ইন্দোনেশিয়ার বালির অপার সৌন্দর্য বর্ণনায় সমীর কুমার ঘোষ।
দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ, মনোরম সমুদ্র সৈকত, সবুজ ধানখেত, আগ্নেয়গিরি, ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য সব মিলিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেশিয়ার ‘বালি’ সত্যিই যেন এক রূপকথার স্বপ্নপুরী। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও বালির খ্যাতি আজ জগৎব্যাপী। ইদানীং আবার সারা বিশ্বের নবদম্পতিদের মধুচন্দ্রিমা যাপনেরও অন্যতম সেরা জায়গা হয়ে উঠেছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন মন্দিরময় এই রমণীয় দ্বীপভূমি।
এই আশ্চর্য দ্বীপটি দেখব বলে এক আলো ঝলমল রাতে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে চার ঘণ্টার উড়ানে প্রথমে পৌঁছই সিঙ্গাপুর, সেখান থেকে বিমান বদল করে দু’ঘণ্টায় পৌঁছে যাই বালির একমাত্র বিমানবন্দর ডেনপাসার।
খুব সুন্দর সাজানো গোছানো বিমানবন্দরটি। বাইরে এসে দেখি আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝকঝকে বালিনিজ তরুণ আমোক। এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে ওই আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড। ওর সঙ্গেই রওনা দিই হোটেলের পথে।
সুন্দর পরিচ্ছন্ন পথ ধরে এগিয়ে চলি। বেশ খানিকটা এগতেই দেখি পথের মোড়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে মহাভারতের দুই যুদ্ধরত চরিত্রের সুবিশাল স্ট্যাচু। তাঁদের একজন রথারূঢ়, সম্ভবত তিনি কর্ণ। শুনেছি, শুধু বালি নয়, পুরো ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জেই ভারতীয় রামায়ণ ও মহাভারতের প্রভাব খুব।
আমোক জানায়, এই বালি দ্বীপটি পশ্চিমে জাভা এবং পূর্বে লম্বক দ্বীপ। পূর্ব জাভার মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই এই বালি দ্বীপের অবস্থান।
পরিচ্ছন্ন মসৃণ পথের দু’-ধারে বড় বড় পাম গাছের সারি। পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই হোটেলে। স্নান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ি বালির অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘উলুন দানু’ মন্দির দর্শনে। কথিত আছে, বালির রাজা আগুঙ্গ নির্জন পরিবেশে ধ্যান করার জন্য বেরাতান হ্রদের ধারে এক অসাধারণ নৈসর্গিক পরিবেশে এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সুন্দর সহাবস্থানও রয়েছে মন্দিরটিতে।
বালি শহর থেকে ‘উলুন দানু’ প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ। সুন্দর দু’-লেনে বিভক্ত রাস্তা। বেলা দেড়টা নাগাদ রওনা দিয়ে চারটের মধ্যেই পৌঁছে যাই ‘উলুন দানু’। প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ে ফুলে ফুলে সাজানো এক মনোরম উদ্যান। দেখলেই দু’-চোখ জুড়িয়ে যায়।
বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা এই উদ্যানটির ঠিক পিছনেই নির্জন পাহাড়ের কোলে বেরাতান হ্রদ। টলটল করছে নীল জল। আর সেই জলে ঢেউ তুলে, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে বেশ কয়েকটি স্পিড বোট। দেশ-বিদেশের অগণিত পর্যটকের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে পুরো এলাকা। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অসংখ্য সদ্য বিবাহিত দম্পতিও। বাগানে কিংবা হ্রদের তীরে বসে সকলেই উপভোগ করতে চাইছেন মহিমাময় এই জায়গাটির স্বর্গীয় সুষমা।
