আমরা মেয়েরা

আগমনি চিত্রকথা

চালচিত্রে ধরে রাখেন পটচিত্রের কাহিনি। রেবা পালের তুলিতে কীভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে ইতিহাস? 

নোনা ধরা দেওয়াল। ইটের গায়ে শ্যাওলা সবুজ ছোপ অতীতের গল্প বলে। বারান্দার চুন খসে তৈরি হয়েছে নাম না জানা দেশের মানচিত্র। অ্যাসবেস্টসের ছাদে কখনও বৃষ্টির অবিশ্রান্ত শব্দ। কখনও বা ভাদ্র রোদের লুটোপুটি। মেঝেতে ছড়ানো রং, তুলি, আর্টপেপার। রঙিন ক্যানভাসে মহাদেব, পার্বতী, অষ্টসখী, রামসীতার একত্র বাস। তাদের গড়ে তোলার কারিগর রেবা পাল। চোখে চশমা। দু’হাতে সাধারণ চুড়ি। পরনে বেগুনি রঙা সুতির শাড়ি। আপনার বয়স কত হল? ‘যত বছর দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমার তত বছর বয়স’, উত্তর দিলেন শিল্পী।
কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে রেবার বাস। মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ একসময় সংসারের প্রয়োজনেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন তুলি। দুর্গা ঠাকুরের চালচিত্রে পটচিত্র আঁকেন তিনি। ৭৭ বছর বয়সেও তাঁর হাতে প্রাণ পায় একের পর এক ছবি। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি সংলগ্ন দর্জিপাড়া এলাকায় থাকতেন রেবার বাবা, মা। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। ছোট থেকে কোনওদিন ছবি আঁকার প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না রেবার। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে হবে। এই ভাবনায় শুধুমাত্র সংসারের কাজ শিখিয়েছিলেন তাঁর মা। বিয়ের পর রেবা দেখলেন, স্বামী প্রতিমা গড়ে সংসার প্রতিপালন করছেন। প্রতিমা তৈরির খুঁটিনাটি কাজ জানতেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম চালচিত্র। বড় সংসার, অথচ আয় সামান্য। কিশোরী রেবার মনে হয়েছিল স্বামীকে সাহায্য করলে কাজের পরিমাণ যদি কিছুটা বাড়ে, তাহলে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হবে। ‘তখন জিনিসের দাম খুব কম। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোক অনেক। তখনকার দিনের বড় সংসারে যেমন হতো আরকি। আমারও তিন মেয়ে, এক ছেলে। ওদের বাবাকে কাজে সাহায্য করতাম। যাতে কাজ একটু বেশি হয়। যদি পয়সা একটু বেশি আসে’, কাজের অবসরে বাড়ি থেকে ফোনে বলছিলেন রেবা। 
২০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। তারপর থেকে চালচিত্রে পটচিত্র এঁকেই একার উপার্জনে সংসার চালিয়েছেন। এখন ছেলে, মেয়েদের নিজস্ব সংসার হয়েছে। মাকে দেখাশোনা করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত। কিন্তু রেবা আজও পটচিত্র এঁকে চলেছেন দীর্ঘ অভ্যেসে। এবার কতগুলো অর্ডার পেয়েছেন? রেবা বললেন, ‘এবছর খুব বেশি অর্ডার আসেনি। এখন কম্পিউটার এসে গিয়েছে তো, আর আগের মতো অর্ডার আসে না। লকডাউনের আগে পর্যন্ত আমি নিজেই যেতাম কুমোরটুলি। এখন আর যেতেও পারি না। তবে ওখানেও এখন এই কাজের চাহিদা কম। আসলে হাতের কাজে জিনিসের দাম সব সময়ই বেশি। এক একটা চালচিত্র তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। কম্পিউটারে তো অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। ধরুন, আমার থেকে কিনতে গেলে যদি ১০০ টাকা লাগলে, কম্পিউটারে করিয়ে নিলে তা ৫০ টাকায় হয়ে যাবে।’
