পক্ষে
দিলীপ কুমার পাত্র, শিক্ষক
নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। জলাভূমি, খাল, নদী ভরাট করার ফলে জলচক্রে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। প্লাস্টিক, আবর্জনা ইত্যাদি ফেলায় তা জলভাগের উপরে ভাসছে ফলে জল বাষ্প হয়ে উপরে যেতে পারে না। তলদেশে এগুলো জমা হওয়ার ফলে ভূগর্ভের জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে যেতে বাধা পাচ্ছে এবং জল সংরক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া কারখানার ও যানবাহনের ধোঁয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাসের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই শহরে এখন আর শীত পড়ে না।
পিয়ালী ঘোষ, গৃহবধূ
পৌষ-মাঘ নিয়ে শীতকাল। কিন্তু হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই আমরা শীতের আমেজে টের পেতে শুরু করি। বর্তমান এই কংক্রিটময় শহরে আর শীতের আগমনবার্তা অনুভূত হয় না। হয়তো এসবের পিছনে দায়ী শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ন, অহরহ বৃক্ষচ্ছেদন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কার্বনের আধিক্য ইত্যাদি। উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠান্ডা হল শীতের মৌলিক উপাদান, যা শেষ হতে বসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী শহুরে যান্ত্রিকতা। তাই শহরে দুটো মাস জুড়ে শীতকাল থাকলেও শীতের তীব্রতা থাকে না। ফলে শহরে শীতটা ঠিক পড়ে না!
চন্দ্রিকা গড়াই, শিক্ষিকা
যাঁরা পেশাগত প্রয়োজনে গ্রামীণ এলাকায় যাতায়াত করি, তাঁরাই পার্থক্যটা বেশ অনুভব করি। খোলা মাঠ, ধানখেত, পুকুর-দিঘিসমৃদ্ধ গ্রামাঞ্চলে কার্তিক-অগ্রহায়ণের ঠান্ডা যতটা অনুভূত হয়, শহরাঞ্চলে তার প্রায় কিছুই নেই। এখন গ্রামের দিকে মধ্যদিনের রোদ তুলনায় সহনশীল লাগে। সেখানে হেমন্ত ঋতুর বৈশিষ্ট্য বেশ স্পষ্ট, পাতাঝরা বিষণ্ণ বিকেল বেশ উপভোগ্য। ক্রমশ শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকবে। শহরে তাপমাত্রার এই ক্রমহ্রাসমানতা সেভাবে আর অনুভূত হয়ই না। এই ঠান্ডা-এই গরম করতে করতেই দিন গড়িয়ে যায়। তীব্র ঠান্ডার সময়ে কিছুদিন শীত যদিও বা উপভোগ করার মতো হয়, তাও দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। গ্রীষ্ম দরজায় কড়া নাড়ে।
শ্বেতা চ্যাটার্জি, ছাত্রী
ছোটবেলায় বড়দের মুখে একটা কথা শুনতাম যে মা দুর্গা জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের পরিবেশে ঠান্ডা অনুভূতি হয়। কিন্তু এখন তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। উল্টে কালীপুজোতেও আজকাল গরম অনুভূতি হয়। সেইভাবে হিমের পরশ লাগে না। শহরে শীত আসতে আসতে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হয়ে যায় । আর জাঁকিয়ে শীত পড়তে পড়তে জানুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সঙ্গে শীতের তাপমাত্রা কমতে থাকে। এটাই বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু সুদূর অতীতে ফিরে গেলে শীত পড়ত নভেম্বর থেকে আর থাকত মার্চ পর্যন্ত। মার্চেও ঠান্ডা অনুভূতি থাকত কিছুদিন। এই আবহাওয়ার রদবদলের পিছনে জলবায়ুর দ্রুত হারে পরিবর্তনই মূল দায়ী।
বিপক্ষে
দিব্যজ্যোতি চক্রবর্তী, কলেজ ছাত্র
কলকাতায় শীত পড়ে না— এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। শীতের তীব্রতা হয়তো কমেছে, কিন্তু শীতের স্পর্শ এখনও কলকাতার প্রাকৃতিক ঋতুচক্রে অনুভূত হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ঠান্ডা বাতাসে ভোরের কুয়াশা, রোদ-ঝলমলে দুপুর, আর সন্ধ্যার ঠান্ডা অনুভূতি কলকাতার শীতের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। শহরের পুরনো বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাওয়া বা বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া শীতের সময়েই বেশি উপভোগ্য। যদিও গাছপালা কমে যাওয়া ও দূষণের ফলে শীতের প্রকোপ কিছুটা কমেছে, তবুও ভিড়ের শহরেও সকালের কুয়াশা আর রাতে শীতল বাতাস কলকাতার শীতের উপস্থিতি জানান দেয়। তাই বলাই যায়, কলকাতায় শীত পড়ে, শুধু আমাদের অনুভবের অভাব হারিয়ে গিয়েছে বলে বুঝতে পারছি না।
মিতালী আঢ্য, গৃহবধূ
শহরের ফুটপাতে আকাশের নীচে যাঁদের শয্যা পাততে হয়, তাঁদের ছেড়া নকশিকাঁথা শীতের গল্প বলে। হিম হিম ঠান্ডা বাতাসে যে পথকুকুরগুলো একটু উষ্ণতার জন্য কাতর হয়ে পড়ে, তাদের চোখ শীতের কথা জানে। সড়কের পাশে শীতের রাতে যে কুলি-মুটের দল শরীর একটা মোটা আবরণে জড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতার পরশ পাওয়ার চেষ্টায় থাকেন, তাঁদের জেগে থাকা রাত শীতের গল্প বলে। শহরের অট্টালিকার অলিগলি বেয়ে সবুজ খামে হলুদ গাঁদার খবর নিয়ে বাড়ির ছাদে কিংবা ফ্ল্যাটবাড়ির ঝুলবারান্দায় যে শীত আসে, তার গল্পগুলো অবশ্য অন্যরকম। ক্রিশমাস ও বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে তার সেলিব্রেশন। দোকানে শীত-পোশাকের বিকিকিনি, মেলায় গ্ৰাম্য পিঠেপুলির স্বাদ। এককথায় শীতকাল যাপন। শহুরে শীত উৎসবের আলো-ঝলমল রাস্তায় হাঁটে।
সায়ন তালুকদার, ছাত্র
শহুরে বাঙালি শীত ভীষণ ভালোবাসে। তবে তা একেবারেই হাড়হিম করা, জবুথবু, ঠকঠক করে কাঁপা শীত নয় যে লেপ, কম্বলের তলায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে হবে। গ্রাম্য পরিবেশ এবং শহরের পরিবেশের মধ্যে স্বভাবতই ফারাক রয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে বা শহরতলিতে যে শীত পড়ে, শহরে সে শীতের দেখা মেলা ভার। কলকাতার শীতকে উপভোগ করতে বাঙালি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ইতিউতি। কমলালেবুর কোয়ার মতো নরম রোদ গায়ে মাখতে মাখতে পাতাঝরার মরশুমের ভরপুর আমেজ উপভোগ করে। উত্তুরে হাওয়া ইতিমধ্যেই বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। হা হুতাশ করা কিছু মানুষের স্বভাব, তা থাকবে। শীতও পড়বে শহরে।