পক্ষে
আমরা বিজ্ঞানের দৌলতে এখন অনেকটাই আধুনিক হয়েছি। জীবনের অনেক বিষয় সহজেই হাতের নাগালে পেয়ে কাজ চালাচ্ছি। কিন্তু এর যে একটা ভয়ঙ্কর দিকও আছে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারছি না। রোজগারের ক্ষেত্রে যে এই আধুনিক প্রযুক্তিই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক সর্বত্রই এখন কর্মী ছাঁটাই নিয়মিত ঘটনা। তার জায়গায় আসছে এআই। এর ফলে এক একটা পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে, আধুনিক পরিষেবা পেতে গিয়ে মানুষকে বেকারত্বের দুনিয়ার ঠেলে দেওয়ার পিছনে এআই-এর ভূমিকা মারাত্মক। এর ব্যবহার যত বাড়বে ততই এক যান্ত্রিক জীবনের অন্ধকারে ডুবে যাব আমরা। যন্ত্রই তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।
চন্দ্রা শীল, শিক্ষিকা
বিকাশ এবং পরিবর্তন একে অপরের পরিপূরক। পৃথিবী যত উন্নত হচ্ছে, এআই ততই সুদৃঢ় করছে নিজের স্থান। আধুনিক সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা। মানুষ হয়ে উঠছে যন্ত্রনির্ভর। আর ভুলে যাচ্ছে, সে-ই যন্ত্রের সৃষ্টিকর্তা। এআই থাবা বসাচ্ছে মানুষের রুজি-রোজগারেও। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি তাদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করতে, সময় নিয়ন্ত্রণ করতে ছাঁটাই করছে কর্মীদের। প্রত্যেক চাকরিপ্রার্থীকে হয়ে উঠতে হচ্ছে প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ। তাছাড়া তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কদর নেই। ফলে কাজ পাওয়াও হয়ে উঠছে দুষ্কর। এরকম চলতে থাকলে হয়তো অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রিত হবে এআই-এর মাধ্যমে। মানুষকেই পরিচালনা করবে এআই। অজান্তেই তারা অবরুদ্ধ হবে নিজেদের হাতে তৈরি যান্ত্রিক কারাগারে।
বিদিশা সরকার, শিক্ষার্থী
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর অতিরিক্ত প্রয়োগে আমাদের দেশে লাভ যেমন হচ্ছে তেমনই ক্ষতিও হচ্ছে প্রচুর। যে দেশে বেকারত্ব বেশি সেখানে কম লোক দিয়ে কাজের ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। দ্বিতীয় ক্ষতি, আমরা অলস হয়ে পড়ছি। যেমন আগে হিসাবরক্ষক থাকত। এখন ক্যালকুলেটরে কাজ চলে। তৃতীয়ত সায়েন্টিস্ট বা সৃজনশীল মানুষের মস্তিষ্ককে ভোঁতা করে দিচ্ছে এই প্রযুক্তি। মাথা ঘামিয়ে উদ্ভাবন যাঁরা করতেন, সেখানেও লোক কমে যাচ্ছে। আগে অনুবাদ করতে হলে অনুবাদকের দরকার হতো, এখন যন্ত্রের মাধ্যমে হয়। অর্থবিমা ও স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে তথ্য সংরক্ষণের জন্য যেসব লোক দরকার হতো, এখন আর হচ্ছে না। যন্ত্রের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছে।
নিতাই মৃধা, অবসরপ্রাপ্ত লেকচারার
প্রগতিশীল প্রযুক্তির আশীর্বাদরূপে এআই-এর প্রয়োগ জনজীবনে এক অশনিসঙ্কেত। কারণ পৃথিবীব্যাপী জনবিস্ফোরণের কালে প্রতিটি দেশেই জীবিকার সমস্যা উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। বেকারত্বের সীমা আকাশ স্পর্শ করেছে। যে বিপুল জনতা সাধারণ ভাতকাপড়ের প্রত্যাশায় থাকে, যেসব কৃতীজন অদম্য উৎসাহে তাঁদের শিল্প-সাহিত্য রচনায় মেতে উঠতে চান, এআই-এর প্রয়োগ তাঁদের সবারই হাত চেপে দিতে উদ্যত। অদূর ভবিষ্যতে তাঁদেরও রোজগারহীন হয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে হোঁচট খেতে খেতে জীবনপথে এগিয়ে যেতে হবে। ফলে সমাজে আর্থিক বৈষম্য প্রকট হবে। সামাজিক অবক্ষয় ঘটবে। তাই সর্বক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি প্রয়োগ হয়তো বড়সড় উন্নতি ঘটাবে, পাশাপাশি মানুষের রোজগারও কেড়ে নেবে।
সুভাষ চন্দ্র সিং, শিক্ষক ।
বিপক্ষে
