উফ!’ ঘুমের মধ্যে কঁকিয়ে উঠল হেড অফিসের বড়বাবু জগদ্বন্ধু। সেই চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল গীতার। ‘আ মোলো যাঃ! এই বয়সে ঘুমের মধ্যে কী এমন স্বপ্ন দেখলে যে কঁকিয়ে উঠছ?’
‘স্বপ্ন দেখব কেন, তোমার ফাটা গোড়ালি যেন কোদালের মতো হয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে নড়লেই আমার পা ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে।’
‘হবেই তো, পা ফাটবে না! কৃপণের বউয়ের শুধু পা কেন, মাথাও ফাটবে। কবে থেকে বলছি, একটু বডি লোশন, কোল্ড ক্রিম, পেট্রোলিয়াম জেলি জাতীয় কিছু এনে দাও, এনেছ?’
জগদ্বন্ধু চুপ করে পড়ে থাকে, সাড়া দেয় না। সাড়া দিলেই তর্কাতর্কি, আর তাতেই ঘুম একেবারে চটকে চ!
‘ব্যস, টাকা খসবে শুনে অমনি চোখজুড়ে ঘুম নেমে এল, কৃপণের হদ্দ!’ বলেই পাশ ফিরে শুল গীতা।
পরদিন সকালে একটা লিস্ট জগদ্বন্ধুর হাতে ধরাল সে। তাতে লেখা মধু, কেওড়া জল, গোলাপ জল, গ্লিসারিন, নিমপাতা, ঘৃতকুমারী, জাত্যাদি তেল, মারুলা তেল ইত্যাদি। বড় ফর্দটা পড়ে জগদ্বন্ধুর অবস্থা দিশাহীন। সে বলল, ‘এসব দিয়ে কী রান্না করতে চাইছ, সেটাই বোধগম্য হল না।’ গীতা বলল, ‘কিছুই রান্না করব না। এটা শীতের ত্বক চর্চার ফর্দ। ফাটা পায়ে নুনের ছিটে যখন দিয়েছ, তখন তোমাকেই এর বিহিত করতে হবে। নইলে রোজ ফাটা পায়ের খোঁচা খেয়ে ঘুমের দফারফা হবে।’
‘এগুলো পায়ে মাখবে?’ জগদ্বন্ধুর দম আটকে যাওয়ার অবস্থা! গীতা বলল, ‘অমনি কণ্ঠনালি শুকিয়ে গেল। আচ্ছা কৃপণের পাল্লায় পড়া গেল! বিয়ের পর তো বলতে, তুমি আমার যোগিতা বালি। আর এখন হয়েছি তোমার চোখের বালি, তাই তো? কিচ্ছু আনতে হবে না। আমি জানতাম। কিন্তু রাতে আর ন্যাওটা বেড়ালের মতো ক্যাঁই কুঁই করতে পারবে না। ফাটার খোঁচা সইতে হবে, এই বলে দিলুম।’
আমার টাকা খসানোটা গীতার কাছে সবসময় একটা চ্যালেঞ্জের মতো। ছুতোয় নাতায় আমার মিতব্যয়ী ব্রতকে ভঙ্গ করার জন্য গীতা একেবারে নাছোড়বান্দা। সেদিন সন্ধ্যায় বলল, ‘নতুন বছর আসছে। বাড়িতে কেক বানাব, তার ব্যবস্থা
করতে হবে।’
জগদ্বন্ধু বলল, ‘আবার কেক?’
‘আবার কেক মানে? কেন গত বছর খারাপ হয়েছিল নাকি? বেশ তো সাঁটালে, অফিস কলিগদের জন্য নিয়ে গেলে। পরে বিন্ধ্যবদন আমাকে বলেছিল, বউদি কী সুন্দর কেক, আপনি বানিয়েছেন, অসাম!’
