আমরা মেয়েরা

৩০ জুলাই মানব পাচার বিরোধী দিবস: টানা লড়াই চালিয়ে উদ্ধার ১০ হাজার

 সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পল্লবী ঘোষ। আর তিন দিন পর মানব পাচার বিরোধী দিবস। এই বিষয়ে নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তিনি।  

বয়স তখন মাত্র ১২। অসমের লামডিং থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন। সেসময় দেখেছিলেন, এক প্রৌঢ় তাঁর মেয়েকে হারিয়ে দিশাহীনভাবে চিৎকার করছেন! মনে প্রশ্ন জাগে ছোট্ট পল্লবীর! কেন, কীভাবে হারিয়ে যায় মেয়েরা? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে গ্রামের এদিক ওদিক ছুটেও সুরাহা হয়নি! লামডিংয়ের বাড়িতে ফিরে এসেও অজানা প্রশ্নগুলো যেন তাঁকে তাড়া করছিল।
মেয়েরা হারিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে কী হয়, কোথায় যায় তারা? এসব নিয়ে নানা তথ্য ঘাঁটতে থাকেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশিই চলে তাঁর খোঁজ। ১৯-এ পা দিয়ে দিল্লিতে পড়াশোনা করতে যান। সেখান থেকে ফোনে বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে যখন বাংলায় কথা বলতেন তিনি, তখন একটি মেয়ে তাঁকে হঠাৎ জানায় যে তার গ্রামেও এক জায়গায় সবাই বাংলায় কথা বলেন। সে গ্রামে স্বামীদের বেশিরভাগের বয়স ৪০-৫০, তুলনায় স্ত্রীরা অল্পবয়সি। কৌতূহলী হয়েই একদিন পল্লবী সেখানে যান। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে উওর ভারতের পাহাড়ি রাজ্যের সেই গ্রামে গিয়ে তিনি দেখেন মহিলাদের গলায় পয়সার মালা, মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা, পরনে সাদা কুর্তা আর নীচে ঘাগড়া, পায়ে মোটা রুপোলি কড়া। ঠিক আঞ্চলিক বেশভূষা অথচ সকলে নিজেদের মধ্যে বাংলায় 
কথা বলছেন! 
শেষ পর্যন্ত পল্লবীর সন্দেহই সঠিক হয়! পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ওই মেয়েদের পাচার করে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাঙালি মেয়ে পল্লবীকে দেখে কিছুটা জড়তা কাটিয়ে একে একে তাঁদের অনেকে এগিয়ে আসেন। কেউ জানান, তিনি এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া থেকে। কেউ বলছেন, আমি ওড়িশার। একজন ঘোমটা থেকে উঁকি দিয়ে জানালেন তিনি অসমের। একজন বলেন, ‘এখন (সেটা ২০১৯ সাল) আমার বয়স ১৮। যখন ১৩ বছরের ছিলাম, তখন গ্রামের মেলায় লাল বরফ খেতে যাই। হাতে ৫০ পয়সা। দুধ বরফটা দেখে বারবার ইচ্ছে হচ্ছিল খাওয়ার। সেটা ২ টাকা। বছর ৪০-এর একটি লোক এগিয়ে এসে আমায় ২ টাকা দিয়ে বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমি নিতে না চাইলেও লোকটি টাকাটা এগিয়ে দিয়ে দুধ বরফ কিনে দিল। আমাদের বন্ধুত্ব হল। এরপর মাঝেমধ্যে ঝুমকো কিনে দিত। প্যাটিস, কোলা আর দামি দামি খাবারও। কোনওদিন সেসব দেখিনি আগে।’ 
