আমরা মেয়েরা

বিপ্লবীর বউ 

দিন কয়েক পরেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আসমান-জমিন ঢাকা পড়বে জাতীয়তাবাদী স্লোগান, গান ও কবিতায়। শহিদবরণ ও শহিদস্মরণে কাটবে একটা গোটা দিন। উদযাপিত হবে ব্রিটিশমুক্তির ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসে শহিদদের বউদের কথাও আমরা রাখব তো? আজ তেমনই এক তরুণীর কথা।

বিয়ের রাত। পুরোহিত বরকে প্রস্তুত করে বিবাহবাসরে নিয়ে আসতে বলেছেন। কনেপক্ষের লোকজন বরকে নিয়েও এসেছেন বিবাহবাসরে। চলছে বিয়ের মন্ত্র পড়া। হঠাৎই বরের হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিল একজন। বধূবেশে পুষ্পকুন্তলা আড়চোখে দেখছেন স্বামীর মুখ। ছেলেটি মুর্শিদাবাদের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফিরেছেন। একটি স্কুলে পড়াতে ঢুকেছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর ছিল না। বিএ পাশ করার আগেই পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে এসেছিলেন নোয়াপাড়ার বাসিন্দা পুষ্পকুন্তলার বাবা। ছেলেটির উচ্চশিক্ষার যাবতীয় খরচ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বহন করার ভার নিয়েছিলেন তিনি। শুধু শর্ত একটিই। নিজের মেয়ে পুষ্পর সঙ্গে ছেলেটির বিয়ে দিতে হবে। শিক্ষিত সজ্জন ছেলেটিকে দেখে নিজের জামাই করার ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর। পাত্রপক্ষও এককথায় রাজি। তাই পাশ করে গ্রামে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আত্মীয়রা পুষ্পকুন্তলার সঙ্গে ছেলেটির বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেললেন। ততদিনে স্কুলে পড়ানোর সুবাদে পাড়ার সকলে ছেলেটিকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকে। 
আজ সেই বিয়েরই রাত। বরবেশে সূর্যর কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। দিনকয়েক আগে এই ভয়টাই পেয়েছিলেন। আলাদা করে দেখা করেছিলেন ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে। নিজের অবস্থান জানালেও শ্বশুরমশাই জানতেন মেয়ের মনের কথা। পুষ্প যে মানসিকভাবে প্রস্তুত সূর্যকেই বিয়ে করতে। তাই বিয়ে ভাঙলেন না। কৃতজ্ঞতাবশত এই বিয়েতে রাজি না হয়ে আর উপায়ও ছিল না সূর্যর। চিরকুটটা হাতে নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন মাস্টারদা। দলের উচ্চমহল থেকে ‘অর্ডার’ এসেছে। দিনকয়েকের মধ্যে ডাক আসবে। তৈরি থাকতে নির্দেশ দেওয়া আছে সেই চিরকুটে। দু’দিন পরে এল সেই মহার্ঘ নির্দেশ। ফুলশয্যার রাত। মাস্টারদার জন্য অপেক্ষায় পুষ্পকুন্তলা। সেইদিনই দলের গুরুতর কাজে ডাক পড়েছে তাঁর। নির্জন কক্ষে স্ত্রী পুষ্পর কাছে গেলেন মাস্টারদা। বললেন, ‘তোমার কাছে আমার অপরাধের সীমা নেই। তুমি আমার অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তুমি আমার স্ত্রীই থাকবে। কিন্তু দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার ডাক এসেছে। তোমার কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে।’ স্ত্রী পুষ্প ততদিনে জেনে গিয়েছেন তাঁর মনের মানুষটি শুধুই আর স্কুলে পড়ানোয় আটকে নেই। ছলছলে চোখে নববধূ জানতে চাইলেন একটিমাত্র কথা। ‘চিঠি পাব তো?’
আজীবন সেই কথা রেখেছিলেন মাস্টারদা। স্ত্রীর আত্মত্যাগ তিনি মিথ্যে হতে দেননি। দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, খুব সন্তর্পণে একটি চিঠি ঠিকই পৌঁছে যেত নোয়াপাড়ার বাড়িতে। ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন ও দেশের স্বাধীনতা সেখানে মিলেমিশে লুটোপুটি খেত। চিঠি শুরু হতো, ‘স্নেহের পুষ্প’ দিয়ে।  আর শেষ হতো, ‘তোমারই সূর্য’ লিখে।
সাল ১৯৩১। বাংলার দৈনিকে একটি খবরের দিকে চোখ গেল পুষ্পর। খবর নয়, বলা ভালো একটা ঘোষণা। ব্রিটিশ সরকার একটি আবেদন করেছে। যার শিরোনাম: ‘সূর্য সেনকে ধরিয়া দিতে পারিলে দশ হাজার টাকার পুরস্কার।’ পরে বিস্তারিত লেখা, ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়, সেই দলের বিপ্লবী দলের নেতা সূর্য সেনকে যে ধরে দিতে পারবে, বা তাঁর খবর এনে দিতে পারবে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ছ্যাঁত করে উঠল পুষ্পর মন। স্বামীর চিন্তায় প্রহর গুনতে গুনতে অপেক্ষা শুরু করলেন তিনি। তখনও চিঠি আসে গোপনে। পাল্টা চিঠি দিয়ে খবর জানার চেষ্টাও করেন। কিন্তু নিজের খবর দেওয়ার চেয়ে পুষ্পর খবর নিতেই মাস্টারদা অধিক উৎসাহী। শুধু চিন্তা করতে বারণ করেন স্নেহের পুষ্পকে। 
আজীবন মাস্টারদার জন্য অপেক্ষা করেছেন পুষ্পকুন্তলা। চিন্তাও করেছেন। দেখাও হয়েছিল ওঁদের। দিনটা ১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। জেলে খবর গিয়েছে স্ত্রী পুষ্প শেষশয্যায়। নিউমোনিয়ায় ভুগে ও স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে পুষ্প। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলায় জেলে অত্যাচারিত হতে হতে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে এলেন স্ত্রীর কাছে, তাঁকে দেখতে। বাড়ি থেকে সূর্য যখন আর কয়েক মিটার দূরে, তখনই শেষ শ্বাস ত্যাগ করলেন পুষ্প। মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর দেখা হল ঠিকই, তবে তখন একজন মৃতপ্রায় ও অন্যজন মৃত!
দেশের জন্য মাস্টারদার আত্মত্যাগ, পালিয়ে বেড়ানো, বিপ্লবস্পন্দিত স্পর্ধাকে ভারত ভোলেনি। কিন্তু গৈরালা গ্রাম থেকে যখন নেত্র সেনের বিশ্বাসঘাতকতার ফসল হিসেবে গোরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন তিনি, তাঁর মনেও কি একটিবারের জন্য ভেসে ওঠেনি পুষ্পর মুখ!
বোধহয় উঠেছিল। বোঝা গেল স্ত্রীর মৃত্যুর প্রায় দু’বছর পর। ১৯৩৪-এ যখন তাঁর সব নখ-দাঁত উপড়ে ফেলেছে ইংরেজ, সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা, সেই অর্ধমৃত দেহেই দৃপ্ত ও জেদি সূর্য উঠলেন ফাঁসির মঞ্চে। ফাঁসিকাঠে ওঠার আগের দিন ইংরেজ পুলিশকে বলে গেলেন, ‘এই দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আমার স্ত্রী পুষ্পর আত্মত্যাগ মিথ্যে হতে পারে না।’
মাস্টারদাদের জন্য ভারতজননী এখনও চোখের জল ফেলে। বিপ্লবস্পন্দিত বুকের তরতাজা যুবকদের নাম নতমুখে গর্জে ওঠে বড় বড় মঞ্চে। শুধু সব মঞ্চের অন্তরালে থেকে যায় পুষ্পদের ত্যাগ, কান্না ও আমৃত্যু অপেক্ষা। যে অপেক্ষার সীমা নেই। যে অ-দেখায় সম্ভাবনা ও শঙ্কা লেত্তির মতো দোল খায় হাতে। স্বামীর সোহাগ পুষ্পদের কাছে ফিরে ফিরে আসে অনিশ্চয় মৃত্যুর ঠিকানা লেখা খামে। সেই খাম হাতে আজও হয়তো অপেক্ষায় আছে পুষ্প। তার সূর্যোদয়ের জন্য।  
মনীষা মুখোপাধ্যায় 
 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৫০ টাকা১১২.০৬ টাকা
ইউরো৯১.০৪ টাকা৯৪.২২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা