শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন। কলকাতা ও জেলার নানা জনপ্রিয় শাড়ি প্রতিষ্ঠান নিজেদের পুজোর সম্ভার সাজিয়ে বসেছে। কোথায় কেমন দামে পছন্দের কোন শাড়ি মিলবে তা লিস্ট মিলিয়ে দেখে নেওয়ার পালা।
পুজোর কেনাকাটা শুরু হয় শাড়ির খোঁজখবর দিয়ে। গত প্রজন্ম থেকে আধুনিক প্রজন্ম, শাড়ির প্রতি টান বাঙালি নারীর চিরন্তন। পুজোর বাজারের লিস্ট করার আগে তাই পছন্দের শাড়ির কথা আলাদা করে সে রেখে দেয় মনের কোণে। বাঙালির পুজোর ফর্দ বর্ণনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মনে-রেখো’ পাড়ের শাড়ি/ সোনায় জড়ানো শাঁখা/ দিল্লির-কাজ-করা লাল মখমলের চটি।’ এখানেও শুরুতে সেই শাড়ির কথাই। কলকাতার বিভিন্ন বিপণি ও প্রতিষ্ঠানও সেজে উঠেছে শাড়ির সম্ভারে। আজ রইল তেমনই কিছু দোকানের হদিশ।
সাহা টেক্সটাইল
শাড়ি ও রেডিমেড পোশাকের জগতে সাহা টেক্সটাইল অন্যতম নাম। নিজস্ব নকশায় ও দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি এই শাড়ির চাহিদা বরাবর তুঙ্গে। সাবেক নকশা থেকে আধুনিক স্টাইল শাড়ির সম্ভারে নজর কাড়বে প্রায় সব ধরনের ডিজাইন। এবার পুজোয় হ্যান্ডলুমের চাহিদা আগের বারের মতোই রয়েছে। তবে এবছর তার কিছু নকশায় পরিবর্তন এসেছে। এবছর প্যাচ ওয়ার্ক, বাটিক, ব্লক বিভিন্ন কাজের উপর হ্যান্ডলুমের সম্ভার রয়েছে। এছাড়া রেডিমেড মেয়েদের পোশাকে নতুন দু’টি বিভাগ ‘আকৃতি’ ও ‘শখ’ শুরু হয়েছে। ‘দেশ’, ‘রবি’, ‘অরণ্য’, ‘বুনন’ ইত্যাদি বিভাগেও শাড়ি ও পোশাক প্রতি বছরের মতো এবছরও পাবেন। সেখানেও রয়েছে নানা নতুনত্ব। বেনারসি বিভাগ ঢেলে সেজেছে সাহা টেক্সটাইলে। এদের বিশেষত্ব মঙ্গল বেনারসি, রাজঘরানা বেনারসি ও রামনগর বেনারসি। এই তিন ধরনের বেনারসিতে সুতো ও জরির নিজস্ব নকশা রয়েছে। নিজেদের তাঁতি ও কারখানায় প্রস্তুত এই বেনারসিগুলি সবই নকশার তারতম্যে মন কাড়বে বলে দাবি সংস্থার। মঙ্গল বেনারসির রেঞ্জ ঘোরাফেরা করবে ৫০০০-২৫০০০ টাকার মধ্যে। হাল্কা থেকে ভারী নকশা অনুযায়ী দামের তারতম্য ঘটে। রাজঘরানা ও রামনগর বেনারসির দাম শুরু হয় ৮-১০ হাজার টাকা থেকে। ১ লক্ষ ও ততোধিক দামেও এই বেনারসি মেলে। নকশাদার হ্যান্ডলুমের ক্ষেত্রে দাম শুরু ১০০০-১৫০০ টাকা থেকে। এছাড়া ফ্যান্সি ও ডিজাইনার শাড়িও পাবেন এখানে। ফ্যান্সি ও ডিজাইনার দু’রকম বৈশিষ্ট্য একসঙ্গে চাইলে বাজেট শুরু হবে ৪-৫ হাজার টাকা। এছাড়া রেডিমেড পোশাকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের পোশাকের সম্ভার পাবেন এখানে।
মুর্শিদাবাদ সিল্ক হাউজ
জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যশালী শাড়ির বিপণিগুলির মধ্যে মুর্শিদাবাদ সিল্ক হাউজ অন্যতম। তসর ও সিল্ক শাড়ির বিশ্বস্ত এই প্রতিষ্ঠান সেজে উঠেছে আগমনীর নতুন কালেকশনে। এবছর তসর শাড়িতে প্রকৃতি থেকে উপকরণ জোগাড় করে তা থেকেই প্রিন্ট তৈরি করছে এই সংস্থা। প্রাকৃতিক ডাই, প্রাকৃতিক প্রিন্ট এগুলোই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানে। অন্যতম কর্ণধার বিপাশা বিশ্বাস জানালেন, পাতা পচিয়ে তাকে শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে প্রিন্টে। মোটিফগুলির ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক ছোঁয়াচ রাখা হয়েছে। এই ন্যাচারাল প্রিন্টের তসরের দাম শুরু ৭-৮ হাজার টাকা থেকে। এছাড়া এবছর এখানে গরদের উপরেও নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। সাধারণত সাদা ও লাল পাড়ের গরদই বেশি চোখে পড়ে। এবছর এখানে গরদে নানা রং আনা হয়েছে। সাধারণ সিল্কের শাড়ি শুরু সাড়ে ৩-৪ হাজার টাকা থেকে। এছাড়া এখানে পাবেন স্বর্ণচরি, বালুচরির এক বিপুল সম্ভার। রেডিমেড কুর্তিও পাবেন এখানে। ৩৮-৪৬ সাইজের সুতি ও সিল্কের কুর্তি মিলবে। কটন কুর্তির দাম শুরু ৮৫০ টাকা থেকে। সিল্কের কুর্তির দাম শুরু ১০০০-১২০০ টাকা। এছাড়া স্কার্ট, টপ, স্ট্রেট প্যান্ট, লং ড্রেস, কামিজ, দোপাট্টা ও স্টোল পাবেন। সিল্কের দোপাট্টা পাবেন ১৬০০ টাকা বাজেট থাকলে। কাঁথা স্টিচের ব্লাউজও মিলবে। পুরুষদের শার্ট, সুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবিও পাবেন এখানে।
বেনারসি নিকেতন
শাড়ির জগতে অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান বেনারসি নিকেতন। শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিট, কাঁচড়াপাড়া ও বারাসতে এই প্রতিষ্ঠানের শোরুম রয়েছে। এবার পুজোর ট্রেন্ড সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ডিরেক্টর নয়ন সাহা জানালেন, এবার পুজোয় এদের অন্যতম আকর্ষণের মধ্যে পাবেন মাশরু ক্রেপ জর্জেট ও কাশ্মীরি পজিশনিং প্রিন্ট, ভিসকোস, বর্ডারলেস কাঞ্জিভরম, মাদুরাই সিল্ক ইত্যাদি। তাঁর মতে, ডিজাইনার শাড়ি পছন্দ করলে আবার গ্লাস টিস্যু, কোরা অর্গ্যাঞ্জা, বিচিত্রা সিল্ক ইত্যাদির চাহিদা বেশি। এই সব শাড়ির শুরুর রেঞ্জ ১২০০-১৩০০ টাকা। তবে একটু ভালো জমি ও নকশার শাড়ি খুঁজতে গেলে বাজেট ৪৫০০-৫০০০ টাকা হলে ভালো হয়। বেনারসির ক্ষেত্রেও প্রচুর নজরকাড়া নকশা এসেছে এই মরশুমে। ওপেন বর্ডার বা বর্ডারলেস বেনারসি, মীনাকারি ওপেন বর্ডার ইত্যাদি নকশার চাহিদা তুঙ্গে। হাল্কা নকশার ফ্যান্সি বেনারসি মিলবে ৩৫০০ টাকায়। ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দামে নানা কাজের বেনারসির সম্ভার পাবেন এখানে। ৭০০০-৮০০০ টাকার উপরে মিলবে পিওর বেনারসি। সিল্কের উপর কাঁথা স্টিচ, গুজরাতি স্টিচ, মসলিন সিল্ক এগুলো এবছর ট্রেন্ডি শাড়ির মধ্যে রয়েছে। ২-৩ হাজার টাকা থেকে এই ধরনের সিল্কের বাজেট শুরু। তসরের ক্ষেত্রেও কাট ওয়ার্ক, এমব্রয়ডারি, হ্যান্ড ওয়ার্কের কাজ জনপ্রিয় হয়েছে। ২ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করবে এই রেঞ্জ। এছাড়া কটনের উপর হ্যান্ড ওয়ার্ক, ডিজিটাল প্রিন্ট পাবেন। দাম শুরু ১০০০ টাকা থেকে। ১২০০-১৫০০ টাকার মধ্যে বাজেট হলে পাবেন ডিজাইনার শিফন। পুরুষদের পোশাকে ন্যায্য দামে প্রচুর কটন ও সিল্কের এথনিক পাঞ্জাবিও মিলবে এখানে।
গৌরাঙ্গ পাল অ্যান্ড সন্স
শাড়ির সাজকে আরও সুন্দর ও মোহময় করে তুলতে মনের মতো ব্লাউজের দিকেও খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। তাই আধুনিক প্রজন্ম ব্লাউজের কাটিং ও নকশার ক্ষেত্রেও বেশ ফ্যাশনেবল। বর্তমান ট্রেন্ড মেনে নানা প্যাটার্ন ও ডিজাইনের ব্লাউজ তৈরি করে দমদমের গৌরাঙ্গ পাল অ্যান্ড সন্স। অধুনা কর্ণধার গৌরীশঙ্কর পাল জানালেন, এবছর বিভিন্ন নেক স্টাইলের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। টেম্পল নেক, অ্যাসিমেট্রিক নেক, বোট নেক, অ্যাপেল নেক সহ নানা নকশায় ব্লাউজের কাটিং করা হচ্ছে। ব্লাউজের ব্যাকের নকশায় নানা এমব্রয়ডারির কাজ এনেছেন গৌরীশঙ্করবাবু। ফুলকারি নকশা, কাঁথা স্টিচ, মাল্টিফ্লোরাল কম্পিউটার এমব্রয়ডারি, আড়িকাজ পাবেন ব্লাউজের পিছনের নকশায়। এছাড়া বিশেষ কাট ও লেসের ব্যবহারও করা হচ্ছে পিছনে। স্লিভের ক্ষেত্রে বার্বি স্লিভ, বেল স্লিভ, ক্রোকোডাইল স্লিভ, পাফ স্লিভ, এলবো স্লিভ, র্যাফেল স্লিভের আধিক্য এবার বেশি। হাতার গোড়ায় নকশা, লেসও এবারের আকর্ষণ। ব্লাউজের নকশাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তাতে অন্যান্য নানা অ্যাক্সেসরিজও ব্যবহার করা হয় বলে জানালেন ডিজাইনার গৌরীশঙ্কর পাল। ব্লাউজের কাপড় ও নকশার উপর নির্ভর করছে দাম। ডিজাইনার ব্লাউজের দাম শুরু ৪০০ টাকা থেকে।
নির্মল শাড়ি মন্দির
পুজোর বাজারে শাড়িপ্রেমীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় সেন্ট্রাল কলকাতার রামমন্দিরের বিপরীতে জনপ্রিয় এই নির্মল শাড়ি মন্দির। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাড়ি প্রস্তুত করছে এই সংস্থা। নিজস্ব কারখানায় ন্যায্য মূল্যে ট্র্যাডিশনাল শাড়ি তৈরিই এদের ইউএসপি। সংস্থার কর্ণধার বীরেন্দ্র গোয়েঙ্কা জানালেন, বনধেজ (বাঁধনি), ঘাটচোলা-সহ গোটা দেশের নানা রকমের হ্যান্ডলুম শাড়ির সম্ভার এখানে পাবেন। এমব্রয়ডারি, বাটিক, প্যাচ ওয়ার্কের নানা কাজ সংস্থার