উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
কিন্তু তাতে কী? ভোট বলে কথা, তায় রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ। রোদ গরমের সাধ্য কি এখানে ভোটের লড়াইতে বাদ সাধে! ঝরুক ঘাম, ঘুরুক মাথা, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাক, রোদের ঝলসানিতে ধাঁধিয়ে যাক চোখ—ভোটের লড়াই চলছে, চলবে। দেখতে দেখতে সাত দফা লড়াইয়ের পাঁচ দফা তো শেষ। আজ ষষ্ঠ দফা। রাজ্যের আরও কয়েকটি লোকসভা কেন্দ্রের ভাগ্য ঠিক হয়ে যাবে আজ। বাকি থাকবে কলকাতা সহ আর কয়েকটি আগামী রবিবারের জন্য—সেদিনই শেষ দফা। আর ঠিক তার তিন দিন পর ২৩ মে জানা যাবে আগামী পাঁচ বছর দিল্লি কার, কে চালাবেন দেশ। দেশের আমজনতা বেছে নিলেন কাকে—বিদায়ী শাসক মোদিজিকে, না কি বিরোধী শিবিরের কাউকে? ভোটের লড়াই যত শেষের দিকে আসছে এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর নিয়ে গণকৌতূহল তত বাড়ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কী, এই কৌতূহল যে কেবল দেশ-জনতাকেই মজিয়েছে এমন নয়, দেশ রাজনীতির অন্দর-বাহির থেকে রাজনৈতিক আলোচক, বিশ্লেষক সকলকেই আচ্ছন্ন করেছে। মোদিজি না রাহুল, রাহুল না মমতা—কে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তা নিয়ে জল্পনা যথেষ্টই জমে উঠেছে। তার কারণ দেশ জুড়ে এবারের ভোটফল নিয়ে অঙ্কের যত ছড়াছড়িই হোক এখনও নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ শেষ অবধি কটা সিট পাবে। একটা কথা অবশ্য মোটের ওপর সকলেই বলছেন, এবার মোদিজির দল গতবারের চেয়ে বেশ কিছু আসন কম পাবে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশার মতো রাজ্যগুলির সঙ্গে দক্ষিণেও তাঁর দল প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না—সম্ভাবনা নাকি এমনই। এই ঘাটতি মেটাতেই নাকি এবার পূর্ব ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে গেরুয়া শিবির। তার জন্যই নাকি পশ্চিমবঙ্গে নজিরবিহীন সংখ্যায় সভা করলেন প্রধানমন্ত্রী! অবশ্য তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ রাজ্যে জনমন কতটা ভিজবে, ভোটবাক্সে তাঁরা পদ্মদলকে কতটা সমর্থন জানাবে—তা নিয়ে সংশয় ফুরোচ্ছে না।
তবে, এক্ষেত্রেও সর্বস্তরেই একটা মত কমন—এবার বঙ্গে বিজেপি বাড়ছে। ২০১৪ সালে পাওয়া মাত্র দুটি আসন এবার চার ছটা বেড়ে গেলে আশ্চর্যের কিছু নেই। জনতা বলছে, বিশেষজ্ঞদের অনেকেও বলছেন এই সম্ভাবনার কথা। তবে, এই চলতি মতও শেষ বিচারে গ্রহণযোগ্য হবে কতটা তা নিয়েও ধন্দ আছে বহুজনার। মোজিদি যেভাবে সভায় সভায় জনতার নয়নের মণি মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে লক্ষ্য করে কড়া কড়া কথা বলছেন, কোলমাফিয়া, সিন্ডিকেট, নারদা-সারদা ইত্যাদি নিয়ে তোপ দাগছেন—তাতে তাঁর সভায় উপস্থিত জনতাই কতটা খুশি হচ্ছেন তা নিয়েও তথ্যভিজ্ঞদের অনেকের সন্দেহ আছে। কেননা, যাঁদের সামনে প্রধানমন্ত্রী এসব বলছেন তাঁরা পদ্মপার্টির সমর্থক হতে পারেন, সভাতেও যেতে পারেন কিন্তু তাঁরাও গত কয়েক বছর ধরে এ রাজ্যের ব্যাপক উন্নয়নের স্বাদ পেয়েছেন, উন্নয়নের সুবাদে জীবনযাত্রায় আধুনিক পৃথিবীর সুযোগ সুবিধার স্পর্শ পেয়েছেন—এবং এই অভাবনীয় উন্নয়নের কারিগর যে তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর একক ঐকান্তিক প্রয়াসেই যে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সিপিএমের ফেলে যাওয়া রুগ্ন মৃতপ্রায় শিল্পহীন বাংলা আজ আলোয় উজ্জীবিত বিশ্ববাংলায় পরিণত হয়েছে, বিশ্বের দরবারে সেরার শিরোপা পাওয়া উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে, শিল্পে বিনিয়োগে কর্মসংস্থানে শান্তি-সংহতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে—তাও জেনেছেন। এমন পরিস্থিতিতে এহেন মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ক্রমাগত কটু কথার রাজনীতি কতটা তাঁরা গ্রহণ করবেন, কতটা তাতে প্রভাবিত হবেন—তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে বইকি।
