মানহানির মামলা হলে তার ফলাফল কী হতে পারে? আলোচনা করলেন আলিপুর পুলিস ও জাজেস কোর্ট, কাকদ্বীপ কোর্টের আইনজীবী ঋজু চক্রবর্তী।
পাশাপাশি দুই বাড়ি। আসলে একই বাড়ির দুই অংশ? একচিলতে পাঁচিলের আড়াল আছে। এবাড়ির মেজকত্তা, ও বাড়ির ছোটকত্তার মধ্যে মুখ দেখাদেখি প্রায় নেই। কিন্তু দিনরাত একে অপরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছেন। সবটাই মুখেন মারিতং জগৎ। সেই মামলা আজ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়নি ঠিকই। তবে মুখে মুখে কতবার যে মানহানির মামলা ঠুকে খুশি হয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
এই বাড়ি, এই চরিত্ররা কলকাতার আজন্মের চেনা। ‘মানহানি’ শব্দটাও আভিধানিক অর্থে চেনা বইকি। কিন্তু মানহানির মামলা কী? কথায় কথায় বলে দিলেই তো হল না। সত্যিই এই মামলা কে, কখন করতে পারেন? আইনজীবী মিন্টু চক্রবর্তী (ঋজু) জানালেন, মানহানির মামলা বিষয়টা খানিক জটিল। কেউ কাউকে অপমান করছে মনে হলেও আসলে বিষয়টা অত সহজ নয়। নতুন আইন অনুযায়ী ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩-এ আন্ডার সেকশন ৩৫৬ সাবসেকশন ১-এ সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে। যদি কোনও ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং বিশ্বাসের সঙ্গে কারও বিরুদ্ধে অপমানজনক কথা বলে, লিখে, দৃশ্যর মাধ্যমে বা কোনও সংকেতের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তির চরিত্র লঙ্ঘন করে, অথবা সামাজিক সম্মান হানি করে, তখন মানহানি হয়। অর্থাৎ আপনার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা হচ্ছে মানেই সেটা মানহানিকর, তা নয়। দেখতে হবে সেই কথা কোথাও আপনার মর্যাদা সত্যিই ক্ষুণ্ণ করছে কি না, অথবা মানসম্মানের ক্ষতি হচ্ছে কি না। সেই বক্তব্যের মাধ্যমে আপনার বা আপনার পরিবারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে সেটাও মানহানির আওতায় পড়বে।
মানহানি কী করে হয়? ঋজু বলেন, ‘ভারতীয় আইন অনুযায়ী ‘মান সম্মান’ সম্পত্তি হিসেবে দেখা হয়। মানহানির মামলা দু’ভাবে করা যায়। দেওয়ানি মামলা (সিভিল) এবং ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) মামলা। ভারতীয় আইন ‘সম্মান’কে সম্পত্তি হিসেবে দেখে বলেই এটা দেওয়ানি মামলার অধীনেও পড়ে। যেখানে ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়।’ অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানিকর কথা কোনও প্রসঙ্গে বলা হলে, ওই ব্যক্তির কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা দেখা হয়। সেই অনুযায়ী যিনি এখানে ভুক্তভোগী, তিনি মামলা করতে পারেন এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। আদালত বিচার করে দেখবে, সত্যিই উনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য কি না, তাহলে সেই অনুযায়ী রায় দেবে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ঋজু দেখেছেন, ভারতীয় আইন ব্যবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে মানহানির মামলা করার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। কতদিনের মধ্যে মানহানির মামলা দায়ের করা হবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়সীমা কেমন? আইনজীবী জানালেন, যে সময় থেকে মানহানি হয়েছে বলে মনে করা হল, সেই সময় থেকে এক বছরের মধ্যে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হবে। আর ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এই সময়টা মানহানির সময় থেকে তিন বছরের মধ্যে করা যাবে।
দেওয়ানি মামলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। অন্যদিকে ফৌজদারি মামলায় শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে ঋজু বলেন, ‘১৯৯৮ সালে সমাজসেবক আন্না হাজারে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মহারাষ্ট্রের এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিজের মত জানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ওঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মানহানির মামলা করা হয়। আদালতে তা প্রমাণও হয়ে যায়। শাস্তিস্বরূপ দু’মাস হাজতবাস করেন আন্না। ফৌজদারি মামলায় সর্বোচ্চ সাজা দু’বছর। অথবা জরিমানা। উভয়ও হতে পারে। ফৌজদারি মানহানি মামলাটি জামিনযোগ্য। আদালতের বাইরে দু’পক্ষের সম্মতিতেও মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’
মানহানির মামলার সংজ্ঞা পুরনো এবং নতুন আইন অনুযায়ী একই রয়েছে। কিন্তু তফসিলি জাতি এবং উপজাতির কোনও মানুষকে যদি লেখা, সংকেত বা দৃশ্যের মাধ্যমে মানহানি করা হয়, তাহলে এসসি এসটি অ্যাক্ট অনুযায়ী সেকশন থ্রি-তে বলা আছে, অভিযোগ প্রমাণ হলে তার সর্বোচ্চ সাজা হবে পাঁচ বছরের এবং তা জামিন অযোগ্য।
ঋজু জানালেন, কথায় কথায় মানহানির মামলা করা, সেই অভিযোগ প্রমাণ করা সহজ নয়। এর কারণ আইনের লিখিত সংজ্ঞায় লুকিয়ে রয়েছে। ‘আইনে মানহানি মামলার ছ’টা ব্যাখ্যা রয়েছে। সেখানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে মানহানি হতে পারে। আর ১০টি ব্যতিক্রম রয়েছ। অর্থাৎ কোন কোন ঘটনা ঘটলেও তা মানহানির আওতায় আসবে না’, বলেন ঋজু। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, কোনও মৃত ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলা হলে তার পরিবারের মানসম্মানে আঘাত ঘটালে তার পরিবার মানহানির মামলা করতে পারে। ঠিক যেমন আমির খানের ‘মঙ্গল পাণ্ডে’ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর প্রযোজনা সংস্থার বিরুদ্ধে মঙ্গল পাণ্ডের পরিবার মানহানির মামলা করেছিল। পরবর্তীকালে ওই সিনেমা থেকে কিছু দৃশ্য বাদও দেওয়া হয়। কারণ সিনেমায় দেখানো হয়েছিল মঙ্গল পাণ্ডে মদ্যপান করেন, পতিতালয়ে যান। মৃত ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়েছিল, যাতে তাঁর পরিবারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। মানহানির মামলা করেছিলেন মঙ্গল পাণ্ডের পরিবারের সদস্যরা।
শুধু ব্যক্তি নয়, সংস্থাও মানহানির মামলা করতে পারে। ধরা যাক কোনও কোম্পানির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন কথা বলা হল, যাতে আর্থিক ক্ষতি এবং ব্যবসার ক্ষতি হল। এক্ষেত্রেও মানহানির মামলা হতে পারে।
স্বরলিপি ভট্টাচার্য