ম্যানুফ্যাকচারিং বিভাগে করে তা সারা ভারতে রপ্তানি করা হয়। নেট, শিফন, জর্জেট, কটন, হ্যান্ডলুম সবেতেই প্রিন্ট ও এমব্রয়ডারি কাজ মিলবে। ৫০০-৩০,০০০ টাকার বিপুল রেঞ্জে নানা ধরনের শাড়ি এখানে পাবেন। নিত্য পরার সুপারসফট শাড়ির মধ্যে এমব্রয়ডারির কাজ থাকলে তা ১২০০-১৩০০ টাকায় পাবেন। বাটিক অ্যাপ্লিক কাজের রেঞ্জও শুরু এমন দাম থেকে। শিফন, জর্জেট ও ক্রেপের উপর প্রিন্টেড কাজ পাবেন ১০০০-১০,০০০ টাকা রেঞ্জে। অর্গ্যাঞ্জা পাবেন ২০০০-১৫০০০ টাকায়। ক্রাশ টিস্যু এবার পুজোয় ফ্যাশনে ইন। এটি নানা রং ও নকশায় পাবেন নির্মল শাড়ি মন্দিরে। দাম ঘোরাফেরা করবে ২০০০-৩০,০০০ টাকার মধ্যে। সুপারনেট, মুগা ও কোটার প্রিন্টেড ও নানা নকশার কাজ পাবেন ৮০০-২০০০ টাকার মধ্যে। সুপার সফট চান্দেরির উপর প্রিন্ট শাড়ি মিলবে ৩০০০ টাকা রেঞ্জ থেকে। ক্রেপ প্রিন্টেড শাড়ির ক্ষেত্রেও নতুনত্ব পাবেন এখানে। এগুলো ছাড়াও পুজোর কালেকশনে তসরের নানা ভ্যারাইটি পাবেন এখানে। বাটিক তসর, ঘিচা তসর, উইভিং তসর, এমব্রয়ডারি তসর, প্রিন্টেড তসর ইত্যাদি পাবেন এখানে। ২০০০-১৫,০০০ টাকার মধ্যে নানা ভ্যারাইটি পাবেন। ইক্কত পাটোলার ভ্যারাইটি মিলবে ৩০০০-২০,০০০ টাকার নানা রেঞ্জে। বাঁধনি, মীনাকারি, খাড্ডি, ঘাটচোলার বিপুল কালেকশন পাবেন এখানে। ৪০০০-২৫,০০০ টাকা রেঞ্জে রং ও নকশার ভ্যারাইটি পাবেন। পুজোর সময় ফ্যান্সি ও পিওর বেনারসি কিনতে চাইলে তার দাম শুরু ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ৩০,০০০ টাকার মধ্যে পাবেন বেনারসির নানা ভ্যারাইটি। কাতান সিল্ক, তসর বেনারসির সম্ভার নজর কাড়ে। সাউথ সিল্ক ও কাঞ্জিভরম সিল্ক পাবেন ৫০০০-৩০,০০০ টাকার মধ্যে।
পিট্টী শাড়ি
১৯৭৬ সাল থেকে সুতির ছাপা শাড়ি তৈরি করছে পিট্টী শাড়ি। ১০০ শতাংশ কটন প্রিন্টেড শাড়ি ও পাকা রং, উচিত দাম— এই মন্ত্রে ভর করেই আড়েবহরে বেড়েছে এই সংস্থা। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ডে সুতির ছাপা শাড়ি রপ্তানি করে পিট্টী শাড়ি। এবার পুজোয় প্রিন্টেড ছাপা শাড়ির মধ্যে নতুনত্ব এনেছে তারা। মসলিন, জরি বর্ডার, নরম মলমল ইত্যাদি শাড়ি তো রয়েছেই, এছাড়াও এ বছর পুজোর বিশেষ সংগ্রহে পাবেন পচমপল্লি, পিওর চান্দেরি, প্রাইম বাটিক, সাঙ্গানেরি প্রিন্ট, মসলিন লাল পাট্টা ইত্যাদি। ইঞ্চি পাড়ের শাড়ি ও সাদা জমির উপর কাজের শাড়িতে এবার নতুন নকশা এসেছে। প্রায় ১৫০ ধরনের প্রিন্ট মিলবে এখানে। পুজোয় গাঢ় রঙের চাহিদা বেশি বলেই দাবি সংস্থার। হাল্কা রঙের মধ্যে চিকু, হাল্কা বাদামি ও সাদার উপর ছাপা ভালো চলছে। শাড়িরই বাজেট ঘোরাফেরা করছে ৩০০-৬০০ টাকার মধ্যে।
মনীষা মুখোপাধ্যায়