এই সৌন্দর্যমণ্ডিত বাগানটির এক প্রান্তে হ্রদের কোলে গড়ে উঠেছে ‘উলুন দানু’ মন্দিরটি। ছোট্ট অথচ সুন্দর। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিটিও দু’চোখ ভরে দেখার মতো। মুগ্ধ বিস্ময়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিই সেই আশ্চর্য সৌন্দর্যলোকে। তারপর এগিয়ে চলি।
তখন দিনের আলো কমে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন ধীরে ধীরে একটা কালো চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে শান্ত হ্রদের গায়ে, দূর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়। দিনের শেষে বাগানের ক্লান্ত ফুলগুলিও তখন যেন একটু বিশ্রামের অপেক্ষায়। তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে আসি বাইরে। শহরে ফিরে একটা ভারতীয় রেস্তরাঁয় রাতের আহার সেরে ফিরে আসি হোটেলে।
পরদিন সকালে আবার আমরা বেরিয়ে পড়ি বালির অন্যতম দর্শনীয় স্থান পাহাড়ি গ্রাম কিন্টামণির পথে। বেশ কিছুটা পথ চলার পর প্রথমে পৌঁছই বালির প্রখ্যাত হিন্দু মন্দির ‘তীর্ত আম্পুল’-এ। তীর্ত অর্থাৎ তীর্থ আর আম্পুল মানে উৎস। বলা যেতে পারে উৎস তীর্থ। আসলে এটি একটি প্রাচীন পবিত্র জলের মন্দির। বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থান এই মন্দিরটির। মন্দিরে ঢোকার আগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবাইকেই মন্দির কমিটির দেওয়া একখণ্ড রঙিন বস্ত্র পরতে হয়। স্থানীয় ভাষায় বস্ত্রখণ্ডটির নাম ‘সারং’।
এই মন্দির চত্বরের ঠিক পিছন দিকেই রয়েছে এক সুন্দর প্রস্রবণ। প্রায় গোটা তিরিশেক ধারায় ঝরে পড়ছে কাচের মতো স্বচ্ছ জল। আর সেই জলে মনের আনন্দে পুণ্য স্নানে মেতে উঠেছেন দেশ-বিদেশের নর-নারী। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই জলে স্নান করলে নাকি সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। মন্দিরটি বিষ্ণুর নামে উৎসর্গীকৃত। মন্দির চত্বরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মন্দিরের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেবতা ইন্দ্রের মন্দিরও।
পবিত্র জলধারা দেখে বেরিয়ে আসি বাইরে। বেরনোর মুখেই পড়ে একটা বড় বাঁধানো পুকুর। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন আকারের ও বর্ণের মাছ। রঙের আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সমগ্র জলাশয়।
‘তীর্ত আম্পুল’ দেখে বেরনোর পর আমোক আমাদের নিয়ে যায় একটি কফি উৎপাদন কেন্দ্রে। অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে কেন্দ্রটি। অপরূপ সুন্দরী একজন বালিনিজ তরুণী ঝরঝরে ইংরেজিতে বিভিন্ন রকম কফির গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে শোনান আমাদের। কফি তৈরির প্রক্রিয়া বলার সময় হঠাৎ ওর মুখে একটা তথ্য শুনে আমরা চমকে উঠি। শুনি এই কেন্দ্রটিতে বিশেষ এক প্রাণীকে লালনপালন করা হয় (সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশটি)। পাশেই রাখা একটি কাঠের খাঁচায় প্রাণীটিকে দেখিয়েও দেয় তরুণী। অনেকটা বড় বনবিড়ালের মতো দেখতে।
তবে এই প্রাণীদের বিশেষত্ব হল কফির যে বীজগুলো ওদের খেতে দেওয়া হয়, সেগুলি ওরা হজম করতে পারে না। পরদিন সেই বীজগুলিই অবিকৃত অবস্থায় বেরিয়ে আসে ওদের মলের সঙ্গে। মূল প্রক্রিয়াটি চলে প্রাণীটির পাকস্থলীতে। পুনরায় সেই বীজগুলি সংগ্রহ করে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে কড়াইতে ভাজা হয়। পরে সেগুলি মেশিনে গুঁড়ো করে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের কফি।
প্রাণীটির নাম ‘লুয়াক’। এই কফির নামকরণও হয়েছে প্রাণীটির নামানুসারে ‘লুয়াক কফি’। সাধারণ মানের কফির থেকে এই কফির দাম কয়েক গুণ বেশি।