মেয়েটি দরিদ্র পরিবারের। ছেলেটি তাকে ‘টার্গেট’ করে। জীবনে রেলগাড়ি না দেখা মেয়েটিকে প্রলোভন দেখিয়ে লোকাল স্টেশনে আসার কথা বলে। কথা ছিল, মেয়েটিকে দিল্লি নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেয়েটি স্টেশনে আসে। কিন্তু সেই বন্ধুটি আসে না। অপরিচিত একজন এসে বলে, ‘তোমার সঙ্গে বন্ধু হাওড়ায় দেখা করবে, ট্রেনে উঠে পড়ো!’ হাওড়ায় তাদের দেখাও হল। ট্রেনে চা-বিস্কুট খাওয়ায়। তারপর মেয়েটি জ্ঞান হারায়। ট্রেন দিল্লি পৌঁছয়। সেখান থেকে তাকে হরিয়ানার সেই গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ খুলে সে দেখে খাটিয়াতে শুয়ে আছে। পাশে দুটো গোরু বাঁধা। চিৎকার করতেই এক বয়স্ক মহিলা এসে বলেন, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। হিন্দি না জানা ১৩ বছরের মেয়েটির তখনও বিশ্বাস, সেই বন্ধুর সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে। দু’দিন পরে সে জানতে পারে, বন্ধু তাকে পাচার করে দিয়েছে। বয়সে প্রবীণ একজনের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৫ বছর বয়সে প্রথম সন্তান। তার কিছু বছর পর আসে দ্বিতীয় সন্তানও। 
এইসব শুনে পল্লবী দিল্লি ফিরে আসেন। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে নানা তথ্য জোগাড় করে জানতে পারেন পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর ভারতের মেয়েদের প্রায়শই পাচার করা হয়। ‘জেন্ডার স্টাডিজ’-এ মাস্টার্স করার পর মানব পাচার রোধী একটি সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেন তিনি। পাঁচ বছর সেখানে কাজ চলে। প্রথম উদ্ধারকাজে গিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হলেও ধীরে ধীরে সাফল্য আসে পল্লবীদের। তাঁর কথায়, ‘শুরুতে ৪-৫ বছর উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে দেখলাম, সবাই শুধু পাচার হওয়া মানুষদের উদ্ধারই করছে। তাদের কোনও পুনর্বাসন দেওয়া হচ্ছে না। তারপর আমি অন্য আরও ৩-৪টি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হই।’ পরবর্তীকালে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য পল্লবী নিজের সংস্থা ‘ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ডায়লগ ফাউন্ডেশন’ তৈরি করেন। 
আর পাঁচটা কাজের চাইতে এই কাজটা ঠিক কতটা চ্যালেঞ্জিং? পল্লবী জানান, ‘মানব পাচার— শব্দটাই মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়। তাছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ফান্ডিং অনেক কম এবং উদ্ধার হওয়ার পর সেই মানুষদের পুনর্বাসন বা নিয়মিত খোঁজ কেউ রাখতে চায় না। একবার পাচার হয়ে গেলে বিশেষ করে মেয়েদের, সামাজিকভাবে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়! নয়তো রেডলাইট জোনে ঢুকে পড়ে। একটা সময় আমি ভাবতাম শুধু ছোট মেয়ে ও মহিলাদেরই পাচার করা হয়। কিন্তু পুরুষও পাচার হয়,’ 
বলেন পল্লবী। 
একদিন হঠাৎ ফোন পেয়ে পল্লবী উত্তর ভারতের একটি গ্রামে যান। গিয়ে দেখেন বছর ৫৫-র এক মহিলা বসে আছেন। ‘আমাকে দেখেই ওই মহিলা আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন গ্রামের সবচেয়ে গরিব ছেলেটি ৩০ হাজার টাকায় গোরু আর ৩০ হাজার টাকায় জমি বিক্রি করে তাকে কিনেছে বিয়ে করবে বলে! যুবকটির বয়স মাত্র ২৪, এদিকে সেই মহিলার বছর ২৬-এর ছেলেও রয়েছে,’ বলছিলেন পল্লবী। সেসময় এই মহিলাকে উদ্ধার করতে গোটা গ্রামের আক্রোশের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। ‘গ্রামের কারও বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওই মহিলার বয়স ৫৫ বছর। গ্রামের লোকজনের দাবি, এত ছোটখাট চেহারার কারও এত বয়স হতেই পারে না। তাদের বোঝালাম অসম, পশ্চিমবঙ্গ এলাকার মেয়েরা খুব লম্বা হয় না। তাও লোকজন আমাদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। কিছুতেই তাদের গ্রামের বউকে আসতে দেবে না,’ জানান পল্লবী। অবশেষে তাঁরা প্রশাসনের সহায়তায় সেই মহিলাকে উদ্ধার করেছিলেন।
পল্লবীর ঝুলিতে এমন অজস্র কাহিনি। গল্পগুলোর মিল একটি জায়গায়। সেগুলো বড় বেদনা জাগায়।
মদের পয়সা জোগাড় করার জন্য জন্মদাতা বাবা ১৩ বছরের মেয়ে আয়েশাকে (নাম পরিবর্তিত) বিক্রি করে দেন। যে মহিলা তাকে কিনেছিল, তার ছেলেই কিশোরীটিকে যৌন নিপীড়ন করতে থাকে। মহিলা পরে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় ২৬ বছরের এক যুবকের সঙ্গে। সেখানে প্রতিদিন আয়েশাকে মারধর করা হতো। একটা সময় সে আর সহ্য করতে না পেয়ে বাড়ি থেকে পালায়। আবার একটি ছেলের খপ্পড়ে পড়ে আয়েশা। তাদের বিয়ে হয়, তখন সে ১৫ বছরের। তখনই প্রথম সন্তান। ১৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় সন্তান। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সে। এখানেও আয়েশাকে মারধর শুরু করে স্বামী। সেলাইয়ের কাজ করে সন্তানদের নিয়ে কোনওমতে দিনযাপন হচ্ছিল। স্বামী কাজ ছাড়তে বাধ্য করে। যৌন পেশায় নাম লেখায় আয়েশা। ৫ বছর এভাবেই কাটে। সেখান থেকে তাকে সেলাইয়ের কাজ দেওয়া হবে বলে পাঠানো হয় বিদেশে। নতুন করে বাঁচবে বলে বিদেশে পাড়ি দিলেও ৬ মাস সেই যৌন পেশাতেই রাখা হয় তাকে। সেখান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসে আয়েশা। শেষপর্যন্ত সন্তানদের জন্য ফের যৌন ব্যবসাতেই ফিরে যায় সে। শেষপর্যন্ত পল্লবী এবং তাঁর সহযোগীরা আয়েশাকে উদ্ধার করে। সন্তানদের পড়াশোনার জন্য আর্থিক সাহায্যও করে।
পল্লবীর কথায়, ‘মানব পাচারের ক্ষেত্রে বয়স একটা সংখ্যা মাত্র! উত্তর ভারতে ৫ বছরের নীচে বা ৮ বছরের মেয়েও মেয়েদের পাচার করা হয়। তারপর তাদের দেহে হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে দ্রুত শারীরিক পরির্বতন আনা হয়। ৮ বছরের মেয়েকে দেখলে মনে হবে সে যেন ১২-র কিশোরী। এদের পশ্চিম এশিয়ায় পাচার করা হয়। ইঞ্জেকশনের ফলে বিভিন্ন সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেক মেয়ের মৃত্যুও হয়। ৮ বছরের একটি মেয়েকে পুণে থেকে উদ্ধারের পর এইসব তথ্য আমাদের হাতে আসে। সেই মেয়েটিকেও ১২ বছরের কিশোরীর মতো বড় লাগছিল।’ 
এভাবেই এক, দুই, তিন করে পল্লবী ও তার সংস্থা অন্তত ১০ হাজার মানুষকে পাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করেন তাঁরা। জীবনের ঝুঁকিও থাকে। মানব পাচারের পিছনে রয়েছে বিশাল চক্র। যার সঙ্গে লড়াই করতে জনবল, মনোবলের পাশাপাশি চাই আর্থিক সহযোগিতাও। কারণ পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা বা সমাজে সাবলীল করে তোলার কাজটা বেশ কঠিন। পল্লবী বলেন, এই চক্রের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র শিক্ষা এবং সচেতনতা। সেদিকেও নজর রাখা তাঁদের কাজ। 
 
সুতপা গুহ
 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা