শিশুর বড় হয়ে ওঠার সময় সব কিছু নিয়মমতে না হলে সামলাবেন কীভাবে? জানালেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মানসী সাংভি ভয়ানি।
বাচ্চা কথা বলতে দেরি করছে। কিংবা অসম্ভব দুরন্ত, কোনও কাজই ঠিক করে করছে না। কারও কথায় ঠিকমতো সাড়া দিচ্ছে না। বাড়ি বা স্কুল, যেখানেই থাকুক, সবসময় অন্যমনস্ক। কী করবেন? অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শ পাবেন, বাচ্চা একটু বড় হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ক’টা দিন অপেক্ষা করে দেখো। অথবা কেউ বুদ্ধি দেন, ছোটবেলায় বাচ্চা দুরন্ত হবে না তো কী? এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ধৈর্য ধরো, কিছুদিন পরে বাচ্চা সব ঠিকমতো করবে।
এধরনের সময়ের অপব্যয় অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার বেড়ে ওঠায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। তাই সময় থাকতে সতর্ক হওয়া খুব দরকার। বড় হয়ে ওঠার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চা স্বাভাবিক গতির তুলনায় নিশ্চয়ই একটু ধীরে এগতে পারে। কিন্তু সেটা কখন ‘স্বাভাবিক’ নয়, তা বোঝার জন্য মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে আবেগতাড়িত হয়ে বা সত্যিকে না মেনে বাচ্চার আরও ক্ষতি না করাই শ্রেয়। বিষয়টি বিশদে বললেন মনোবিদ মানসী সাংভি ভয়ানি। তাঁর কথায়, ‘কোনও বাচ্চার যদি এধরনের সমস্যা দেখা দেয়, সেটা বুঝতে বুঝতে সাত বছর বয়স হয়ে যায় বাচ্চার। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা কথা মাথায় রাখা যায়, কোনওভাবেই দেরি না করা। আগেভাগে বিষয়টা অবহেলা না করে সতর্ক হলে অনেক বড় বিপদ এড়ানো যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দু’আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের মধ্যে সেভাবে কিছু বোঝা যায় না। তারপর থেকে সামাজিকভাবে ওদের হাসি, চোখে চোখ ফেলে দেখা, নড়াচড়া এই ধরনের স্কিল শুরু হয়ে যায়। এইসময় একটা করে অক্ষর বলাও শুরু হয়ে যায় অনেকেরই। সেটা যদি না হয়, তখন পেডিয়াট্রিশিয়ানের কাছে গিয়ে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে কিনা জেনে নিন। প্রয়োজনে নিউরো সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কথাও বলতে পারেন পেডিয়াট্রিশিয়ান।’
এক্ষেত্রে সাইকোলজিস্ট যেটা করেন সেটা হল, ‘সাইকোমেট্রিক ইভ্যালুয়েশন’। মানসী জানালেন, এতে বোঝা যায় যে কারও বাচ্চা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ধীরগতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কিনা (যাকে বলা হয়, ‘ডেভেলপমেন্টাল ডিলে’)। সেটা ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’, ইন্টেলেকচুয়াল অক্ষমতা হতে পারে। তবে আড়াই বছরে এটা বোঝা খুব সহজ নয়। কিন্তু কিছু কিছু লক্ষণ থাকতেই পারে। যেটা থেকে সাইকোলজিস্ট আপনাকে বলে দেবেন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হবেন কিনা। কারও ক্ষেত্রে মোটর ইস্যু থাকতে পারে, গ্রস মোটর বা ফাইন মোটর সংক্রান্ত। বাচ্চার কথা বলার গতি যদি অস্বাভাবিক শ্লথ হয়, তা ঠিক করতে স্পিচ থেরাপিস্ট সেশন করে ‘ওরাল মোটর এক্সারসাইজ’ করাতে পারেন। সামান্য দু’একটা শব্দ অন্তত যে বয়েসে বলার কথা, সেটা না বললে বুঝতে হবে বাচ্চার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
এডিএইচডি বা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’ আজকাল খুব ছোট বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তাঁর মতে, এর কারণ চিনি খাওয়ার বেশি প্রবণতা, কারও ডোপামিন লেভেল অনেক বেশি, মায়েরা আজকাল অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও প্রচণ্ড মোবাইল ব্যবহার করেন, তাদের নিজস্ব হাইপার অ্যাক্টিভিটি বেশি বা উদ্বেগের হার বেশি— এসব ক্ষেত্রে বাচ্চার মধ্যে এডিএইচডি প্রবণতা বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়ার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। তখন সাইকোলজিস্ট সেই বিষয়টাই দেখবেন। স্কুলেও পরবর্তীকালে এই বিষয়ে কিছুটা সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখা উচিত।
পরিবারের ভূমিকা প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি। মানসী মনে করেন, প্রত্যেকের লড়াইটা আলাদা। অনেক ধরনের মিথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বাবা-মাকে। পরিবারে অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেবে। প্রথাগত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে কিছু তারা ভাবতে পারে না। এখন যে ধরনের সচেতনতা বেড়েছে, উপায় হাতে এসেছে, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। তাই সচেতনতা এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি।
কখন বুঝবেন সমস্যাটা গুরুতর? মানসীর মতে, ধরুন বাচ্চা চঞ্চল বলে এক-আধবার স্কুল থেকে অভিযোগ এল। কিংবা বাড়িতেই কিছু কিছু ‘অ্যাক্টিভিটি’ নজরে এল যাতে মনে হল বাচ্চা একটু ‘বাড়াবাড়ি’ করছে। এটা এক-দুই-তিন বার হতেই পারে। কিন্তু এটা যদি ঘটতেই থাকে তাহলে সেটায় গুরুত্ব দিতে হবে। বাচ্চা কোনও কাজ শেষ করতে পারছে না। কখনওই। শিখতে পারছেই না। কাজ জমে যাচ্ছে অনেক। স্কুলে কী কী হচ্ছে, তা বুঝতেই পারছে না দীর্ঘ সময় ধরে। তাহলে এটাকে চঞ্চলতা বলে অবহেলা করা যাবে না। তখন মনে করতে হবে কোথাও একটা তাল কাটছে। স্কুল থেকে বারংবার অভিযোগ এলে শিক্ষক-শিক্ষিকার উপরে রাগ না করে ভেবে দেখতে হবে, ৪০জন শিশুর মধ্যে কেন আপনারটিকেই বারবার বলা হচ্ছে? মনে রাখবেন, শিক্ষক যখন আপনাদের এই বার্তা পাঠাচ্ছেন তার আগে তিনিও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে দেখার পরেই বলছেন। বাইরে থেকে সেকারণেই সাহায্য প্রয়োজন।
কিছু বাচ্চা অন্যমনস্ক হয় বা চট করে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে চায় না। সেক্ষেত্রে দু’-ছ’মাস পর্যন্ত দেখুন। তারপরেও তার মধ্যে কোনও পরিবর্তন না এলে আপনাকে ভাবতেই হবে। দুই থেকে সাত বছরের মধ্যে এটা ধরে ফেলতে পারলে খুব সুবিধা হয়। এরপরে বাচ্চার মানসিক গঠন একবার তৈরি হয়ে গেলে তাকে নতুন করে বুঝিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। কারণ বাচ্চা এই সময়টায় যা যা শিখেছে, তা ‘ভুল’ ‘অস্বাভাবিক’ বলে তাকে আবার নতুন করে সব কিছু শেখানোর দরকার পড়ে। সেটা বাচ্চার জন্য খুব ক্লান্তিকর ও
কষ্টকর প্রক্রিয়া।
তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া সবসময় সুবিধেজনক। বাবা-মায়ের ভয় থাকে, যদি বাচ্চার মধ্যে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু প্রবণতা দেখা যায় তাহলে কী হবে! কিন্তু এই ভয়ে পরামর্শ না নিলে সময়টা কিন্তু হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। আজকাল কর্মরত বাবা-মায়ের বাচ্চারা অনেকটা সময় আয়ার কাছে কাটায়। সেইরকম কেয়ারগিভার-ও কোনও লক্ষণ দেখে যদি কিছু বলেন, তাতে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তাঁরা বাচ্চার সঙ্গে অনেক বেশি
সময় কাটাচ্ছেন।
শেষে মানসীর পরামর্শ, পেরেন্টিং কিন্তু একটা যাত্রাপথ। জীবনে চলার পথে অনেক কিছু যেমন শিখে নিতে হয়, এক্ষেত্রেও অনেক কিছু শেখার আছে। শিখে নেওয়া বা জেনে নেওয়ার মধ্যে তো কোনও লজ্জা নেই। আজকাল স্পেশাল চাইল্ড আর সাধারণ বাচ্চার মধ্যে ভাগটাও অনেক অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন অধিকাংশ শিশুর মনঃসংযোগে সমস্যা, অনেকের মধ্যেই মোবাইল আসক্তি, আত্মবিশ্বাসের অভাব পরবর্তীকালে দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাকে সঠিকভাবে গাইড না করতে পারলে
ওদেরই ক্ষতি।
অন্বেষা দত্ত