতীয় অর্থনীতি এতটা দুর্বল হয়নি। সুতরাং, মোদিজি অর্থনীতিকে এড়িয়েই আখ্যান ফাঁদার চেষ্টায় আছেন। পরবর্তী দফার ভোটাদের সামনে এটাই বড় সাবধানবাণী।