মাটির পুতুল তৈরিতে বিখ্যাত কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি। সেই মাটিতে জন্ম রেবার। শিল্পবোধ, শৈল্পিক মনন যেন তাঁর আজন্মের সম্পদ। তবে কলকাতার পটুয়াপাড়া অর্থাৎ কুমোরটুলির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ও স্বামীর হাত ধরেই। তাঁর কথায়, ‘আমার স্বামী পুজোর আগে কুমোরটুলিতে যেতেন। আমিও ওঁর সঙ্গে যেতাম। উনি কুমোরটুলিতে চালচিত্র বিক্রি করতেন। সেই থেকেই আমার পরিচয়।’ প্রথমে ক্যানভাসে টানা রং দেওয়াই ছিল রেবার কাজ। চালচিত্রে কখনও আকাশি নীল, কখনও বা গাঢ় নীলের যে ব্যাকগ্রাউন্ডে তৈরি হয় নানা মোটিফ, শুধু সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের টানা রংটুকুই করার অনুমতি পেতেন ‘হেল্পার’ রেবা। এরপর চালচিত্রে স্বামীর এঁকে দেওয়া নানা ফিগারে প্রয়োজন মতো লাল, হলুদ, সবুজ রং ভরতেন। চালচিত্রে হরেক মোটিফ আঁকার অনুমতি পেয়েছিলেন অনেক পরে। ‘দেখুন, আমার সবটাই দেখে শেখা। আঁকা শিখিনি কখনও। ফলে আমি যে একাজ করতে পারব, তা তো জানতাম না। উনি যখন বাড়ি থাকতেন না, তখন কিছু কিছু ফিগার মাটিতে খড়ি দিয়ে, চক দিয়ে আঁকতাম। ওভাবে প্র্যাকটিস করতাম। তারপর ধীরে ধীরে 
খবরের কাগজের উপর আঁকতে শুরু করি। তারও পরে আর্ট পেপারে এঁকেছি’, বলছিলেন রেবা। পুরোটা একবারে তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই ছোট ছোট অংশে ভাগ করে তৈরি হয় গোটা চালচিত্র। এক একটা অংশ ভালো করে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিয়ে পরেরটায় রঙের প্রলেপ দেন তিনি। 
গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া পটচিত্রের নানা কাহিনি এখন জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। রেবার মতো মানুষ হাতে গোনা। যাঁরা হাতের কাজে ধরে রেখেছেন এই পুরাতনী সম্পদ। মেশিনে তো চটজলদি ছেপে দেওয়াই যায়। কিন্তু হাতের কাজে এক একটা চালচিত্র এক একরকম সৌন্দর্য নিয়ে সেজে ওঠে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সে তৈরি কাজে একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব সকলেই জানেন। কিন্তু তাও ‘তৃতীয় বিশ্ব’ আদতে নিঃস্ব। গুণের কদর করতে সত্যিই কি জানে তারা? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন প্রবীণা। বললেন, ‘এই কাজে পয়সা নেই। এটাই সত্যি। সেকারণেই এই কাজ শিখতে চায় না কেউ। আমার ছেলে, মেয়েরাও শেখেনি। ওদের বাবা বলতেন, এই কাজ করলে দুঃখ হবে, করিস না। ফলে নাতি, নাতনিদের কাছে আমি আশাই করি না। আমি এই কাজ করেই সংসার টেনেছি। কারও সাহায্য নিইনি। কিন্তু আজকের দিনে শুধু এই কাজের ভরসায় সংসার চলবে না।’
তাহলে ভবিষ্যৎ? হাতের কাজ জানা মানুষগুলো তো হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের গল্প। রেবা মনে করেন, এটাই ভবিতব্য। এই সহজ সত্যিটা মেনে নেওয়াই মঙ্গল। কথা সেরে ফের সচল হবে প্রবীণার আঙুল। মা দুগ্গা রওনা হবেন। তার আগেই সাজিয়ে তুলতে হবে চালচিত্র। বছরভরের উপার্জন ঘরে তুলে তবে মিলবে বিশ্রামের অবসর। 
স্বরলিপি ভট্টাচার্য
9d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মস্থলে জটিলকর্মে অনায়াস সাফল্য ও প্রশংসালাভ। আর্থিক দিকটি শুভ। ক্রীড়াস্থলে বিশেষ সাফল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা