পক্ষে
সৌগত গোস্বামী, পূর্বতন অধ্যাপক
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়’— রঙ্গলাল বসুর এই উক্তিটি আজও প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতা ছাড়া বা পরাধীনতার মধ্যে কেউ বাঁচতে পারে না। বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর স্বাধীনতা প্রবন্ধে বলেছিলেন যে আমরা মূলত কেউই স্বাধীন নই। প্রতিদিন নিত্যনৈমিত্তিক কাজে যে সময় ব্যয় করতে হয়, তার মধ্যেই আমরা পরাধীন। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু স্বাধীনতা পেলেও তার মূল্য বোঝার জন্য পরিণত নই আমরা। তাই বৈচিত্র্যময় দেশেও আমরা এত বিভেদ, হানাহানি, রক্তপাতের পরিবেশ তৈরি করেছি। যেখানে ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সকলে একত্রে থাকার কথা সেখানে আমরা বিভিন্ন জাতির মধ্যে অশুভ সম্পর্ক তৈরি করেছি। সর্বধর্ম সমন্বয়ের মিলনতীর্থ এই ভারতে আমরা রক্তপাতের বীজ বপন করেছি। স্বাধীনতা পেয়েও আমরা পরিণত হতে পারিনি বা স্বাধীনতার মর্ম বুঝে উঠতে সক্ষম হইনি আজও।
অর্পিতা মালাকার, ছাত্রী
বীর যোদ্ধারা তাঁদের জীবনত্যাগ করে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আমরা কর্মসাধনার দিক থেকে মোটেও স্বাধীনতা লাভ করতে পারিনি। সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশে বাধা রয়েছে আজও। মানুষ নিজেদের স্বার্থে সবুজ ধরিত্রীর গুণাবলি ক্রমশ পরিবর্তন করছে। সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে ভুল তথ্য আমাদের সত্য থেকে কোটিক্রোশ দূরে নিয়ে গিয়ে নির্বোধ বোকা বাক্সে পরিণত করছে। আমরা ভেদাভেদের উৎসবে মেতে উঠেছি। বর্তমান সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে আমরা একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আনন্দিত হচ্ছি। এ কি পরিণত মস্তিষ্কের পরিচয়?
দীপ্তি রায়, ছাত্রী
আর দিন কয়েকের প্রতীক্ষা। আর একটি পনেরোই আগস্টের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আমরা। ৭৭ বছর আগে আজকের এই স্বাধীন ভারতকে দেখার জন্য বহু আন্দোলন, বহু তরতাজা প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছিল। আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। তার যেমন আমরা সুব্যবহার করছি, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার অপব্যবহারও। বিশেষত বাক্স্বাধীনতা, পোশাক এগুলোর অপব্যবহার চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে গোটা সমাজে। বর্তমান যুব সমাজের একটা বিরাট অংশই এই রোগে আক্রান্ত। আগামীদিনে তা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে। তাই এই স্বাধীন দেশের নাগরিক আর বর্তমান যুবসমাজের একজন প্রতিনিধি হয়েও আমার মনে হয় আমরা স্বাধীনতা পেলেও তার মূল্য বোঝার মতো পরিণত হইনি।
অনন্যা প্রামাণিক, ছাত্রী
শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতি— সব ক্ষেত্রেই রাজনীতি তার বিকট আঁচড়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে । কিন্তু গতানুগতিকভাবে অসহায়তার চোরাবালিতে মুখ গুঁজে আমাদের দেশ চরমভাবে উদাসীন। কোথাও কোনও গভীরতা নেই। না ভাবনায়, না প্রতিবাদে। হয়তো এভাবেই একদিন দেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার শতবর্ষ। তবু প্রতিদিনের যাপনে ভারতবাসীর যে নির্লিপ্ত মানসিকতা, তা প্রমাণ করে স্বাধীনতার মূল্য বোঝার মতো পরিণত নই আমরা। অলসতা, স্বার্থপরতা, লালসা নামক সামাজিক ব্যাধিগুলো আজও ভারতবাসীকে পেতে দেয়নি স্বাধীনতার সুখ।
বিপক্ষে
সান্ত্বনা ঘোষাল, শিক্ষিকা
স্বাধীনতা পেয়েছি ৭৭ বছর। স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে দেরি হলেও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এবং বিশেষ করে একজন নারী হিসেবে স্বাধীনতার মূল্য বোঝার মতো পরিণত হয়েছি বলেই মনে করি। পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে পেরেছি। আজ ভারতের বেশিরভাগ ঘরের মহিলা স্বনির্ভর। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি অথবা ছেলের বাড়ির আশ্রয়ের বাইরে গিয়ে নিজের বাড়ি চাইছে, মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য। পারছেও। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মূল্যবান মতামত রাখছে স্বতন্ত্রভাবে। একজন গৃহকার্যের সাহায্যকারীও তার মতামত রাখছে জনসমক্ষে। সমাজের সব স্তরের মানুষই স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে শিখেছে।
সৈয়দ সাদিক ইকবাল, রাজ্য সরকারি কর্মচারী
অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি। সবাই স্বাধীনতার মূল্য সঠিকভাবে বোঝেনি, তা নয়। প্রচুর মানুষ আছেন যারা স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পেরেছেন এবং সেই সঙ্গে পরিণত হয়েছেন। এখন মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে। মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বিচার বিভাগ সর্বদা সজাগ রয়েছে। সাধারণ মানুষ কখনও কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে বিচার বিভাগের শরণাপন্ন হন। সর্বোপরি সংবিধান মাথার উপরে আছে। আমাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। একইভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলার উপর ভরসা রাখতে হবে। দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
মৌমিতা নন্দী, শিক্ষিকা
আমরা স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝি না, এটা মানতে পারছি না। মেয়েদের কথাই বলব। মেয়েরা এখন আর্থিকভাবে অনেকটা স্বাধীন। নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেয়েছে। যে কোনও পেশা, তা সে সেনাবাহিনী, পুলিস বা ক্রিকেটার, তারা নিজের ইচ্ছেমতো গ্রহণ করতে পারছে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও মেয়েরা নিজেদের মতামত জানানোর স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সমাজ তথা পরিবার মেয়েদের বাক্স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাকে মেনে নিতে শিখছে ক্রমশ। তাই আমার মনে হয় আমরা স্বাধীন হয়েছি এবং স্বাধীনতার মূল্য বুঝতেও শিখেছি।
অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়, শিক্ষিকা
স্বাধীনতার মূল্য বুঝি বলেই তো মুখ বুজে অপমান-অন্যায় সহ্য না করে ছেড়ে এসেছিলাম সাজানো সংসার। স্বাধীনতার মূল্য জানি বলেই নিজের মেয়েকে মনের মতো করে বড় করতে চাওয়ার সাহস দেখাই। অভিভাবকত্বে স্বাক্ষর করি স্বমহিমায়। স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝেছিলাম বলেই কান্নাভেজা মুহূর্তের স্মৃতিকে ‘হা হা’ শব্দে ধুলোয় মিশিয়ে ইস্কুলে পড়াই, মেয়েদের মনে বুনে দিই স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। স্বাধীনতার মূল সুরটি চিনেছি বলেই মফস্সলি স্টেশনে বসে অবহেলায় ছেড়ে দিই একের পর এক ট্রেন। বাড়ি ফিরি মর্জিমাফিক। রাত জেগে সাধের ফাউন্টেন কলম দিয়ে আঁক কাটি পাতায়। স্বাধীনতার মূল্য বুঝেছি বলেই মনের কথাগুলো নিজেই বলে উঠি সোচ্চারে।