‘ওই অসমই হোক বা ত্রিপুরা, এবার আর তোমাকে কষ্ট করে কেক বানাতে দেব না। বরং আমার একটা প্ল্যান আছে। ইংরেজি নতুন বছরে আমরা পাহাড়চূড়ায় গিয়ে কেক কাটব।’
‘তার মানে?’
‘মানে বেড়াতে যাব।’
‘তোমার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া? হানিমুনে নামখানায় নিয়ে গিয়ে বলেছিলে, আহা কী বিশাল নীল সমুদ্র জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না, মনে আছে? তারপর দু’বার তারকেশ্বর, একবার কামারপুকুর আর দু’বার কালীঘাট। বেড়ানোর কথা বললেই শ্রীনগর দিয়ে আলোচনা শুরু করে হিসেব কষতে কষতে কৃষ্ণনগরে যাওয়ার কথা বলবে। আর জয়পুর দিয়ে শুরু করে জয়নগরে গিয়ে শেষ করবে। কিংবা দক্ষিণ ভারত দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ডেস্টিনেশন হয়ে উঠবে দক্ষিণেশ্বর।’
জগদ্বন্ধু হাসতে হাসতে বলে, ‘মানে পিলগ্রিম সার্কিটটা শেষ করতে চাই। ভাবলাম পয়লা জানুয়ারিটা তারামায়ের আশীর্বাদ নিতে যাব। তুমি শুধু সিমলা, আরাকু, লাচুং যাওয়ার বায়না ধরবে। শোনো জীবনে কিছু ফর্মুলা মেনে চলতে হয়। যেমন ধরো, বেড়ানোটা শাস্ত্রে বলেছে, ভ্রমণং করনং গচ্ছামি। অর্থাৎ কিনা ভ্রমণ করাটাই হল গাঁটগচ্ছা।’
‘এত আলগা গাঁট থাকলে বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন? বিয়ের পর একবার বলেছিলে চলো, বেরিয়ে আসি। আমি তো আনন্দে লাগেজ গোছালাম। বারবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাব গো? তুমি হাসতে হাসতে বলেছিলেন সারপ্রাইজ। ও বাবা, উনি আমাকে শেষ পর্যন্ত কাটোয়া লোকালে চাপিয়ে ধাত্রীগ্রামে আমার বাপের বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমারই তখন হে ধরিত্রী দ্বিধা হও বলার মতো অবস্থা।’
‘বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি, এই দুটো হল মেয়েদের সবথেকে বড় তীর্থস্থান। তাই কি না বল?’
‘এসব হল কঞ্জুসদের জীবনদর্শন। আমাকে সেই দলে ভেড়াবে না। বেশ, তারাপীঠ যদি যেতেই হয়, তবে শান্তিনিকেতন হয়ে ফিরব। মোট পাঁচদিনের ট্যুর। রাজি?’
জগদ্বন্ধুর ফেঁসে গিয়ে অন্য পথ দেখার চেষ্টা করে। বলে, ‘অতদিনের ছুটি পাই কি না দেখি।’
অন্যবারের মতো বড় বড় আলোচনা যেমন ফুসকুড়িতে শেষ হয়। এবারও তেমনই হল। জগদ্বন্ধু গীতাকে রাজি করাল, পয়লা জানুয়ারি পার্ক স্ট্রিটে যাবে। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনে দুপুরের সোনালি রোদ গায়ে মেখে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরতেই খিদে পেয়ে গেল। গীতা বলল, ‘চলো কিছু একটা খাই।’
জগদ্বন্ধু বলল, ‘ওদিকে একটা ক্লাব টেন্ট আছে, খুব ভালো টোস্ট আর চিকেন স্টু বানায়, খাবে?’
‘ওইসব আলুকাবলি, ছোলাভাজা দিয়ে আমাকে ভোলাতে পারবে না। চলো কোনও হোটেলে অন্য কিছু খাওয়াবে।’
জগদ্বন্ধু রাজি হল বটে, তবে শেষ পর্যন্ত সে একটা গভীর স্বস্তি লাভ করল। সব বড় হোটেলেই খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন। গীতা বলল, ‘চলো, একবার পার্ক স্ট্রিটটা চক্কর দিয়ে ধর্মতলায় কোনও একটা হোটেলে গিয়ে বিরিয়ানি খাব। না করতে পারবে না। বেড়াতে না গিয়ে তোমার অনেক পয়সা বাঁচিয়ে দিয়েছি।’ জগদ্বন্ধু সেকথা শুনে হে হে করে হাসল।
পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় বিশাল ভিড়। পয়লা জানুয়ারিকে সবাই যেন খপাৎ করে ধরতে চায়। একটি মেয়ে হঠাৎ রাস্তার উপর নাচ জুড়ে দিল। তারপর জগদ্বন্ধুকে দিল এক ধাক্কা। ওদিকে মেয়েটার নাচের ছবি তোলা ছেলেটা বলল, ‘কাকু একটু সরে যাবেন তো, এখানে একটা রিলের শ্যুটিং হচ্ছে। জগদ্বন্ধু বলল, ‘যৌবনকালে সিনেমায় গিয়ে তেরো রিল, চোদ্দো রিলের ছবি দেখতাম, এখন তো মোবাইল খুললেই লক্ষ লক্ষ রিলের ছবি দেখতে হয়। কী ভয়াবহ অবস্থা!’
রিলেন্টলেস রিল! রাস্তায় স্রোত দেখে মনে হল ‘স্ট্রিম অব লুনাসি’। জগদ্বন্ধু বলল, ‘চলো, দম বেরিয়ে আসছে। ধর্মতলায় গিয়ে কিছু খেয়ে বাড়ি যাই।’
ধর্মতলায় এগতে গিয়ে চমকে উঠল জগদ্বন্ধু। গীতা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
‘পকেটমারি হয়ে গেছে। পার্ক স্ট্রিটের ভিড়ে কেউ পকেট থেকে পার্সটা তুলে নিয়েছে।’
রাস্তার একপাশে গিয়ে দাঁড়াল জগদ্বন্ধু। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। চোখটা ছলছল করছে। পিঠে হাত রাখল গীতা।
জগদ্বন্ধু বলল, ‘বিশ্বাস করো, আজ সত্যিই ভেবেছিলাম বছরের প্রথম দিনে দু’জনে খুব আনন্দ করব। তোমায় কিছু গিফট করব।’ গীতা দেখল রঙিন ফ্লুরোসেন্টের আলোয় জগদ্বন্ধুর চোখের জলটা চিকচিক করছে।
গীতা বলল, ‘মন খারাপ কোরো না।’
জগদ্বন্ধু বলল, এটা বোধহয় আমার কার্পণ্যের সাজা। এই তো এতগুলো টাকা চলে গেল, কোনও কাজে লাগল না। বছরের প্রথম দিনে এটাই হবে আমার রেজোলিউশন, আর কার্পণ্য করব না। তোমার সঙ্গে বাকি জীবনটা খুব আনন্দে কাটাব। চলো সামনের মাসেই আমরা কোথাও ঘুরে আসি।’
গীতার চোখও ছলছল করে উঠল। বলল, ‘বেনারস যাবে?’
জগদ্বন্ধু বলল, ‘চলো। কিন্তু ফের পিলগ্রিম সার্কিট ট্যুর বলবে না তো?’
গীতা বলল, ‘একদম না।’
চারিদিকে জনতার স্রোত আর নতুন বছরের আনন্দের মধ্যে জগদ্বন্ধু আর গীতা হেঁটে
গেল হাত ধরাধরি করে। নতুন বছরের সেই
আনন্দ সংকল্পে ফ্লুরোসেন্টের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সন্দীপন বিশ্বাস
অঙ্কন: সুব্রত মাজী অলঙ্করণ: সুমনকুমার সিংহ