সত্যি বলতে কী, দেশের সামগ্রিক সম্ভাব্য ভোটফলের সঙ্গে বাংলার তফাৎটা হয়ে যাচ্ছে এখানেই। দিল্লির মসনদে মোদিজি ফিরছেন কি ফিরছেন না তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে দ্বিধা সংশয়ের কোনও প্রশ্নই উঠছে না! বরং, মমতার দাবি মতো ৪২-এ ৪২ হয়ে যেতেও পারে—এমন একটা বিশ্বাস বাতাসে ইতস্তত ঘুরছে। সে হোক বা না হোক শেষ লোকসভায় মমতার তৃণমূলের পাওয়া ৩৪ আসনে যে হাত পড়ছে না বরং তাতে নতুন করে দু-একটা যোগ হতে পারে এমনই মত দিচ্ছেন অনেক বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, কংগ্রেস, সিপিএমের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতায় ভাটা এবং মা-মাটি-মানুষের প্রতি মমতার ঐকান্তিক দায়বদ্ধতা এবং নজিরবিহীন উন্নয়ন এই ভাবনার প্রেক্ষাপট রচনা করেছে। ক্ষমতায় এসে ইস্তক একনিষ্ঠভাবে মমতা তাঁর দায়বদ্ধতা যেমন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, তেমনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রতিশ্রুত উন্নয়নের সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন এবং ঘটিয়ে চলেছেন। ফলে এই রাজ্যের মানুষের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি আজ কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁকে ছোঁবে কে?
শুধু রাজ্যে কেন, দেশের বাদবাকি অংশেও তাঁর এই লড়াকু উন্নয়নকামী গরিব সাধারণের প্রতি দায়বদ্ধ ভাবমূর্তির প্রভাব যথেষ্ট। দেশের রাজনৈতিক শিবিরগুলি সেটা বেশ ভালোই জানে। গোটা ভারতে তাঁর মতো জনপ্রিয় প্রভাবশালী নেত্রী ক’জন আছেন বলুন তো? নরেন্দ্র মোদির মতো জবরদস্ত প্রতিপক্ষকে ভোটযুদ্ধে ধরাশায়ী করতে তাঁর সমকক্ষই বা ক’জন? কিন্তু, এবারের লোকসভা ভোটে তাঁর এই অনন্য ক্ষমতাশক্তিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারল না মোদি-বিরোধী শিবির। ফেডারেল ফ্রন্টই হোক বা ইউনাইটেড ইন্ডিয়া—মমতাকে প্রধান নেত্রী প্রজেক্ট করে কংগ্রেসকে নিয়ে জাতীয় স্তরে একটা জোরদার মোদি-বিরোধী শক্তি গড়ে উঠতেই পারত। সেরকম একটা সূচনাও হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও প্রথমটায় এমন একটা ফ্রন্ট তৈরি নিয়ে বিশেষ আশাবাদী ছিলেন। সেই শিবিরের অন্যতম প্রধান নেত্রী যে মমতা সেটাও বোঝা যাচ্ছিল আর সেজন্যই বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবেও তাঁর নামটাই বেশি করে ভেসে উঠছিল। আর তাই দেখে প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন উড়তে শুরু করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে।
কিন্তু জাতীয় স্তরে জোট হবে, তাতে কংগ্রেস থাকবে, অথচ নেতৃত্বের রাশ থাকবে অন্য দলের হাতে—এটা ভারতের রাজনৈতিক জলবায়ু এখনও মনে হয় ঠিক হজম করে উঠতে পারে না! কংগ্রেস জোটে থাকলে যেন ঐতিহাসিক সূত্রেই যাবতীয় রাশ কংগ্রেসের হাতেই দিতে হবে! তাই, জোটের গল্পে প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গ একটু ঘন হওয়ার মুখেই রাহুলজি ঘোষণা করে দিলেন—যা হবে রেজাল্ট দেখেই হবে। ব্যাস! ধাক্কা। ক্যাপ্টেনবিহীন জাহাজের দশায় পড়ল জোট। তবু, মমতার নেতৃত্বে চন্দ্রবাবুরা মোদি-বিরোধী শক্তিগুলিকে এককাট্টা করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, আজও সে চেষ্টা অব্যাহত। ২১ মে দিল্লিতে মমতাকে মধ্যমণি করে বিরোধীদের বৈঠক তারই প্রমাণ। কিন্তু, এই বৈঠক নিয়ে রাহুল-কংগ্রেস কতটা আন্তরিক তা বুঝতে ২১ অবধি অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ইউপিতে অখিলেশ-মায়াবতী জোট হওয়ায় মোদিজি এবং তাঁর দলের কপালে গাঢ় ভাঁজ দেখেও কেন জোট নিয়ে কংগ্রেসের এখনও এত দোলাচল বোঝা দায়!