অর্থনীতির পাঁচটি ধারা— উৎপাদন, শিল্প, পরিষেবা, প্রযুক্তি এবং নীতি-নির্মাণ ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণ। মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গেই এই ধারাগুলো স্পষ্ট ও পোক্ত হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির এক নব সংযোজন হল এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যেমন পালকির বদলে ট্যাক্সি আসাতে মানুষ বেরোজগার হয়নি, বরং ট্যাক্সি চালানো শিখে এগিয়ে তারা গিয়েছে, তেমনই আজকের পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো এআই-এর ঘাড়ে ফেলে আরও উন্নততর কাজে হাত দেওয়াই সময়ের দাবি। এআই-এর পরে আসতে চলেছে এজিআই তথা কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা। তা এআই-এর নৈতিক সংকটের বাধাও উতরে দেবে। মানুষের বৌদ্ধিক চেতনা চিরন্তনী ও অমূল্য। তাই রোজগারের বাজারে দক্ষতার মূল্য থাকবে।
আবীর ভুঁইয়া, ছাত্র
এআই অদূর ভবিষ্যতে মানুষের রোজগার কখনওই কেড়ে নেবে না। দক্ষ কর্মী হলে তার কাজ হারানোর ভয় এমনিতেই থাকে না। আজ দেশে দক্ষ কর্মীর খুবই অভাব।
মার্চ ২০২৪ আইএলও-র রিপোর্ট অনুসারে বর্তমান ভারতে ৮-১০ মিলিয়ন শ্রমশক্তির মধ্যে প্রায় ৭ মিলিয়ন শ্রমশক্তি অদক্ষ। এক্ষেত্রে এআই হল, মানুষের সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির একটি হাতিয়ার। সম্প্রতি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জানিয়েছে যে, এখন ক্যান্সার নির্ণয়ে এআই বড় ধরনের সাফল্য এনেছে। কোড অব এথিক্স-এর মাধ্যমে এআই-কে আবেগপ্রবণ ও বিবেকবান বানানো হবে। ফলে এর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে প্রচুর দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হবে। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই মানুষের রোজগারের পথ আরও প্রশস্ত হবে।
শেফালী প্রধান, শিক্ষিকা
বর্তমান সময়ে এআই-এর ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। যার কারণে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিগত কিছু চাকরি সংকটের মুখে পড়ছে। তাই বলে কখনওই বলা যায় না যে, অদূর ভবিষ্যতে এআই মানুষের রোজগার কেড়ে নেবে। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে যেমন সময় ও কৌশলের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই নিরাপত্তা ও গোপনীয়তারও প্রয়োজন হয়। এআই যেহেতু একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেহেতু মানুষের মতো সৃজনশীল ও মানবিক বোধ তাতে থাকে না। আর এই অভাবের কারণে তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা এই প্রযুক্তির পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। তাই এআই নির্ভর কার্যসম্পাদন করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সুতরাং এআই সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নিতে পারবে না মানুষের রোজগার।
সঞ্জীব দাস, কলেজের ছাত্র
আমার মনে হয় মানবজাতির অনুভূতিগুলো তাদের বুদ্ধির সঙ্গে মিশেই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অস্তিত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করেছে। এআই মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত এক বিশেষ সৃষ্টি। অর্থাৎ মানবমস্তিষ্কই গঠন করেছে এই কৃত্রিম মস্তিষ্ক। যদি আমরা ধরে নিই প্রাণের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর, তাই বলে কি আমরা ঈশ্বরের সমতুল্য হতে পেরেছি? অবশ্যই পারিনি। ঠিক তেমনই এআই-এর সৃষ্টিকর্তা হল স্বয়ং মানুষ। তাই এআই কখনওই মানুষের জায়গা নিতে পারবে না। এআই-এর নিজস্ব কোনও অনুভূতি নেই তাই মানুষের দেওয়া ইনপুট ছাড়া সে একেবারেই অচল। এআই কোনও দিন মানুষের রোজগার কাড়তে পারবে না। বরং মানুষই এআই-কে বহন করবে। এবং পরবর্তীকালে তাকেই বাহন বানিয়ে এগিয়ে যাবে নতুনত্বের পথে।
সৌম্যদীপ দে, ছাত্র