দেশের প্রান্তিক ও প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার নীচে এনে তাদের উন্নয়নের পথ আরও প্রশস্ত করাই লক্ষ্য টাটা স্টিল ফাউন্ডেশন-এর। গত নভেম্বরে পাঁচ দিন ব্যাপী ছিল তারই উদযাপন।
জামশেদপুর গোপাল ময়দান। রুখাশুখা, কারখানাময় শহরটির প্রাণকেন্দ্র। গোটা বছরই নানা উৎসবের আবহে সেজে ওঠে এই বিস্তৃত মাঠ। হেমন্ত তখন জাঁকিয়ে বসেছে ক্যালেন্ডারে। জামশেদপুরের হাওয়ায় হাল্কা শিশিরের টান। এমন সময়ে এই ময়দান ঝলমলিয়ে উঠল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা আদিবাসীদের সমাগমে। সৌজন্যে টাটা স্টিল ফাউন্ডেশন (টিএসএফ)। প্রতি বছর আদিবাসী নেতা বিরসা মুণ্ডার জন্মবার্ষিকীতে ‘সংবাদ মেলা’-র আয়োজন করে এই সংস্থা। এবছর তারই ১১তম সংস্করণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রায় ২৫০০ জন আদিবাসী সদস্য হাজির হয়েছিলেন এই উৎসবে। নভেম্বরের এই উৎসব ছিল নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। টানা পাঁচদিন ধরে চলে রান্না, হস্তশিল্প, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ের কর্মশালা। সমাজে আদিবাসী গোষ্ঠীদের গুণ ও শিল্পকলা তুলে ধরা এবং ব্যবসায়িক কাজে তাঁদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলাই লক্ষ্য টিএসএফ-এর। কর্মশালায় উঠে এল তেমনই ‘টিপস’!
গোপাল ময়দানের গোটা বাউন্ডারি চত্বর সেজে উঠেছিল দেশের প্রায় সবক’টি রাজ্যের মোট ২৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিল্পকলায়। মোট ১১৭ জন শিল্পী তুলে ধরেন নিজেদের আর্টফর্ম। তাতে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া আদিবাসী কিশোর-কিশোরী থেকে পুরোদস্তুর পেশাদার শিল্পীরাও ছিলেন। নানারকম আচার থেকে শুরু করে ব্যাগ, পোশাক, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, জুয়েলারি, স্টোল, ঘর সাজানোর দ্রব্য কী ছিল না তাতে! কেনাকাটাও চলল দেদার! পায়ে পায়ে এগলেই এবার শুরু বিভিন্ন খাবারের স্টল। আদিবাসী জনগোষ্ঠীতে প্রচলিত ও জনপ্রিয় প্রায় শতাধিক খাবার হাজির সেখানে। বাঁশপোড়া মাছ, স্থানীয় মাছের পুর ঠাসা মোমো, কাঠের জ্বালে প্রস্তুত কাবাব, সব্জির বিভিন্ন স্ন্যাক্স— তালিকা বেশ লম্বা। মেলা দেখার পাশে খিদে পেলেও কুছ পরোয়া নেই! সেখান থেকে খানিক হেঁটে গেলেই ‘আতিথ্য জোন’। আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যেই অভিজ্ঞ কয়েকজন রন্ধনবিদ সেখানে একত্র হয়েছেন ‘ফিউশন ফুড’ নিয়ে। নানা ভেষজ গাছপালা প্রচলিত খাবারে যোগ করে স্বাদে চমক আনলেন তাঁরা।
কেবল খাওয়াদাওয়াই নয়, রোগমুক্তির কথাও ভেবেছে টিএসএফ। ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেষজ উপাদানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে ভারতের প্রাচীন অধিবাসীদের জ্ঞানগম্যিও অনেক বেশি। তাঁরা প্রাকৃতিক নানাবিধ উপকরণ দিয়ে লড়াই করেন আদিব্যধি, অসুখের সঙ্গে। সেসব উপাদান নিয়েই আসর সাজিয়েছিলেন ‘ট্রাইবাল হিলারস’। বিভিন্ন গাছের শিকড়, মূল, পাতা, ফুল, রস সংগ্রহ করে তাঁরা নিরন্তর তৈরি করে চলেন নানা ওষুধ। নানারকমের ব্যথা-বেদনা, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস সবকিছুরই ভেষজ সমাধান মিলছিল ময়দানের ৩১টি স্টলে। মাঝমাঠে তখন চলছে আদিবাসী নৃত্য! কখনও বা মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন রাজু সোরেনের নেতৃত্বে খাসি ব্যান্ড ও সাঁওতালি অর্কেস্ট্রা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিল নাগা পল্লিগীতি, হাজং, রাভা, বাইগা, নেইগি ইত্যাদি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে ‘সাউন্ডস অব ঝাড়খণ্ড’, নীতেশ কাছপের নেতৃত্বে নাগপুরী মিউজিক ব্যান্ডের হৃদয়হরণ লাইভ কনসার্ট ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, লাদাখের এক ব্যান্ড ‘দ্য সাগস’-এর সহযোগিতায় ৭৫ জন আদিবাসী শিল্পীকে নিয়ে তৈরি হতে চলেছে আদিবাসী শিল্পীদের দ্বিতীয় অ্যালবাম!
চারদিন ধরে জামশেদপুর শহরের নানা প্রান্তে, সুবর্ণরেখার ধার ঘেঁষে তৈরি হওয়া নানা অস্থায়ী ক্যাম্পে চলল বিভিন্ন বিষয়ের কর্মশালা। স্বনির্ভরতার পথে ভারতের প্রাচীন জনগোষ্ঠীরা যাতে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন। হস্তশিল্পী, রন্ধনশিল্পী ও ভেষজ চিকিৎসায় দক্ষরা যাতে ব্যবসায়িক দিক থেকেও নানা উন্নতি করতে পারেন এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য আদানপ্রদান করতে পারেন তাই ছিল ‘সংবাদ ২০২৪’-এর লক্ষ্য।
এই প্রসঙ্গে টিএসএফ-এর সিইও সৌরভ রায় জানিয়েছেন, ‘আদিবাসী গোষ্ঠীদের একত্র করতে ও তাঁদের কাজ গোটা দেশের কাছে পৌঁছে দিতেই আমাদের এই উদ্যোগ। আর্থিক সাহায্য দিয়ে নয়, বরং পরিকল্পনা, বুদ্ধি ও বাজারে টিকে থাকার পদ্ধতি আদিবাসীদের শিখিয়ে উন্নয়নের পথে শামিল করতে চাই আমরা।’ সৌরভের কথার সূত্র ধরেই টাটা স্টিল, কর্পোরেট সার্ভিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট চাণক্য চৌধুরী জানান, ‘দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও তাঁদের কাজের পরিসর আরও বাড়িয়ে তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য। দেশে প্রায় ৭০৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আছে, তাঁদের মধ্যে ২৫৩টি জাতিগোষ্ঠীকে আমরা এক ছাতার নীচে আনতে পেরেছি। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টা জারি থাকবে।’
মনীষা মুখোপাধ্যায়