তরুণীটি সবাইকে ছোট ছোট কাপে এই কফি খেতেও দেয়। একটু দ্বিধা সত্ত্বেও খেয়ে দেখি। সত্যিই অপূর্ব স্বাদ। যেন মুখে লেগে থাকে। ইউরোপের কয়েকজন পর্যটককে বেশ বড় কাপে আয়েশ করে লুয়াক কফি খেতে দেখি। তবে দামের কথা শুনে আমি আর কেনার কথা ভাবিনি।
এরপর আমরা আগ্নেয়গিরি দেখতে চলে আসি মাউন্ট বাটুর ও তার কোলে অবস্থিত বাটুর হ্রদের কাছে। পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি এলাকা। অনেকটা আমাদের সিমলা বা মানালির মতো। ঝাঁ চকচকে বাঁধানো রাস্তার একদিকে মজবুত রেলিং দিয়ে ঘেরা।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালেই চোখে পড়ে বালির অন্যতম জীবন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট বাটুর। যে কোনও সময় ভয়ঙ্কর হয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে। শুনলাম এটির শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল ২০০০ সালে।
এই আগ্নেয়গিরিটির পাদদেশেই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাধারায় পুষ্ট হয়ে প্রায় ষোলো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে বাটুর হ্রদ। হ্রদটির ধারে পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে ছবির মতো সাজানো কিন্তামণি গ্রাম। অপরূপ সে দৃশ্য।
এখানে দু’-দণ্ড দাঁড়িয়ে পর্যটকরা যাতে প্রাণভরে বিশ্ব প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য ফুটপাতের ধারে বেশ খানিকটা অংশ চওড়া করে বাঁধিয়ে মোটা রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বেশ বড়সড় একটা রেস্তরাঁও। পর্যটকরা যাতে চা, কফি কিংবা পকোড়া খেতে খেতে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য করা হয়েছে সুন্দর বসার ব্যবস্থাও।
মাউন্ট বাটুর দেখে আমরা রওনা দিই এদিনের শেষ গন্তব্য সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত ‘তানহা লট্’ মন্দিরের দিকে। তানহা লট কথাটির অর্থ ‘ল্যান্ড অন দ্য সি’।
পথের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগতে থাকি। তানহা লটের যত নিকটবর্তী হতে থাকি, পথের অনুপম সৌন্দর্য ততই আমাদের মুগ্ধ করে দেয়।
সূর্যদেব তখন পশ্চিমে হেলেছেন। তাঁর রঙিন আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সারা পশ্চিমাকাশ। সেই আলো গায়ে মেখে আমরা হাজির হই তানহা লট মন্দিরে। উত্তাল ভারত মহাসাগরের বুকে এ এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। সমুদ্র দেবতা বরুণ এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা।
কথিত আছে, নীরা খাঁ নামে একজন ভারতীয় হিন্দু ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে বালিতে আসেন এবং এখানকার স্বর্গীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে একটি মন্দির স্থাপনের জন্য ভালো জায়গার খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু স্থলভূমিতে তেমন মনমতো জায়গা না পাওয়ায় তিনি ভারত মহাসাগরের তীরে এক বিশাল শিলাখণ্ডের উপর একটি সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেন। অনেকটা কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকস-এর মতো। সেটিই তানহা লট মন্দির।
তবে এই মন্দিরটির বিশেষত্ব এই যে, জোয়ারের সময় মন্দিরের অনেকটা অংশ সমুদ্রের জলের তলায় চলে যায়। তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয় পুরো মন্দিরটিই যেন জলের উপর ভাসছে। স্বভাবতই তখন মন্দিরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। আবার ভাটার সময় জল সরে গেলে মন্দিরে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়।
পুরোপুরি ভাটার সময় না যাওয়ায় আমার পক্ষেও মন্দিরে ঢোকা সম্ভব হয়নি। তবে মন্দিরের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভারত মহাসাগরের কোলে গড়ে ওঠা মন্দিরটির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।
দেখি ভারত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি ক্রমাগত ঢেউ তুলে একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে মন্দিরটির গায়ে। আর সেই অপরূপ দৃশ্যের সামনে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে দেশ-বিদেশের পর্যটক।
সুন্দর পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা একটি সাজানো বাগান পেরিয়ে পৌঁছতে হয় মন্দিরটিতে। দেখতে দেখতে ঘণ্টা দেড়েক সময় কীভাবে যে কেটে যায় টেরই পাওয়া যায় না। প্রবেশপথের প্রায় উল্টো দিকেই রয়েছে নীরা খাঁর মন্দিরটিও। এটিও দেখার মতো।
ক্রমে ছায়া ঘনায় ধরণীতে। আমরাও এদিনের মতো ভ্রমণ সাঙ্গ করে ফিরে যাই হোটেলে।
পরদিন সকালে জলখাবার খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি মাউন্ট আগুঙ্গ-র পথে। বালিতে যে দু’টি আগ্নেয়গিরি এখনও সক্রিয়, মাউন্ট আগুঙ্গ তার অন্যতম। এরই কোলে অবস্থিত বেশাখী (বৈশাখী নয়) মন্দির দেখতেই শুরু হয় আমাদের যাত্রা। এটি বালির অন্যতম পবিত্র মন্দিরও বটে।
সুন্দর পরিচ্ছন্ন পথ বেয়ে এগিয়ে চলি। পথের ধারে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে সবুজ ধান ও ভুট্টার খেত। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই বেশাখী মন্দিরের কাছে। তবে মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরেই রাখতে হয় আমাদের গাড়ি।
নির্ধারিত মূল্যের টিকিট কেটে ঢুকতে হয় মন্দিরটিতে। টিকিট কাউন্টার থেকে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থান মন্দিরটির। টিকিট কেনার সময় শুনি, এই টিকিটের মূল্যের মধ্যেই পর্যটকদের মন্দির পর্যন্ত বাইকে করে পৌঁছে দেওয়া, মন্দির দর্শন ও মন্দির চত্বরে প্রবেশের সময় বাধ্যতামূলক পরিধেয় বস্ত্রখণ্ড ‘সারং’-এর ভাড়াও ধরা থাকে। তবে মন্দির দর্শন সেরে ফিরতে হয় পায়ে হেঁটেই।
বাইকে চড়ে পৌঁছে যাই মন্দির চত্বরে। এক বিশাল এলাকা জুড়ে পাহাড়ের কোলে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে আগ্নেয় পাথরে তৈরি মন্দিরগুলি। অসাধারণ এর নির্মাণশৈলী। বালি হিন্দুপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় এখানে হিন্দু মন্দিরের ছড়াছড়ি। স্থানীয় অনেক মহিলাকে দেখি একটা বেত বা বাঁশের চুবড়ির মধ্যে পুজোর উপকরণ সাজিয়ে মাথায় নিয়ে চলছেন দেবতার উদ্দেশে অর্ঘ্য নিবেদন করতে। মন্দির থেকে সামান্য দূরত্বেই মাউন্ট আগুঙ্গ।
বেশাখী মন্দির দেখে বেরিয়ে এসে আমরা রওনা দিই এদিনের শেষ গন্তব্য সমুদ্রতীরে ‘উলু ওয়াতু’ মন্দিরের দিকে। অনেকটাই পথ। সমুদ্রতল থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই মন্দিরটি বিখ্যাত সূর্যাস্তের জন্য। আমরা যখন মন্দিরের কাছে পৌঁছই তখন ক্লান্ত সূর্যদেব দিনের পরিক্রমা সেরে পশ্চিমে ঢলেছেন।
এখানে মন্দির দর্শন সেরে আমরা দেখব রামায়ণকে উপজীব্য করে নির্মিত বালির বিখ্যাত ‘কেক্যাক’ নৃত্যের একটি অনুষ্ঠানও।
স্থানীয় রীতি অনুযায়ী উলু ওয়াতু মন্দিরে প্রবেশের সময় পুরুষদের একখণ্ড গৈরিক বস্ত্র কোমরে জড়িয়ে নিতে হয়। মহিলাদের পরতে হয় বেগুনি রঙের বস্ত্র।
সুন্দর গাছগাছালিতে ছাওয়া প্রান্তর পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত মন্দিরটির কাছে পৌঁছতেই ভারত মহাসাগরের এক অনবদ্য রূপ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে রওনা দিই পাশের একটি চত্বরে ‘কেক্যাক’ নৃত্য দর্শনে।
এখানে মঞ্চ বলে কিছু নেই। একটা ছোট্ট গোলাকার স্টেডিয়ামে দর্শকাসন ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। নীচে ফাঁকা জায়গাটিতে একখণ্ড পাথরের উপর জ্বলছে কয়েকটি উজ্জ্বল অগ্নিশিখা। সেই প্রস্তরখণ্ডের সামনে প্রায় ৩০-৪০জন শিল্পী দেড় ঘণ্টা ধরে এক অপরূপ নৃত্যশৈলীতে ফুটিয়ে তুললেন রামায়ণ মহাকাব্যের এক সুদীর্ঘ অধ্যায়।
নৃত্যানুষ্ঠানটি যখন বেশ জমে উঠেছে তখন হঠাৎ তাকিয়ে দেখিয়ে সমস্ত পশ্চিমাকাশ রাঙিয়ে অস্তাচলে যেতে উদ্যত হয়েছেন সূর্যদেব। খানিক বাদেই মহাসাগরের বুকে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন তিনি।
কেক্যাক নৃত্যের অনুষ্ঠানটি শেষ হয় ঠিক রাত আটটায়। বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে মিনিট পনেরো এগতেই পড়ে বিখ্যাত জিম্বারান সমুদ্র সৈকত। সৈকতের ধারে পরপর বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল। এখানেই বালুতটে বসে মোমবাতির স্বল্প আলোয় আমরা সেরে নেব রাতের আহার।
আগে থেকেই বলা ছিল। তাই নির্ধারিত হোটেলটিতে
পৌঁছে দেখি সাগর তীরে বালির উপর সারি দিয়ে চেয়ার টেবিল পাতা। যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখি, সৈকত বরাবর সবক’টি হোটেলের সামনেই স্বল্পালোকে নৈশভোজে মেতে উঠেছেন ভ্রামণিকের দল। কোথাও বা সমুদ্রতটের একপ্রান্তে গড়ে তোলা ছোট ছোট মঞ্চে রঙিন আলোর ঝরনাধারার মাঝে নাচে গানে সন্ধ্যাটিকে মনোরম করে তুলতে চাইছেন স্থানীয় শিল্পীর দল।
বালুতটে একটা চেয়ার নিয়ে বসি। চোখের সামনে ভারত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি একের পর এক এসে আছড়ে পড়ে তটভূমিতে। এই সমুদ্র সৈকতটি খুব কাছেই ডেনপাসার বিমান বন্দর। তাই মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে বিমান ওঠানামার দৃশ্য। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন আলতো করে জল ছুঁয়েই এগিয়ে গেল বিমানটি।
খাবার আসে। কলপাতার থালায় সরু চালের সাদা ভাত, সব্জি, ডাল, তিনরকম সামুদ্রিক মাছ, স্যালাড ও সবশেষে একটা করে গোলাপজাম। অসাধারণ স্বাদ। পরিতৃপ্ত মনে যখন হোটেলে ফিরি ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা।
এ যাত্রায় বালি ভ্রমণ শেষ। তাই হোটেলে ফেরার পথে মনের কোণে কোথাও যেন একটু বিষণ্ণ রাগিণীর সুরও বাজতে থাকে।
পরদিন সকালে উঠেই বালিকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বিমানবন্দরের উদ্দেশে। বেলা বারোটায় সিঙ্গাপুরের উড়ান। ওখানে পৌঁছে ক্ষণিক বিরতির পর ধরব কলকাতার বিমান। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় এগারোটা।
ব্যাগ চেকিং হয়ে গেলে বোর্ডিং পাস নিয়ে বসি। চোখের সামনে একের পর এক বিমান ওঠে, নামে। আমি অপেক্ষা করি বিমানে ওঠার ডাক শোনার আশায়।
কিছু তথ্য: কলকাতা থেকে বালি সরাসরি বিমানে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘোরা ভালো।
বালি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুইয়ের জন্যই বিখ্যাত। বালির উলু ওয়াতু ও তানহা লট সমুদ্র সৈকত দু’টি আসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত হলেও স্নানের জন্য উপযোগী নয়।
১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সিঙ্গরাজার আমন্ত্রণে বালি দ্বীপ ভ্রমণে আসেন। ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ গ্রন্থটিতে রয়েছে সেই উল্লেখ।
ছবি: লেখক