প্রশ্ন তো উঠছে, মমতার নেতৃত্ব মানতে কংগ্রেসি অনীহাই কি এর কারণ? এর পর যদি কেউ বলেন, মমতার নেতৃত্ব মানতে কংগ্রেসি অনীহাই আখেরে মোদিজির সুবিধে করে দিল—দোষ দেওয়া যাবে! ভাবুন তো সারা দেশে যদি মোদি-বিরোধী শক্তিগুলো জননেত্রী মমতার নেতৃত্বে মমতার তত্ত্ব মেনে শক্তি ক্ষমতা অনুযায়ী একের বিরুদ্ধে এক লড়তে নামত—মোজিদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের লড়াইটা কত পোক্ত হতো! ভুললে চলবে শেষ লোকসভায় অর্থাৎ ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপি ২৮২ আসন পেয়ে রেকর্ড করেছিল ঠিকই কিন্তু ভোট পেয়েছিল মাত্র ৩১ শতাংশ! স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এত কম ভোট পেয়ে এমন গরিষ্ঠ সরকার গঠিত হয়নি আগে—এটাও তো রেকর্ড!
অথচ, সেবার ছিল উত্তাল মোদি-হাওয়া! তাতেই ৩১ শতাংশ। আর এবার নোটবন্দি ইত্যাদির কারণে হাওয়া কেমন তা আলাদা করে বলার দরকার নেই আশা করি। কিন্তু, মোদিজির বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়ার মানুষটি কই! গোটা দেশে একমাত্র একজন—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, জোটবদ্ধ অভিযানের অভাবে তাঁর লড়াইয়ের ক্ষেত্র তো পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। অন্যদিকে, বালাকোট, দ্বিতীয় সার্জিকাল স্ট্রাইক, অভিনন্দন ভর্তমান উদ্ধার, আধুনিকতম ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উদ্বোধন এবং কাশ্মীরে সেনা কনভয়ে জঙ্গি হামলার পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ভারতের তরফে কড়া হুঁশিয়ারি, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ইত্যাদির পর দেশ জুড়ে গেরুয়া পালে নতুন করে যে বাতাস লাগেনি, জনমনের একাংশে ৫৬ ইঞ্চির প্রতি রাজনৈতিক ভাবাবেগ যে একেবারেই চাগাড় দেয়নি—এমনটাও কি জোর দিয়ে বলা
যাচ্ছে? বলা গেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষজ্ঞদের একাংশ থেকে শুরু করে এ তাবৎ প্রকাশিত বেশ কয়েকটি জনমত সমীক্ষা টেনেটুনে হলেও মোদিজিকেই পাশ মার্ক দিচ্ছেন কেন, কিছু আসন কম হলেও দ্বিতীয়বারের জন্য মোদিজিকেই দিল্লির মসনদে দেখছেন কীভাবে! লোকসভা ভোটযুদ্ধে মমতার নেতৃত্বে মোদি-বিরোধী দলগুলো এককাট্টা হয়ে নামলে কি এত সহজে এমন সম্ভাবনার কথা ভাবা যেত?